বিন্দু বিন্দু ঘাম, ফোঁটা ফোঁটা তেল

>

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ভূমিহীন মোকছুদার ও তঁার স্ত্রী রশিদা গরুর বদলে ঘানি ঘু​রিয়ে সরিষা থেকে তেল বের করতেন সাত বছর ধরে। ২০০৬ সালের ৮ মে ‘বিন্দু বিন্দু ঘাম ফোঁটা ফোঁটা তেল’ শিরোনামে সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোতে। মর্মস্পর্শী এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সমাজের সহৃদয় ব্যক্তিরা এগিয়ে আসেন। মোকছুদারকে ​কিনে দেন গরু আর জমি। নগদ টাকাও পান তিনি। সেই টাকা দিয়ে মোকছুদার কিনেছিলেন ট্রাক্টর। 

.
.

প্রতিটি লোমকূপ নিয়ে শরীরের ভেতরের পানি বিন্দু বিন্দু ঘাম হয়ে বেরিয়ে আসছে। কপাল বেয়ে মাথার ঘাম পড়ছে মাটিতে। তবু অনবরত ঘুরছেন তঁারা। আর তাতে ঘানি বেয়ে পাত্রে পড়ছে ফোঁটা ফোঁটা তেল। সংসারের চাকা সচল রাখতে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ভূমিহীন মোকছুদার ও তঁার স্ত্রী রশিদা এভাবে গরুর বদলে ঘানি ঘোরাচ্ছেন সাত বছর ধরে।
উপজেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুর্শা ইউনিয়নের পলাশবাড়ী গ্রামে গেলে মোকছুদার জানান, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। বাবা আজগার ছিলেন ভূমিহীন। ঘানিতে তেল তৈরি করেই চলত সংসার। ১৯৮৭ সালে বাবার মৃত্যুর পর অন্য ভাইয়েরা আলাদা হয়ে গেলে তিনি এই পেশায় আসেন। আগে গরু দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে তেল তৈরি করতেন। তখন আয়ও হতো বেশি। ছয় সদস্যের সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তঁার চার মেয়ের এক মেয়ে খাদিজার বিয়ে দিতে ঘানি ঘোরানোর গরুটি বিক্রি করে দিতে হয়। অভাবী এলাকায় উপার্জনহীন হয়ে পড়ে পরিবারটি।

অনেক চেষ্টা করেও আর গরু কিনতে না পেরে জীবন বাঁচানোর তাগিদে স্বামী-স্ত্রী মিলে শুরু করেন ঘানি টানার কাজ। প্রতিদিন ১৬ কেজি সরিষা ভেঙে তেল তৈরির পর বাজারে বিক্রি করে যে ৫০-৫৫ টাকা আয় হয়, তা দিয়ে কষ্টে চলে তাঁদের সংসার।

নিত্যদিন ঘানি টানার ফলে স্বামী-স্ত্রীর ঘাড়ে ঘানির গরুর মতোই কালো দাগ পড়েছে। সে দাগ দেখিয়ে মোকছুদার বলেন, একটি গরু থাকলে এত কষ্ট হতো না। উপার্জনও হতো বেশি। গ্রামে ঘুরে সরিষা কেনা, তা দিয়ে ঘানি ঘুরিয়ে পাওয়া তেল, খৈল বাজারে বিক্রি করে সামান্য লাভে অভাব দূর হয় না।

রশিদা জানান, ‘সন্তানদেরও ঠিকমতো খাবার দিতে পারি না। অভাবের কারণে ছোট মেয়ে মল্লিকাকে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে পাঠাতে হয়েছে। পরনের কাপড় নেই।’ বলতে বলতে রশিদার হলুদ ঘোলাটে চোখ ছলছল করে ওঠে।

গ্রামের আমিরুল, রোস্তম, রহমান, ছাইদুল, মর্জিনা, কোহিনুর, হামিদুল ও আনছার জানান, মোকছুদার ও তঁার স্ত্রীর মতো দুর্ভাগা এই গ্রামে আর নেই। ঘানি টানলে খাবার জোটে, না টানলে অনাহার। গরুটি বিক্রির পর এ অবস্থা হয়েছে তঁাদের।

কুর্শা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহীনূর ইসলাম মার্শাল বলেন, ‘মোকছুদারের দুর্দশার কথা আমাদের জানা আছে। তাই আশ্বিন-কার্তিকে তাদের নামে ভিজিএফ কার্ড দিই।’

আরও পড়ুন :