নিজের উন্নয়ন মানে দেশের উন্নয়ন

>
সাব্বির আহমেদ
সাব্বির আহমেদ
দায়িত্ব পালন করছেন ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএমএসএ) সভাপতি হিসেবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার এই প্রতিষ্ঠানটি।

আমি যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে চলেছি, সেটির বড় ভাইদের সহযোগিতা নিয়ে আজ আমি পড়াশোনা করছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার মতো অনেকেই সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা পেয়ে অনেক ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। কেউ কেউ পাস করে বেরিয়েও গেছেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হতে প্রতিবছরই ছুটতে হয় ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের। সেই সঙ্গে তাঁদের অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কারও আবাসন–সমস্যা। আবার কারও আর্থিক অসচ্ছলতা। ভর্তির প্রস্তুতিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী তথ্য, অর্থ ও অন্যান্য সহযোগিতার অভাবে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেন না। এমন শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁদের সুন্দর ভবিষ্যতের লক্ষ্যেই রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (ইউএমএসএ)।
বর্তমানে আমি এই সংগঠনের সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিভাগে পড়াশোনা করছি। আমি যেমন সহযোগিতা পেয়েছি, ঠিক তেমনি আমি আমার সাধ্যমতো অনেককেই সাহায্য করছি এবং অন্য সদস্যরাও সবার অবস্থান থেকে সেবামূলক এ কাজটি করে চলেছেন। আমাদের সবার চেষ্টায় কাউনিয়া উপজেলা থেকে প্রতিবছর গড়ে ৪০-৫০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিসহ ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই পাস করে বেরিয়ে চাকরিও করছেন। কিন্তু যে যেখানেই থাকুন না কেন, সবাই এই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন। ভালো কাজে তাঁরা সব সময় পাশে থেকেছেন; অনুপ্রাণিত করেছেন। উত্সাহ-উদ্দীপনা দিয়ে চলেছেন। এমন দৃশ্য দেখতে কার না ভালো লাগে?

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্যও কাজ করেন সংগঠ​নটির তরু​েণরা। ছবি: ম​ঈনুল ইসলাম
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্যও কাজ করেন সংগঠ​নটির তরু​েণরা। ছবি: ম​ঈনুল ইসলাম

আমাদের এ সংগঠনটি অরাজনৈতিক ও সেবামূলক। শিক্ষার্থীদের মানসিক উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চিকিত্সাসেবা, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের সুপরামর্শ, কারিগরি ও আর্থিক সাহায্য–সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে নৈতিক, মানবিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে দেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কাউনিয়া উপজেলার সার্বিক উন্নয়ন, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি হতে সার্বিকভাবে সহায়তা দেওয়া ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মানসিক, আর্থিক ও কর্মসংস্থানের সুপরামর্শ দেওয়া।
প্রকৃতপক্ষে সমস্যা থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। উচ্চশিক্ষা গ্রহণে এলাকার কোনো শিক্ষার্থী যেন সহযোগিতার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃহৎ জ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয়, এটাই আমাদের লক্ষ্য। সেই সঙ্গে অধ্যয়নরত কোনো শিক্ষার্থী যেন সুন্দর ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রচেষ্টা থেকে বিচ্যুত না হন, এটাও আমরা খেয়াল করি। কোনো কারণে যেন তাঁরা মাঝপথে এসে ঝরে না পড়েন কিংবা হতাশ না হন, সে বিষয়ে তাঁদের সুপরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতাও দেওয়া হয়।
আমাদের এই সংগঠনের সঙ্গে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী যুক্ত আছেন। যাঁরা উচ্চশিক্ষায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন। আবার কেউ কেউ শিক্ষাজীবন শেষ করে কর্মজীবনেও প্রবেশ করেছেন। তাঁদের চেষ্টা ও আর্থিক সহায়তায় আমাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত আছে। এই সংগঠনে আছে অনেকের অবদান। সবার নাম বলা সম্ভব নয়। তারপরও দু্জনের কথা না বললেই নয়। তাঁরা হলেন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মিজানুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক শামীম আল মামুন। তাঁদের জন্যই আজ আমরা একটা গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছি। সেই সঙ্গে আমাদের প্রাণের সংগঠনে উপদেষ্টা হিসেবে সব সময় পাশে থেকে সহযোগিতা করে চলেছেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক তুহীন ওয়াদুদ, সহকারী রেজিস্ট্রার তারিকুল ইসলাম; রংপুর ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক মোকসেদুর ইসলাম এবং স্থানীয় সাংবাদিক সারোয়ার আলম। তাঁদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
২০০৭ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ১৫ সদস্যের কমিটি রয়েছে; শিক্ষার্থীরাই এই কমিটির সঙ্গে যুক্ত হন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই কমিটি নির্বাচিত করা হয়। কমিটির সঙ্গে যুক্ত কারও শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলে আপনাআপনি কমিটি থেকে বাদ হয়ে যান তিনি। নতুন একজনকে সেখানে যুক্ত করা হয়। তবে কমিটির বিষয়টি খুব একটা মুখ্য নয়। আমাদের কাছে মুখ্য হলো ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। সেই সঙ্গে অন্যান্য সচেতনতামূলক কাজ করা।
সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর উচ্চশিক্ষা গ্রহণে ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে উপজেলার দুটি বড় কলেজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ থাকে। এই দুটি কলেজ হলো কাউনিয়া ডিগ্রি কলেজ ও মীরবাগ ডিগ্রি কলেজ। কলেজ দুটিতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করা হয়। তাদের পড়াশোনার খোঁজখবর নেওয়া হয়। যারা ভালো ফল করে, তাদের প্রেরণা ও উদ্দীপনা জোগাতে বৈঠক করা হয়। তাদের সবার সমস্যাগুলো শোনা হয়। এই বৈঠকে অভিভাবকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়। বলা চলে অভিভাবকেরাও আমাদের কজের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যান। তবে এসব কাজ করতে গিয়ে উপজেলার দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকেরা খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এ জন্য আমরা ওই দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের কাছে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞতা উপজেলার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিও।

দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্যও কাজ করেন সংগঠ​নটির তরু​েণরা। ছবি: ম​ঈনুল ইসলাম
দরিদ্র শিক্ষার্থীদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কাজ করছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড মেডিকেল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি এলাকার সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্যও কাজ করেন সংগঠ​নটির তরু​েণরা। ছবি: ম​ঈনুল ইসলাম

ভর্তি–ইচ্ছুকদের সহযোগিতা ছাড়াও উপজেলার বালাপাড়া, শহীদবাগ, কুর্শা ও মধুপুর—এই চার ইউনিয়নে বছরে অন্তত দুবার চিকিত্সাসেবার জন্য স্বাস্থ্যক্যাম্পের আয়োজন করা হয়। আমাদের এই সংগঠন কিংবা উপজেলা থেকে যাঁরা চিকিত্সাবিদ্যায় পড়াশোনা করছেন কিংবা চিকিত্সক হয়েছেন, তাঁরাই এ কাজটি করেন। চিকিত্সাসেবা দিতে গিয়ে অনেককে ওষুধও সরবরাহ করা হয়। সেই সঙ্গে যুব, তরুণ ও কিশোরদের মাদকসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে দূরে রাখতে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হয়। শীতার্ত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় শীতবস্ত্র। প্রতি ঈদে পথশিশুদের নতুন জামা দেওয়া হয়। আর এসব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় সদস্যদের নিজেদের অর্থায়নে।
আমাদের উপজেলায় ২০০৭ সালে প্রায় ২০০ জন ভর্তি–ইচ্ছুক শিক্ষার্থীকে সংগঠনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৪০ জন শিক্ষার্থী ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন। এছাড়া এখন প্রতিবছর গড়ে ৪০-৫০ জন কোনো না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হচ্ছেন।
এসব কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়টি অন্যতম। যেহেতু এটি একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এ কারণে এর সব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে সব সদস্যের সহযোগিতায় এ বাধা অতিক্রম করার চেষ্টা চলে। এ ছাড়া আমাদের রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা চালানো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে পথ না চলায় আমাদের নামে নানা ধরনের কটূক্তিও করা হয়েছিল। কিন্তু সদস্য ও উপদেষ্টাদের দৃঢ় মনোবলের কারণে আমরা সেসব বাধা অতিক্রম করেছি।
আমরা আমাদের প্রিয় সংগঠনকে নিয়ে প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখছি। আরও ভালো কিছু করতে চাই। আরও নতুন কিছু করতে চাই। আমরা স্বপ্ন দেখছি, উপজেলার শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণসহ মানবিক ও সচেতনতামূলক কাজে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার।
আমরা ভালোবাসি আমাদের দেশকে। দেশের মানুষকে। উপজেলার হতদরিদ্র ও অসহায় পরিবারের সন্তানেরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে নিজ এলাকাসহ দেশের কল্যাণে ও সার্বিক উন্নয়নে এগিয়ে আসবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
আমাদের উপজেলা থেকে যাঁরাই এখন উচ্চশিক্ষা গ্রহণে বাইরে যাচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশ পরিবারই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। কী করতে হবে, তারা এ নিয়ে আমাদের পরামর্শ নিতে যখন ছুটে আসে, তখন আমাদের প্রাণ ভরে যায়।
(অনুলিখিত)