শ্যনবার্গের বর্ণনায় একাত্তরে গেরিলা যুদ্ধের বিবরণ

মুক্তিযুদ্ধ ছিল সর্বাত্মক জনযুদ্ধ। যুদ্ধের অবকাশে ঢাকার দোহারে মুক্তিযোদ্ধারা, ১৯৭১
ছবি: আনোয়ার হোসেন

এটা ছিল সিডনি শ্যনবার্গের প্রথম যুদ্ধ। দিল্লিতে নিউইয়র্ক টাইমস–এর ব্যুরোপ্রধান কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে বিভীষিকাময় লড়াইয়ের খবর সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর যখন প্রতিবেদন লিখতে শুরু করেন, তখন তিনি ছিলেন অনভিজ্ঞ। পরে তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন, ‘আপনাকে খুব তাড়াতাড়ি অনেক কিছু শিখে ফেলতে হয়!’

যুদ্ধের ওপর প্রথম সবক নেওয়ার জন্য তিনি বাঙালি বিদ্রোহীদের সঙ্গী হয়েছিলেন। ভারতীয় সীমান্তে যাওয়ার অনুমতি পান তিনি। সেখানে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সদস্যরা মুক্তিবাহিনী তথা লিবারেশন আর্মিকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন। বাঙালি বিদ্রোহীরা লিবারেশন আর্মি নামেই নিজেদের পরিচয় দিতেন। ভারতীয়রা (বিএসএফ) বলেছিল, মুক্তিবাহিনী কী করেছে, তা তাঁকে নিয়ে গিয়ে দেখাবে। শ্যনবার্গের জন্য ওই অভিযান এখনো এক ভয়ানক অভিজ্ঞতা হয়ে রয়েছে। তিনি প্রায় ১০ বিদ্রোহীর এক দলের সঙ্গে গিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজনের পায়ে এমনকি জুতা পর্যন্ত ছিল না।

তরুণ বয়সী গেরিলারা তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। শ্যনবার্গ বলেন, ‘তাঁরা গ্রাম থেকে উঠে এসেছিলেন। বাংলাদেশে গ্রামের মানুষেরাই ছিল সবচেয়ে নিপীড়িত। তারা তেমন ইংরেজি বলতে পারত না। যদিও তাদের কাছে শেখ মুজিবই ছিলেন সবচেয়ে অনুকরণীয়।’ এই যুদ্ধ কতটা অসম ছিল, সে কথাই মনে করছিলেন তিনি।

ইন্দিরা গান্ধী সরকার বাঙালিদের আন্দোলনে জুলাই থেকে সমর্থন জোরদার করে। বিদ্রোহীদের সহযোগিতা করতে ভারতের শীর্ষস্থানীয় জেনারেলসহ সেনাসদস্যদের প্রতি সরাসরি নির্দেশ ছিল। ভারত গোপনে বিদ্রোহীদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতে সাহায্য করেছিল। মস্কোয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে থেকে ডি পি ধর এতে সমর্থন জুগিয়েছেন এবং সরকারের ওপর বিরাট প্রভাব খাটিয়েছেন। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমাদের অবশ্যই সব অস্ত্রশস্ত্রের জোগান দিতে হবে।’ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এমন গোপন সমঝোতা ‘পুরোপুরি অনৈতিক’ বলে স্বীকার করলেও এ ক্ষেত্রে ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার অনুরোধ জানান তিনি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সহায়তায় লন্ডনে অবস্থানরত বাঙালিরা বেলজিয়াম থেকে অস্ত্র কিনে গেরিলাদের কাছে পাঠিয়ে দেন।

এই যুদ্ধপ্রচেষ্টার একটি ছোট অংশ ছিলেন আর্চার ব্লাডের তরুণ বাঙালি বন্ধু শহুদুল হক। তিনি বলেন, ‘এটা ছিল খুবই আদর্শিক একটি যুদ্ধ। কী ঘটছিল, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না।’ সেনাবাহিনীর দমনাভিযানে ক্ষিপ্ত হয়ে ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়া বন্ধুদের এবং রক্তের সম্পর্কীয় এক ভাইকে দেখে উজ্জীবিত হয়ে তিনি একটি ছোট ব্যাগ বেঁধে ফেলেন। তৈরি হন ভারত সীমান্তে যেতে। এক স্বজনের পথনির্দেশনায় সীমান্তে পৌঁছালেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু ট্রাকের চোখ এড়ান তিনি। পথে শোনেন বন্দুকযুদ্ধের শব্দ। সীমান্তে পৌঁছে গেরিলাদের একজন গাইডের সঙ্গে দেখা করলে তিনি তাঁকে একটি অগোছালো ও অস্থায়ী প্রশিক্ষণ শিবিরে নিয়ে যান।

