বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করতে চাই

>
অনিমেষ কুমার গাইন
অনিমেষ কুমার গাইন
এ বছর ইউরোপিয়ান জিয়োসায়েন্সেস ইউনিয়নের (ইজিইউ) দেওয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভাগে ডিভিশন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৬ অর্জন করেছেন। এখন তিনি জার্মানির রাজধানী বার্লিনের নিকটবর্তী পোস্টডাম শহরে অবস্থিত জিএফজেড-জার্মান রিসার্চ সেন্টার ফর জিয়োসায়েন্সে কর্মরত।

ছোটবেলায় আমার মা–বাবা চেয়েছিলেন, বড় হয়ে আমি একজন ভালো চিকিৎসক হব। পরবর্তীকালে আবিষ্কার করলাম, আমি জীববিজ্ঞানে ভালো নই। মা–বাবার ইচ্ছা অনুযায়ী মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিই আমি, কিন্তু সুযোগ পাইনি।
সুন্দরবনের খুব নিকটবর্তী প্রকৃতির মাঝে আমার বেড়ে ওঠা। আমার স্কুলজীবন পর্যন্ত আমাদের চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ চমৎকার ছিল। সে সময় আমাদের এলাকায় ক্রমান্বয়ে চিংড়ি চাষ চালু করা হয়। এতে ধীরে ধীরে এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট হতে থাকে। তার ওপর বাড়তে থাকে বিভিন্ন দুর্যোগ। যেমন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা আর সেই সঙ্গে নদীভাঙনের প্রকোপ। লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের জন্য এসব প্রধান ভূমিকা পালন করে। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে আমাদের এলাকায় প্রাকৃতিক পরিবেশও ধ্বংস হতে থাকে। তখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা তৈরি হয় আমার মধ্যে। ঠিক করলাম, আমি একজন গবেষক হব, বিশেষ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে।
আমি যা কিছু অর্জন করতে পেরেছি তা সম্ভব হয়েছে নিরলস ও ক্রমাগত কঠোর পরিশ্রম করার মাধ্যমে। আমার মতে, কঠোর পরিশ্রম মেধার চেয়ে আরও গুরুত্বপূর্ণ।
আমার মা–বাবা শিক্ষক হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই আমি পড়ালেখার একটা ভালো পরিবেশ পেয়েছি। তাঁরা সবকিছু উজাড় করে দিয়েছেন আমার পড়ালেখার জন্য। শিক্ষা ও গবেষণায় সফল হওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই ভালো শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার অর্জনের পেছনেও ভূমিকা রয়েছে অনেক শিক্ষকের। এর মধ্যে আলাদা করে বলতে গেলে আমাদের বিদ্যালয়ের গণিতের শিক্ষক, আমার এমএসসি (বুয়েটের অধ্যাপক) এবং পিএইচডির থিসিস সুপারভাইজারদের কথা বলতে হয়। এ ছাড়া আমার অর্জনের পেছনে নিভৃতে প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন আমার স্ত্রী।
আমি যেখান থেকে উঠে এসেছি, খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার সুন্দরবনসংলগ্ন পদ্মপুকুর গ্রাম, সেখানে আজও বিদ্যুৎ–সংযোগ পৌঁছায়নি। সেই পরিবেশ থেকে উঠে শিক্ষা ও গবেষণায় ভালো করা ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বেশ কয়েকটি। প্রথমত, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া, যেখানে আমি পরিবেশ বিষয়ে বিভিন্নমুখী জ্ঞান পেয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত, বুয়েটে পানিসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে এমএসসি পর্বে বন্যাঝুঁকি নিয়ে গবেষণা করা, যেটা গবেষণার এক নতুন দ্বার উন্মোচন করে। তৃতীয়ত, ইতালির কা’ফস্কারি বিশ্ববিদ্যালয়ে জলবায়ু পরিবর্তন বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে পিএইচডি করার সুযোগ পাওয়া। চতুর্থত, গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ ইউরোপিয়ান জিয়োসায়েন্সেস ইউনিয়ন (ইজিইউ) কর্তৃক প্রদত্ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিভাগে ডিভিশন আউটস্ট্যান্ডিং ইয়াং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৬ অর্জন করা।
আমার স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি লক্ষ্য হলো একটি গবেষণা দল গঠন করা এবং এই দলের নেতৃত্ব দেওয়া। গবেষণা দলটি গঠিত হবে কিছু পিএইচডি এবং পোস্ট ডক্টরাল গবেষকদের সমন্বয়ে। এ ক্ষেত্রে আমার প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো একটি বৃহৎ গবেষণা প্রকল্পের জন্য তহবিল পাওয়া। এখন এ লক্ষ্যে আমি কাজ করছি। এ ছাড়া আমার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য হলো একটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা এবং আমার নির্দিষ্ট কাজের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও বৃহত্তর পরিসরে গবেষণা করা।
আমি বাংলাদেশের বাইরে বসবাস করি, তবে আমার সব গবেষণাকর্ম বাংলাদেশের ওপর। যেহেতু বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমার গবেষণাকর্ম বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে বলে বিশ্বাস করি। এ লক্ষ্যে আমি ইতিমধ্যে বিভিন্ন স্তরের ও দেশের সহকর্মীদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছি। যার অর্থায়ন করছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক লেভারহুলমে ট্রাস্ট।
দেশকে নিয়ে আমার কিছু সাধারণ স্বপ্ন আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
১. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ভিত্তি হওয়া উচিত গবেষণানির্ভর। কিন্তু বাস্তবতা হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাবান্ধব পরিবেশ বিদ্যমান নেই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাসহায়ক পরিবেশ বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষণার সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করা জরুরি।
২. বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু এখনো ধনী–দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য প্রকট। সরকারকে এমন সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে, যা ধনী–দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য কমাতে সাহায্য করে।
৩. বাংলাদেশ সরকারের পানি, জলবায়ু, পরিবেশসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চমৎকার নীতি রয়েছে। কিন্তু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে বিশাল ব্যবধান বাংলাদেশের জন্য একটা প্রধান সমস্যা।
আমি দেশের এ সমস্যাসগুলো নিরসনে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অবদান রাখতে চাই। কারণ, আমরা যদি এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারি, তবে বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।