'তুমি কি কাছের মানুষ চিনতে ভুল করো?'

স্কুল কিংবা কলেজজীবনে ‘আমার প্রিয় শিক্ষক’ শিরোনামে রচনা লিখতে হতো। ক্লাসে বলে দেওয়া কিছু মূল পয়েন্ট কিংবা বইয়ে ছাপানো গতানুগতিক বর্ণনাগুলোই ঠাঁই পেত তাতে। এসব রচনা লিখতে গিয়ে আমি কখনো আবেগতাড়িত হইনি, কখনো অন্তর থেকে কোনো উপলব্ধি আসেনি। কিন্তু আজ, এই লেখাটা লিখতে গিয়ে আমি সত্যিই আবেগতাড়িত হচ্ছি।

আমি চিরদিনই শিক্ষক ও শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহী ছিলাম। আমার নিজেরও ইচ্ছে, আমি শিক্ষক হব। আমার চারপাশ জুড়ে থাকবে এক ঝাঁক শিক্ষার্থী। আমি তাদের ক্লাস নেব, তাদের সঙ্গে ভাবনা চিন্তা ভাগ করে নেব, তাদের যত্ন নেব। গর্ভে ধারণ না করেও আমি হব তাদের সবার মা। আমার এই স্বপ্নটা একদিনে গড়ে ওঠেনি। আমার স্কুল জীবনের বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকা খুব সূক্ষ্মভাবে আমার মধ্যে এই স্বপ্নটাকে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মাঝে আমি পেয়েছিলাম এ রকম শিক্ষকতার ধারণা।

এরপর অনেক দিন কেটে গেছে। পরবর্তীতে আরও অনেক শিক্ষক আমার জীবনে এসেছেন। আমাকে তাদের ক্লাস করতে হয়েছে, তাদের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় বসতে হয়েছে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে আঁকা শিক্ষকের ছবির সঙ্গে কারও অবয়ব ঠিক সেভাবে মেলেনি। কিন্তু হঠাৎ করেই আমার পরিচয় হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে সদ্য যোগদানকৃত শিক্ষক ওয়াহিদুল আলমের সঙ্গে। স্যার যেন ঠিক আমার কল্পনার বাস্তব মূর্তি।

স্যারকে প্রথমেই কোর্স টিচার হিসেবে পাইনি আমরা। ২০১৭-তে প্রথম আমি স্যারের টিউটোরিয়াল ক্লাস করি। অবশ্য আগে থেকেই স্যারের খুব প্রশংসা শোনা ছিল আমাদের। তবুও ভয় ছিল, স্যারকে যদি আমরা সন্তুষ্ট করতে না পারি।

স্যারের প্রথম যে ব্যাপারটি আমাকে আকৃষ্ট করেছিল, তা হলো স্যারের ক্লাস নেওয়ার অভিনব কায়দা। অন্যান্য শিক্ষকদের মতো স্যার গতানুগতিক ক্লাস নিতেন না। স্যার আমাদের কাছ থেকে আমাদের ভাবনাগুলো জানতে চাইতেন, সেসব নিয়ে আলোচনা করতেন, নিজের বক্তব্যও জানাতেন।

স্যারের ক্লাসে গিয়ে কখনো মনে হতো না যে, আমার সিজিপিএ এমন কিংবা আমার সামাজিক বা আর্থিক মর্যাদা এমন। বরং মনে হতো, আমরা সবাই স্যারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছি। টেবিলের অপর প্রান্তে বসা মানুষটি যেন আমাদেরই একজন।

আমার বর্ণনা পড়ে এটা যেন কেউ মনে না করেন যে, স্যার আমাদের কখনো বকতেন না বা চোখ রাঙাতেন না। তিনি শুধু প্রশ্রয় দিতেন কিংবা মিষ্টি মধুর কথা বলতেন না। স্যার যেমন রেগে যেতেন, তেমনিই আবার কাছেও টেনে নিতেন। শাসন আর স্নেহের অপূর্ব সমন্বয় হলেন আমাদের ওয়াহিদ স্যার। আমি জানি, যারা ওয়াহিদ স্যারকে চেনেন, তাদের মধ্যে আমার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা। কিংবা এমনও হতে পারে যে সবাই সমস্বরে চিৎকার করে বলবে, ‘ওয়াহিদ স্যার আমাদের সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক’!

