'আমি ছাড়লেও মা আমাকে ছাড়বে না'

হাতে রং মাখানো তুলি। কপালে চিন্তার চিহ্ন। প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ। কিন্তু কোথাও একটা ঘাটতি রয়েই গেছে। সবটা হয়েও মনমতো হয়নি। দুর্গা প্রতিমার মুখে যেন মলিনতার ছায়া। হঠাৎই নীলমোহন পালের চোখমুখে দীপ্তি ফুটে উঠল। তুলি দিয়ে লাল রঙের সঙ্গে গোলাপি রং মেশালেন। তারপর প্রতিমার ঠোঁটে রংটুকু মাখলেন। এবার দুর্গার মুখে আশ্বাসের হাসি! ব্যস! এইবার শেষ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল মন্দিরের প্রতিমা তৈরির কাজ। কিন্তু দম ফেলার অবসরটুকুও হাতে নেই। এক্ষুনি তাঁকে যেতে হবে বাসাবো মন্দিরে। সেখানেও প্রতিমাকে সাজাতে হবে, তুলির আঁচড়ে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে হবে। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে সে পথেই পা বাড়ান তিনি।
শরৎ এলেই কাশফুল আসে। নীল আকাশে সাদা মেঘেরা হাসে। আর সেই সঙ্গে শুরু হয় দুর্গা দেবীকে আহ্বানের আয়োজন। এই আয়োজনকে অনেকাংশেই পরিপূর্ণ করে তোলেন প্রতিমাশিল্পীরা। তাঁদের ছাড়া যে দুর্গা প্রতিমা অবয়ব পাবে না। তাই এই কটা দিন তাঁরা শৈল্পিক রূপ দেন দেবীর। কিন্তু তারপর? তাঁদের মনে রাখে কজন? বছরের বাকি দিনগুলোয় তাঁদের হাঁড়িতে নিয়ম করে চাল ফোটে কি না কে খোঁজ রাখে? তাঁদের ভাগ্যে শিল্পী স্বীকৃতিটুকুও জোটে না। প্রতিমাশিল্পীদের এসব অন্তরালের কথা, আবেগের কথা জানতেই রাজধানীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপ ঘুরে কথা বলেছি তাঁদের সঙ্গে। তাঁরা জানিয়েছেন তাঁদের বেদনার মহাকাব্য।
রামানন্দ পাল। বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় গ্রামে। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে এই মৃৎশিল্পের সঙ্গে আছেন। লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। শিল্পী হওয়ার বাসনা ছিল মনে। চলে এলেন এই পেশায়। তাঁর সঙ্গে কথা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মন্দিরে। তাঁর সঙ্গে দুজন সহকারী প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন। এই মন্দিরের সঙ্গে বাসাবো মন্দিরের প্রতিমাও বানাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু রামানন্দ পাল শুধু প্রতিমাশিল্পীই নন। ‘শুধু এই কাজ করলে কি সংসার চলব?’ আক্ষেপের সুরে বলেন তিনি। একটি বেসরকারি বিমা কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি। আর সেই উপার্জনেই সংসার চলে। সন্তানেরা এই পেশায় আসুক, এটা তিনি চান না।
‘আমার মতো ওরা কষ্ট করুক, চাই না। এই কাজে অনেক পরিশ্রম। কিন্তু টাকা কম। টাকাও ঠিকমতো পাই না। গত বছর যেই মন্দিরের প্রতিমা বানাইছি, সেই খানে এখনো ১৫ হাজার টাকা পাই।’ খানিকটা থামেন। তারপর আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, ‘কাঠমিস্ত্রিরা যেই টাকা পায়, এই শিল্পকাজে সেই টাকাও নাই। সম্মানও দেয় না কেউ।’
শাঁখারি বাজারের ৫২ নম্বর দোকানের ভাড়াটে হরিপদ পাল। সারা বছর এখানে বসেই তিনি প্রতিমা বানান আর বিক্রি করেন। বাড়ি সাভারের শিমুলিয়া গ্রামে। বয়স ৭০। কিন্তু কাজের গতি দেখে বয়স বোঝার উপায় নেই। ’৬৪ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমির ছাত্র ছিলেন তিনি। তখনই শিল্পী হওয়ার ইচ্ছেটা তৈরি হয়। আর বংশগত পেশার প্রতি একধরনের দুর্বলতা মনে ছিলই। প্রতিমা বানিয়ে কত টাকা পাবেন এবার জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘শিল্পীর আবার আয় কী! ভালো লাগে, তাই করি। এতে ঠাকুর যা মিলায়ে দেয় তা-ই পাই। একটা কথা শুধু মনে হয়। প্রতিমা সুন্দর করে তৈরি করে প্রশংসা পাই। আমি জানি, মা তার চেয়েও সুন্দর। যদি একবার তাঁকে দেখতে পেতাম। সেই দর্শনের আনন্দ আমার কষ্টকে ভুলিয়ে দিতে পারত।’ দোকান ভাড়া, কর্মচারীদের বেতন দিয়ে মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা হাতে থাকে। তাতে সংসার চলে না। তখন ধার করেন। তবুও শিল্পীসত্তাটা দমে না। ‘বিভিন্ন ধরনের কষ্টের মাঝেও লেগে রয়েছি। দেহ চলে গেলে তো মাটিই সব। আমি তো এই মাটি নিয়েই কাজ করি। এই মাটির মধ্যেই আমি মাকে উপলব্ধি করি। সংসারে টানাটানি হলে দুঃখ আসে। তখন শিল্পকর্মে ডুবে যাই। সান্ত্বনা পাই।’ বলেই চোখজোড়া ভিজে ওঠে। চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমার এক ছেলে কিডনি রোগে ভুগতেছে। ওর চিকিৎসা করাতে হয়। এই জন্য খুব টানাটানির মধ্যে আছি। অনেক পয়সার দরকার।’ প্রতিমাশিল্পী হিসেবে অনেকেই চেনেন তাঁকে। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে স্মিথসোনিয়ান ফোকলাইফ ফেস্টিভ্যালে অংশ নিয়েছিলেন তিনি।
নবাবগঞ্জ শিবমন্দিরে প্রতিমা বানাচ্ছেন নিতাই পাল। সঙ্গি হিসেবে আছেন ছোট ভাই বিপ্লব পাল। গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরের টোলবাশাইলে। নিতাই পাল ২৫ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। এ মন্দিরের প্রতিমার জন্য বায়না করেছেন ৭০ হাজার টাকা। কিন্তু উপকরণের দাম বাড়ায় লাভ কতটা হবে বুঝতে পারছেন না। হয়তো হাজার বিশেক টাকার মতো থাকবে। তিনি প্রতিমা বানানো ছাড়াও স্বর্ণকারের কাজ করেন। এই পেশাটা অনেক দায়িত্বের, এমনটাই মনে করেন তিনি। সময়মতো কাজ দিতে হয়। আবার এর মধ্যে কোনো বিপদ হলেও কাজ শেষ করতে হবে। বলেন, ‘একবার প্রতিমা বানাইতে ঢাকা আসছি। বেলবরণের তিন দিন আগে মামা ফোন কইর্যা জানাইল দাদু মারা গেছে। কারোরে কিছু বুঝতে দেই নাই। চোখের জল চোখেই শুকাইছে। এই কাজ তো পবিত্র শরীরে করতে হয়। মানুষ মারা গেলে তো অশুচি হয়। এই জন্য যদি আমারে কাজ করতে না দিত, এই কারণে বলি নাই কিছু। হয়তো জানলে কাজের পয়সা দিত না। ঘুরাইত। পরে কাজ শেষ কইর্যা মামাবাড়ি গেছি।’
মৃৎশিল্পটা পরেশ মণ্ডলের জাত পেশা না। বাবা গয়না নৌকার মাঝি ছিলেন। গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জের খাগাইলে। বয়স ৫০ বছর। ২৫ বছর ধরে এই পেশায় আছেন। হাজারীবাগের কালীমন্দিরে প্রতিমা তৈরি করছেন তিনি। কীভাবে এই পেশায় এলেন জিজ্ঞেস করতেই তিনি বলেন, ‘বড় ভাই এক পালের কাছ থাইক্যা এই কাজ শিখছে। সে-ই আমারে শিখাইছে।’ বায়না কত পেয়েছেন জিজ্ঞেস করতেই জানান ৩০ হাজার টাকা। এত কম টাকায় লাভ হবে কি না সেটা জানেন না তিনি। আবার নিজের গ্রামের বারোয়ারি পূজার প্রতিমাটাও তাঁকেই বানাতে হচ্ছে। তবে তার জন্য কোনো বাড়তি টাকা পাবেন না তিনি। কারণটা বললেন নিজেই, ‘আমার বাড়িঘর নাই। আরেকজনের জমিতে ঘর তুইল্যা থাকি। গরিব মানুষ। সমাজিরা যখন একটা কিছু চায়, তাগো কথা রাখতে হয়। মানা করার শক্তি নাই।’ খানিকটা থামেন। তারপর স্বর নামিয়ে বলেন, ‘গরিবরে সবাই ঠকায়। যেখানেই কাজ করি, ১৫ টাকা পাওয়ার কথা হইলে, তারা দেয় ১৩ টাকা। ভয়ে কিছু বলি না। যদি আর কাজ না দেয়।’ তাঁর দুই মেয়ে পড়ালেখা করে। তাদের পড়ালেখার খরচ আর সংসার খরচ মিলিয়ে অনেক টাকা দরকার। কিন্তু তিনি অত টাকা পাবেন কোথায়? তাই তাঁর স্ত্রী সুপারি কাটার কাজ করেন। এই কাজে দিনে ৫০-৬০ টাকা আয় হয়। কিন্তু একদিন তাঁর অবস্থার পরিবর্তন হবেই, এই স্বপ্নটা মনে গেঁথে রেখেছেন তিনি। বলেন, ‘মা আমার দিকে মুখ তুইল্যা চাইবই। আমারে দিবই। হয়তো এখনো আমারে দেওয়ার সময় হয় নাই। তাই মাকে মনে মনে বলি, আমারে আশীর্বাদ করো, আমি যেন আরও ভালো কইর্যা তোমারে বানাইতে পারি।’
বাংলাবাজারের জমিদারবাড়ি দুর্গামন্দিরে প্রতিমা বানাতে ব্যস্ত বলাই পাল। তাঁর অভিযোগ একটু অন্য রকম। রথযাত্রার দিন থেকে প্রতিমা বানানোর কাজ শুরু হয়। তারপর পূজার আগের এক মাস খুবই পরিশ্রম করতে হয় প্রতিমাশিল্পীদের। দিন-রাত জেগে কাজ করতে হয়। খুবই পরিশ্রমের কাজ। ‘কিন্তু শিল্পী হিসেবে কেউ মূল্যায়ন করে না আমাদের। অনেকে আবার বলে কারিগর। এইট্যা নিয়ে মনে একটা দুঃখ আছে।’ তারপর বলেন, ‘আমি হয়তো কাজ ছাড়তে চাই। কিন্তু যাকে বানাই, সেই মা আমাকে ছাড়বে না। তাই মাকে বলি, তোমার চরণে ঠাঁই দাও। শক্তি দাও যাতে তোমারে আরও সুন্দর বানাইতে পারি।’