বিদ্রোহীরা ছোট ছোট পাকিস্তানি সেনাদলের ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের হত্যা ও অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা পাকিস্তানিদের সরবরাহভান্ডার, বিভিন্ন রেলপথ, সেতু ও নৌযানে আক্রমণ করেন। এই বিদ্রোহের প্রধান শক্তি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করার সামর্থ্য থাকলেও নতুন স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য অনেক মহড়ার প্রয়োজন ছিল। নিজ দেশের জলাভূমি ও নৌপথ ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন বিদ্রোহীরা। তারপরও নৌপথে কার্যকর লড়াই করতে বিদ্রোহীদের দরকার ছিল ছদ্মবেশ ধারণ ও হামাগুড়ি দিয়ে চলা, পাঞ্জি স্টেক দিয়ে গর্তের ফাঁদ তৈরি করা, পানিতে ডুবে নলের সাহায্যে শ্বাস গ্রহণ, বন্দুক ও গ্রেনেড চালানো, হঠাৎ আক্রমণ ও রক্তপাত বন্ধের কৌশল রপ্ত করা।

এটা ছিল একটা রাজনৈতিক বিদ্রোহ, যার লক্ষ্য ছিল দেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করা। নিজেদের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে বাঙালি বিদ্রোহীরা তাঁদের পুরো জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, নারীরা কঠোর পরিশ্রমে অভ্যস্ত হোক, কৃষকদের হাতে জমির নিয়ন্ত্রণ যাক, স্থানীয় লোকজন কাঠের সেতুতে অগ্নিসংযোগ করুক বা টেলিফোন ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দিক। বিপ্লবে ঐক্য আসুক, ঠান্ডা মাথায় এটাই চেয়েছিলেন বিদ্রোহীরা।

এই গেরিলাযুদ্ধে ভারত নিজেকে পুরোপুরি জড়িয়ে ফেলে। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাজ্য আসাম ও ত্রিপুরায় সফরকারী একটি ভারতীয় দলের পক্ষ থেকে গান্ধী সরকারকে লেখা একটি প্রতিবেদনেও এটা দেখা গেছে (প্রতিবেদনটি ভারত সরকারের কাছে তুলে দেন জয়প্রকাশ নারায়ণ নামের এক কর্মী। প্রতিবেদনে গান্ধী, হাকসার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রামের কাছে যুদ্ধে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানানো হয়)। ধর ভারতের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ত্বরান্বিত করতে এবং বিদ্রোহীদের রাজনৈতিক উদ্দীপনা বাড়াতে চেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে তাঁদের সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র ও লড়াই সম্পর্কে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভারত সীমান্তের ভেতরে বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ শিবিরগুলো হয় ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর (বিএসএফ) তত্ত্বাবধানে, নয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণে ছিল।

বিদ্রোহীরা যখন বিভিন্ন শহর ও পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানে হামলা চালান, তখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাঁদের সহায়তা দেয়। যুদ্ধে সমর্থন ও গোলাবারুদের অব্যাহত সরবরাহ পেতে গেরিলারা এই বাহিনীর ওপর নির্ভর করতেন (এক বন্দুকযুদ্ধে ভারতীয় এই বাহিনী পালিয়ে যায়)। অনেক জায়গায় ভারতীয় কর্মকর্তারা সরাসরি নেতৃত্ব দেন। কোনো কোনো সেক্টরে এই সীমান্তরক্ষী বাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর তড়িঘড়ি হামলা করা থেকে গেরিলাদের নিবৃত্ত করতে তাঁদের নিরস্ত্র পর্যন্ত করেছে।

বিদ্রোহীদের ধ্বংসাত্মক নৌ অভিযানে ভারত সমর্থন দেওয়ায় খুশি ছিলেন দেশটির ডাইরেক্টর অব নেভাল ইন্টেলিজেন্সের ক্যাপ্টেন মিহির রায়। তিনি এর পেছনের কারণটিকে বিশ্বাস করতেন। তিনি বলেন, ‘যখন গণহত্যা শুরু হয়, তখন এটা পরিষ্কার ছিল যে এক কোটি শরণার্থী নিয়ে আমরা কোনো দেশ চালাতে পারব না। এসব শরণার্থীকে নিজ দেশে আমাদের ফেরত পাঠাতে হবে।’

রায় বাংলায় কথা বলতেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের বন্দরগুলো আটকে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে পাকিস্তানি সেনারা শুধু বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিজেদের রসদ জোগাতে পারে। তিনি বলেন, ‘তাই আমরা যোদ্ধা–ডুবুরি বা যোদ্ধা–সাঁতারু তৈরি করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলেছি, আমি স্বেচ্ছাসেবীদের চাই, যাঁদের বোনেরা ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যাঁদের মায়েরা খুন হয়েছেন।’ তিনি বলেন, তিনি দ্রুত তাঁদের ভারতে প্রশিক্ষণ দেন। পরিচালনা করেন যোদ্ধা–ডুবুরিদের শিবির। তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন সুশিক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র। তাঁরা ছিলেন দারুণ সাঁতারু এবং এলাকা সম্পর্কে ধারণা ছিল তাঁদের। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি চট্টগ্রামে আক্রমণ করতে চাইতাম, তবে সেখানে যাঁরা বসবাস করেন, আমি তাঁদের নিতাম।’

বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘চমকে দেওয়াটা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানতাম, প্রথম আক্রমণ হতে হবে অবশ্যই বড় রকমের। আমাদের সময় বাছাই করতে হবে। এটা হতে হবে জ্যোত্স্নাবিহীন রাত। আমরা ঠিক জায়গামতো ঠিক মানুষকে পাঠিয়ে দিতাম। তাঁরা ছিলেন বাঙালি। তাই তাঁদের প্রবেশে সমস্যা ছিল না। প্রথমে আমরা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র দিতাম। এরপর শত্রুকে খুঁজে নিতে হতো তাঁদের।’ তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে হামলায় নিয়োজিত ছিলেন তাঁর প্রায় ২০০ যোদ্ধা–সাঁতারু।

রেগে গিয়ে রিচার্ড নিক্সন বলেছিলেন, ভারতীয়রা ‘শত্রুদের নৌকাসহ সবকিছু উড়িয়ে দিচ্ছে।’ সব মিলিয়ে নিজের সন্তুষ্টির কথা জানাচ্ছিলেন রায়, বিমা প্রতিষ্ঠান লয়েডস অব লন্ডনের অনুমান অনুযায়ী, ‘আমরা ১ লাখ’—১০০ হাজার—‘হাজার হাজার টন জাহাজি পণ্য ধ্বংস করেছি। বন্দরগুলোয় কোনো কার্যক্রম সচল ছিল না।’ রায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছিলেন মেজর জেনারেল জ্যাকব-ফারজ-রাফায়েল জ্যাকব। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক জাহাজ ডুবিয়েছি। আমি এর চেয়ে বেশি বলতে চাই না। তাতে বাণিজ্যিক জাহাজের মালিকেরা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবেন।’

শিবিরগুলোর অবস্থা ছিল করুণ। ছিল না পর্যাপ্ত সুপেয় পানি ও খাবারের ব্যবস্থা। যদিও অনেক তরুণ বিদ্রোহী এখানে শুধু লুঙ্গি পরে আসতেন, তবু তাঁদের কোনো পোশাক বা জুতা দেওয়া হতো না। ভারতের পর্যবেক্ষকেরা একটি শিবিরে ‘মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে তরুণদের গাদাগাদি করে থাকতে দেখেছেন, ‘যেখানে ছিল না বৃষ্টি থেকে নিজেদের বাঁচানোর কোনো ব্যবস্থা।’ ভারতের সীমান্তবর্তী ত্রিপুরা রাজ্যে তরুণদের ২১টি প্রশিক্ষণ শিবিরের সব কটি পরিদর্শন করে বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ‘এই তরুণদের মানবেতর অবস্থায় থাকতে দেখেছেন।’ তিনি দাবি করেন, শিবিরগুলোয় কিছু তরুণ থাকতে না পেরে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যান। সেখানে ‘তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যককে দেখামাত্র গুলি খেতে হয়েছে’ বলে জানা যায়।

সাহসী যোদ্ধা হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করে ভারতীয় সেনা ও সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের মুগ্ধ করেন বাঙালি তরুণেরা। ভারতীয় ভূখণ্ডে থাকা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিবিরগুলো ব্যবহার করে তরুণ বিদ্রোহীরা পূর্ব পাকিস্তানের ২০ মাইল পর্যন্ত ভেতরে গিয়ে আক্রমণ চালিয়েছেন। এ রকম একটি শিবিরে ভারতীয় ওই পর্যবেক্ষকেরা ‘৩২-৪০ কিশোরের একটি দলকে হ্যান্ডগ্রেনেড ব্যবহার করার প্রশিক্ষণ নিতে দেখেছেন, যাদের বয়স ছিল বড়জোর ১০-১২ বছর।’ এসব ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের এক জ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদের বর্ণনায় আতঙ্ক জন্ম নেয়। তিনি লিখেছেন, এই শিশু যোদ্ধাদের তুচ্ছজ্ঞান করে ব্যবহার করা হতো: ‘গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিয়ে ৫ থেকে ১০ জনের একেকটি দলে ভাগ করে এদের পাকিস্তানি সেনাদের দখলকৃত এলাকার অনেক ভেতরে পাঠানো হতো। সঙ্গে দেওয়া হতো একটি বা দুটি হ্যান্ডগ্রেনেড এবং দু–একটি প্রচলিত ও অপ্রচলিত অস্ত্র। এই পরিস্থিতিতে এদের অধিকাংশেরই শত্রুর হাতে অসহায় শিকারে পরিণত হওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকত না।’

সূত্র: দ্য ব্লাড টেলিগ্রাম, নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড আ ফরগোটেন জেনোসাইড, গ্যারি জে ব্যাস, ২০১৩। অনুবাদ: মো. আবু হুরাইরাহ্

গ্যারি জে ব্যাস: প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পলিটিকস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল
অ্যাফেয়ার্স বিভাগের অধ্যাপক; পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী।