ই-কমার্সে আরও এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ

>
জিয়া আশরাফ
জিয়া আশরাফ
অনলাইন ই–কমার্স সাইট চালডাল ডটকমের সহপ্রতিষ্ঠাতা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে কুড়িয়েছেন সুনাম, দেশ–বিদেশের সম্মাননা।

আমার শৈশব কেটেছে ঢাকায়। ঢাকার অন্য ছেলেদের মতোই বড় হয়েছি। পড়াশোনা, ঘোরাফেরা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। স্কুল, কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে এসে পা দিলাম একসময়। ভর্তি হলাম নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিংয়ে বিবিএতে। তখন থেকেই একটু ভিন্ন কিছু করব, এমন একটা স্বপ্নের শুরু। কিন্তু পড়াশোনার পাট চুকিয়ে অন্য সবার মতো ঢুকে গেলাম চাকরিতে। প্রথমে যোগ দিলাম একটি বেসরকারি ব্যাংকে। সেখানে ভালোভাবেই কাজ করছিলাম। কিন্তু কিছু একটা যেন মনের মতো ছিল না। তাই চাকরিটা ছেড়ে দিলাম। তারপর একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করলাম অফিসার ইনচার্জ হিসেবে। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সেখানে ভালোভাবেই কাজে লাগছিল। ফলে প্রায় দুই বছর টিকে গেলাম সেখানে। কিন্তু একঘেয়েমি চাকরি কিছুতেই মন ভরাতে পারছিল না।
আমার এক ভাই আছে, যে অটিস্টিক। ওর মতো যারা আছে তাদের জন্যও কিছু একটা করার পরিকল্পনা করতে থাকি। কিন্তু তেমন কিছু করা হয়ে উঠছিল না। নতুন কিছু করার স্বপ্ন কি তাহলে পূরণ হবে না? ২০১২ সালের শেষের দিকে মনে হলো, আর চাকরি নয়। এবার নিজেই কিছু একটা করতে হবে। তাই চাকরির মায়া ত্যাগ করলাম।
ছোটবেলার বন্ধু ওয়াসিম আলীম বাংলাদেশে পড়াশোনা করে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে একটা বিলিয়ন ডলার কোম্পানিতে কাজ করছিল। কিন্তু দেশের জন্য কিছু করা বা নিজের দেশে থেকে এখানেই কিছু একটা করার জন্য দেশে চলে আসে ও। পৃথিবীর সবচেয়ে জমজমাট ব্যবসার জায়গা ছেড়ে ওয়াসিম বাংলাদেশে এসেছিল নতুন কিছু একটা করতে। আমাদের আরেক বন্ধু তেজাস বিশ্বনাথ। এই তিনজন মিলে চিন্তা করতে থাকলাম কী করা যায়। তিনজনেরই ইচ্ছা ব্যবসা করার। কিন্তু কীভাবে শুরু করব, কী দিয়ে শুরু করব, কিসের ব্যবসা করব; কিছুই ঠিক নেই। তখন ২০১৩ সাল—অনলাইন বাণিজ্য ক্রমে বেড়ে উঠছে বাংলাদেশে। তিন বন্ধু মিলে ঠিক করলাম, অনলাইনেই একটা ব্যবসা করব। এটা তো ঠিক হলো, কিন্তু অনলাইনে কিসের ব্যবসা করব? এটা ঠিক করাও আমাদের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল।
অনেক আলোচনার পর ঠিক করলাম, সবচেয়ে কঠিন ব্যবসাটাই করব আমরা। চ্যালেঞ্জ যখন নিয়েছি, তখন সবচেয়ে কঠিন ব্যবসাটার চ্যালেঞ্জই নেব। সেই আইডিয়া থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনলাইন শপ খোলার পরিকল্পনা করলাম আমরা। ঠিক হলো, যে পণ্য বাড়ির নিচের দোকানেই পাওয়া যায়, সেই পণ্যেরই অনলাইন শপ তৈরি করব আমরা! আমরা যখন শুরু করলাম, তখন একদিকে অনলাইন শপ মানুষের কাছে পরিচিত নয়, তার ওপর আবার বাসার কাছের পণ্য অনলাইনে কেনার কথা তো চিন্তাই করতে পারত না কেউ! সবার কাছেই মনে হলো, এটা একটা পাগলামি ছাড়া কিছুই না। কিন্তু আমরা তখন নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখে ফেলেছি। জীবনের নতুন এক পয়েন্টে আমরা দাঁড়িয়ে তখন। কিছু করে দেখানোর তাগাদা মনের মধ্যে, আমাদের পেছনে ফিরে তাকানোর সময় কই?

ঢাকাবাসীর দোরগোড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেঁৗছে দেওয়ার সেবা​ দেন​ জিয়া আশরাফ ও তাঁর বন্ধুরা। ছবি: খালেদ সরকার
ঢাকাবাসীর দোরগোড়ায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেঁৗছে দেওয়ার সেবা​ দেন​ জিয়া আশরাফ ও তাঁর বন্ধুরা। ছবি: খালেদ সরকার

আমরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সঙ্গে মিলে এমন একটি নাম খুঁজছিলাম। ওয়েবসাইটের নাম হিসেবে পেয়ে যাই চালডালডটকম। সময়মতো মানসম্পন্ন পণ্য পৌঁছে দেওয়াই প্রধান পরিকল্পনা ছিল আমাদের। ২০১৩ সালে শুরুর দিকে ই-কমার্স সাইট ‘চালডালডটকম’ চালু করলাম। জীবন এক ভিন্ন মোড় নিল যেন। নিজেদের পকেটের টাকাগুলো একসঙ্গে করে চালু হলো এই অনলাইন দোকান। প্রথম দিকে গুলশান, বনানী ও বারিধারায় পরিচিত মানুষজনের কাছে সার্ভিস দেওয়া শুরু করি। ফেসবুক ও ই-কমার্স সাইট থেকে প্রথম দিনে দুটি অর্ডার পেয়েছিলাম। তারপর ধীরে ধীরে তা বাড়তে থাকে। এদিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, যেমন সাবান, কসমেটিকস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের কথা তুলে ধরেছিলাম। যখন বিভিন্ন কোম্পানির কাছে গিয়েছি তাদের পণ্য আমাদের সাইটে দেওয়ার জন্য; বেশির ভাগের কাছ থেকে ‘না’ শুনতে হয়েছে। এক দরজা থেকে ‘না’ শুনে মন খারাপ করে বাসায় ফিরে না এসে আরেক দরজার কড়া নেড়েছি। আইডিয়া শুনে ‘এমন প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নেই’ মন্তব্য করে না করে দিয়েছে অনেকে। বলেছে সরাসরি কোনো পণ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারবে না।
এ ছাড়া প্রথম দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা কাঁচা পণ্য সংগ্রহ করতে অনেক হিমশিম খেতে হয়েছে। শুরুতে এমন হয়েছে যে নিজেরাই পণ্য কিনে এনে, নিজেরাই ছবি তুলে তা আবার নিজেরাই আপলোড করেছি। কিছুদিন পর দেখা গেছে, ভালো সেই কোম্পানিগুলোই তাদের পণ্যের ছবি আমাদের সাইটে দেওয়ার জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করল!
ক্রেতাদের কাছে নিজেদের পণ্যের মান ও সঠিক সময়ে তাঁদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। একদিনের ঘটনা বলি। আমি অফিসে গিয়ে জানলাম, কয়েকটি অর্ডার আটকে আছে। কোনো ডেলিভারি বয় তখন ফাঁকা নেই। আর দুবার চিন্তা না করে নিজে সেই অর্ডার নিয়ে রওনা হলাম ক্রেতার বাসায় পৌঁছে দিতে। পণ্য পেঁৗছে দিতে ক্রেতার বাসায় পৌঁছে গেছি শুধু ভালোবাসা থেকেই।
ডেলিভারি বয় নিয়োগ, তাদের দিয়ে সঠিক সময়ে কাজ করিয়ে নেওয়া ছিল বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা আমাদের আইটি টিমের সহায়তায় নিজেদের অ্যাপ তৈরি করে ডেলিভারি বয়দের ট্র্যাক করার অ্যাপ তৈরি করেছি। যার ফলে আমরা জানতে পারি, আমাদের ডেলিভারি বয় সঠিক সময়ে ডেলিভারি দিচ্ছে কি না। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু টিমওয়ার্ক দিয়ে আমরা সব সমস্যা কোনো না কোনোভাবে কাটিয়ে উঠেছি।
মাত্র কিছুদিনের এই যাত্রায় আমাদের অর্জনও কম নয়। বিশ্বব্যাপী নতুন উদ্যোক্তাদের সহযোগীতা করে মার্কিন প্রতিষ্ঠান ওয়াই কম্বিনেটর। এ বছর প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রকাশিত বিশ্বসেরা ১০ নতুন স্টার্টআপে জায়গা পায় চালডাল। এটুআই প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরকারের সঙ্গে সরাসরি কাজ করার সুযোগ পেয়েছে চালডাল। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠিত সরকারি মেলাগুলোতে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে চালডাল। তবে চালডালের সবচেয়ে বড় পাওয়ার জায়গা হচ্ছে ক্রেতাদের ভালোবাসা। প্রতিনিয়ত চালডালে ক্রেতা বেড়েই চলেছে। ফলে কাজ করার ক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণা পাই।
এখন চালডাল আর আমি একই সুতোয় বাঁধা। ফলে নিজেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা মানে চালডালকে নিয়েই স্বপ্ন দেখা। সেই স্বপ্ন থেকেই বলতে চাই, ‘চালডাল ডটকম’ ভবিষ্যতে ই-কমার্স সাইটগুলোর মধ্যে শুধু বাংলাদেশে নয় সারা বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে দাঁড়াতে চায়। বর্তমানে শুধু ঢাকা নিয়ে কাজ করলেও ভবিষ্যতে পুরো বাংলাদেশে কভারেজ করার পরিকল্পনা রয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি ঢাকার বাইরের মানুষেরাও পাবে চালডালের সেবা। এ ছাড়া বিভিন্ন কোম্পানিকে ডেলিভারি সাপোর্ট দেওয়ার চিন্তাও করছি আমরা। সরকার যদি কখনো অনুমতি দেয়, তবে ড্রোন দিয়ে পণ্য ডেলিভারি করার পরিকল্পনা রয়েছে। এতে খুব কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি দিতে পারব আমরা। এখন গড়ে প্রতি দুই মিনিটে একটি ডেলভারি দিচ্ছে চালডাল; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই গড়ে প্রতি মিনিটে একটি ডেলিভারি দিতে চায় চালডাল।
দেশকে ভালোবাসি। দেশের মানুষের জন্যই কাজ করে চলেছি। ই–কমার্সে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে, এ জন্যই সব ধরনের চেষ্টা আমরা করছি। আমি মূলত দেশের অনলাইন খাত নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখি। প্রতিনিয়তই অনলাইনে বাড়ছে কেনাকাটা। এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত বাড়ছে অনলাইন শপের কদর। নাগরিক যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি মিলছে, বেঁচে যাচ্ছে সময়। দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে না যানজটেও।
নানা বাধা তোয়াক্কা না করে এগিয়ে চলছে দেশের অনলাইন শপগুলো। ক্রেতাদের সঙ্গে বাড়ছে আমাদের সখ্য। এই সখ্য অব্যাহত রাখতে চাই আমরা। দেশের অনলাইন শিল্পকে দেশের সেরা শিল্পে রূপান্তরিত করার স্বপ্ন দেখছি আমরা সবাই মিলে।