হেবাংয়ের চার বোন হারেননি

হেবাংয়ের চার বোন
ছবি: খালেদ সরকার

হেবাংয়ের বয়স পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এরই মধ্যে দুই দফায় পাহাড়ি খাবারের এই রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখতে হয়েছিল। উদ্যোক্তা চার বোন—বিপলি, প্রিয়াঙ্কা, সুচিন্তা ও স্বস্তি চাকমা। চার বোনের মধ্যে দুজন বিবাহিত জীবন শুরু করেছেন।

২০১৬ সালে যাত্রা শুরুর কদিন পরই তাঁদের মা ক্যানসারে আক্রান্ত হন। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। মাকে নিয়ে শুরু হয় চার বোনের যুদ্ধ। মুম্বাই থেকে ঢাকা—পালাক্রমে চলে আসা-যাওয়া। সেই দফায় চার মাস বন্ধ ছিল হেবাং। মা সুস্থ হলে পুরোদমে চালু হয় প্রতিষ্ঠান।

গত বছরের মার্চে এল দ্বিতীয় আঘাত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে মাস দুয়েকের বেশি বন্ধ রাখতে হয় মিরপুরের কাজীপাড়ার এই রেস্তোরাঁ। এখন আবার রেস্তোরাঁ খুলেছে। অনলাইনের মাধ্যমেও তাঁরা খাবার সরবরাহ করছেন।

চার বোনের মধ্যে বড় বিপলি চাকমা বলছিলেন, ‘মায়ের অসুখে আর করোনায় প্রথম দিকে বিপন্ন মনে হয়েছিল। রেস্তোরাঁ আর চালু রাখতে পারব কি না, তা নিয়ে ভাবনা ছিল। কিন্তু সাহস হারাইনি।’

শুরুতে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে খাবার সরবরাহ করে বিপুল সাড়া পেয়েছিল চার বোনের উদ্যোগ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ডের পদচারী–সেতুর কাছে হেবাং চালু হয়। মায়ের অসুখ কিংবা করোনাকালেও তাঁদের ফেসবুক পেজ সক্রিয় ছিল।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত শনাক্ত হলো। ১৮ মার্চ করোনায় প্রথম মৃত্যু। ২২ মার্চ থেকেই হেবাং বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি চলে যান ১০ কর্মী। কর্মীদের সবাইকে তাঁদের পাওনা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিপলি বলেন, ‘কর্মীরা সবাই আমাদের আত্মীয়স্বজন। করোনাকালে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে পেরেছি, এ দাবি করব না; কিন্তু সাধ্যমতো করেছি।’

এখন রেস্তোরাঁর সব কর্মী ফিরে এসেছেন। করোনাকাল থেকে উত্তরণ হেবাংয়ের চার বোনের জন্য সহজ ছিল না। বিনিয়োগ তো খুব বেশি নয়। তাই হঠাৎ সবকিছু বন্ধ হয়ে গেলে প্রমাদ গোনেন তাঁরা। প্রথমে আসে রেস্তোরাঁ ভবনটির ভাড়া। এক পয়সা আয় নেই, কিন্তু ভাড়া তো দিতে হবে। এত টাকা কোত্থেকে আসবে? ভবনের মালিক সদয় হলেন। ভবন নেওয়ার জন্য গচ্ছিত টাকা থেকে কেটে রাখলেন ভাড়া। চার বোন প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী এখন সেই টাকা শোধ করছেন। কর্মীদের থাকার জন্য কাজীপাড়াতেই একটি বাড়ি নিয়েছিলেন। গুনতে হয়েছে সেই ভবনের ভাড়াও। সপ্তাহ শেষে এক দিন এসে ঝুঁকি নিয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করতেন তাঁরা। বিপলি বলছিলেন, ‘চারদিক সুনসান। রেস্তোরাঁয় ঢুকে আঁতকে উঠতাম। ভাবতাম, সুদিন কি আবার আসবে!’

হেবাংয়ের ফেসবুক পেজে অনেকেই বলছিল, ‘একঘেয়ে খাবারে আর চলছে না। খাবার সরবরাহ করুন।’ আশ্বাস পেয়ে দুটো কাজ করলেন তাঁরা। প্রথমে ‘গ্রিনি বাজার’ নামে পাহাড়ি সবজিসহ খাদ্যপণ্য সরবরাহ শুরু করলেন। সাড়া মিলল তাতে। নারী ব্যবসায়ীদের প্ল্যাটফর্ম ‘উইমেন ইন এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপে’ (উই) যোগ দিলেন। সেখানে অনেক পরিচিত মুখের সন্ধান মিলল। তাঁদের অনুপ্রেরণায় এখানে খাবার সরবরাহ শুরু হলো। বিপলি যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, সেখানে এক কর্মীর স্বামীর মোটরসাইকেল ছিল। তাঁকে রাজি করিয়ে খাবার সরবরাহ শুরু। গ্রাম থেকে আরেক ভাই এলেন। এই দুজন খাবার পৌঁছে দিতেন।

করোনাকালে অনলাইনের সর্বোত্তম ব্যবহার করেছেন খাগড়াছড়ির দীঘিনালার আদি বাসিন্দা এই বোনেরা। সেই সময় তাঁরা ক্রেতাদের অনেক নতুন খাবারের সন্ধান দিয়েছেন। যেমন শিমুল ফুলের শুকনা, মুলা শুকনা। বিপলি ভেবেছিলেন, পাহাড়ি খাবারের পাশাপাশি ক্ষতি পোষাতে নতুন ফাস্ট ফুড বা এসব খাবারের ফিউশন চালু করবেন কি না। বাদ সাধেন প্রিয়াঙ্কা। তাঁর সাফ কথা ছিল—রেস্তোরাঁর নামই হয়েছে একটি পাহাড়ি খাবারের নামে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না।

প্রিয়াঙ্কা বলছিলেন, ‘এটা একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সন্দেহ নেই। কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সংস্কৃতি তুলে ধরতে চেয়েছি। এখানে কোনো সমঝোতা করলে মূল উদ্দেশ্যটাই বিফলে যাবে।’

বিফলে যায়নি। সম্প্রতি হেবাংয়ে গিয়ে সেই পুরোনো ছবিই পেলাম। ঢুকতেই জুম ঘরের আদলে তৈরি বসার জায়গা। আছে চেয়ার-টেবিলও। প্রতিদিন আসেন অনেকে। শুক্র আর শনিবার জায়গা দেওয়া যায় না। করোনায় চার বোনের স্বপ্নসাধ থমকে গিয়েছিল, বন্ধ হয়নি।

পুনশ্চ, বাঁশ বা কলাপাতায় খাদ্য ভরে তা কয়লায় পুড়িয়ে খাবারের যে প্রক্রিয়া, তা–ই হেবাং।