স্যারের কাছ থেকে বোধ হয় আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ও স্মরণীয় শিক্ষাটা পেয়েছিলাম। এই গল্পটা আমি ঘুরেফিরেই বারবার করি। গল্পটা টিউটোরিয়াল ক্লাসেরই। আমি সেই সময়টায় আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দিনগুলো পার করছিলাম। ভীষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম আমি। আমার সমস্যাটা এমন ছিল যে আমি কাউকে খুলেও বলতে পারছিলাম না, আবার না বলেও স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।

সেই সময়েই স্যারের ক্লাসে একদিন আমাদের বলা হলো, আমাদের জীবনকে উপভোগ করার ও না করার ৩টি করে কারণ লিখতে হবে। আমি প্রথমে উপভোগ করার ৩টি কারণ লিখলাম। এরপর উপভোগ না করার ৩টি কারণ লিখতে গিয়ে আমার ওই সময়ের সমস্যাগুলো মাথায় পপ-আপ করে উঠে এল। আমি লিখলাম, যখন আমার খুব কাছের মানুষগুলো আমাকে ভুল বোঝে এবং আমার অভিপ্রায়কে অবিশ্বাস করে, তখন আমি আমার জীবনকে উপভোগ করি না।

এরপর যথারীতি স্যারের কাছে খাতা জমা দিলাম। স্যার যখন আমার খাতাটা হাতে নিলেন এবং পড়তে শুরু করলেন, তখনো আমি জানতাম না, ঠিক এর পরের মুহূর্তেই আমার মানসজগতে কী বিশাল পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। স্যার আমার জীবনকে উপভোগ না করার ৩টি কারণের মধ্যে উপরিউক্ত কারণটি পড়লেন এবং কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়েই তাকালেন আমার দিকে। প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি কাছের মানুষ চিনতে ভুল কর?’

আমার জীবনের সমস্যাগুলো আমাকে একটা বিশাল আকারের অতল কুয়ায় ফেলে দিচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে স্যারের এই প্রশ্নটা যেন আমার অন্তরাত্মাকে সজাগ করে তুলল। আমি কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কিন্তু উৎসুক হয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। স্যারও আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে পরবর্তী দুটো বাক্য উচ্চারণ করলেন—যা আমি হয়তো জীবনে কখনোই বিস্মৃত হব না। স্যার বললেন, ‘কাছের মানুষেরা কখনো ভুল বোঝে না। আর যে ভুল বোঝে, সে কখনো কাছের মানুষ হয় না।’

সত্যিই তো! হুট করেই যেন একটা কঠিন অঙ্কের সমাধান পেয়ে গেলাম আমি। মানুষ হিসেবে নিজেকে কতটাই না অবমূল্যায়ন করছিলাম আমি! কাছের মানুষ চিনতে কি বিরাট ভুল করে আসছিলাম! কাছের মানুষের সংজ্ঞা হঠাৎ করেই প্রকট হলো আমার কাছে। আর তার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াহিদ স্যারের সম্মানও আমার চোখে হাজার গুণে বেড়ে গেল।

শিক্ষক মানেই যে তিনি কেবল আমাদের বইয়ের অধ্যায়গুলো বুঝিয়ে দেবেন, সূত্রগুলো বিশ্লেষণ করে দেখাবেন—তা তো নয়। শিক্ষক মানে তিনি আমাদের বাঁচতে শেখাবেন, জীবনের কঠিন পথে হাঁটতে শেখাবেন। নিজেকে ও অপরাপর মানুষদের মূল্যায়ন করতে শেখাবেন। পড়ানোর ছলে জীবনোপযোগী পাঠদান করবেন।

ওয়াহিদ স্যার আমাদের ঠিক এভাবেই শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা শুধু দর্শনের তত্ত্বগুলোই সহজভাবে বুঝে নেই না, বরং জীবন সম্পর্কেও অনেক শিক্ষা পাই। আর এগুলো কেবল তত্ত্বকথা নয়। এগুলো বাস্তবধর্মী এমন সব উপদেশ, যা সত্যিকার অর্থেই ব্যবহারিক জীবনে কাজে লাগানো যায়।

আমি সত্যিই খুব গর্বিত এবং আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ যে, তিনি আমাকে এমন একজন মানুষের শিক্ষার্থী হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন। সবশেষে স্যারের সুস্থতা, শান্তি ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী