মঁমার্তের ধাঁধানো আলো

তুলুস লোত্রেক
তুলুস লোত্রেক

উনিশ শতকের পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পী অঁরি দে তুলুস লোত্রেক সমালোচকদের অবিবেচনার শিকারে পরিণত হয়েছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁর পরিচয় ছিল নেহাত একজন আধুনিক পোস্টার শিল্পীর। তাঁর এই খণ্ডিত মূল্যায়ন দুঃখজনকভাবে তাঁর অগণিত পেইন্টিংয়ের শিল্পরস গ্রহণে আমাদের বহু দিন বঞ্চিত করে রেখেছে, যার অধিকাংশই ছিল পোস্টার রীতির ঊর্ধ্বে। সেসব শিল্পকর্মের নিখুঁত শৈলীগত দক্ষতা, শূন্য স্পেস আর সহজ ফর্মের কম্পোজিশন, রেখার ‘কনট্যুর’ আর গাঢ় রঙের ব্যবহারে—লোত্রেককে সমকালীন শিল্পগুরুদের সঙ্গে একই সারিতে আসন দেওয়ার মতো প্রতিভা ছিল।

দক্ষিণ ফ্রান্সের অ্যালবিতে তুলুস লোত্রেকের জন্ম ১৮৬৪ সালে, এক অভিজাত পরিবারে। ১৮৮৪ থেকে ১৯০১—এই ৩৬ বছর ছিল তাঁর জীবনকাল। আর কাজে সক্রিয় ছিলেন তিনি মাত্র ২০ বছর। এই সময়ের মধ্যেই তাঁর আঁকা ক্যানভাস ৭৩৭টি, জলরং ২৭৫টি, ৩৬৪টি প্রিন্ট এবং পোস্টার ও স্কেচবোর্ডে ড্রয়িংয়ের সংখ্যা ৫ হাজার ৮৪টি। সব মিলিয়ে তুলুস লোত্রেক পরবর্তীকালে আবিভূর্ত হয়েছেন পোস্ট ইম্প্রেশনিস্ট যুগের এক কীর্তিমান হিসেবে।

তাঁর অকালপ্রয়াণ আবারও প্রমাণিত করেছিল, মহান শিল্পীরা সময়ের আগে চলে যান।

কৈশোরে দুর্ঘটনায় তুলুস লোত্রেকের দুটো পা ভেঙে যায়। সঠিকভাবে চিকিৎসা না করায় তাঁর শরীরের নিচের অংশ খর্বকায় থেকে যায়। শৈশবের এই ভগ্নস্বাস্থ্য তাঁকে আততায়ীর মতো নিঃশব্দে অনুসরণ করেছে আমৃত্যু। এই সীমাবদ্ধতা তাঁকে বাইরের পৃথিবী থেকে বঞ্চিত করেছিল। তাই শৈশবের প্রিয় অভ্যাস ছবি আঁকায় গভীরভাবে মন দিলেন শারীরিকভাবে অপারগ এই শিল্পী। তাঁর স্কেচবোর্ড ভরে উঠতে শুরু করল নানা প্রাণিজ চিত্রে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪ বছর।

১৭ বছর বয়সে ১৮৮১ সালে তুলুস লোত্রেক প্যারিসে এসেছিলেন চিত্রশিল্পের প্রথাগত শিক্ষা নিতে। শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন লেওঁ বোনা ও ফার্দনান্দ কারমুকে। তাঁরা এই অনুজ শিল্পীকে প্যারিসের শিল্পাঙ্গনে পা রাখতে শেখালেন।

‘মুল্যঁা রুঝে, জনসমাবেশে আত্মপ্রতিকৃতি’, শিল্পী: তুলুস লোত্রেক, ১৮৯২
‘মুল্যঁা রুঝে, জনসমাবেশে আত্মপ্রতিকৃতি’, শিল্পী: তুলুস লোত্রেক, ১৮৯২


তাঁর জীবনের ধূসরতায় ভোগবাদী মঁমার্তের কিংবদন্তির মুল্যাঁ রুঝ ক্যাফের ঝলমলে উৎসব তুলুস লোত্রেককে আকর্ষণ করেছিল।
শিক্ষাজীবনে পোট্রে৴ট এঁকেছেন। সেসব ছিল নিখুঁত পর্যবেক্ষণ আর গতিময় রেখার সমন্বিত প্রকাশ। পরিণত বয়সে এসে মানুষের মুখভঙ্গি নিয়ে ক্যারিকেচার করার প্রবণতা লোত্রেককে পেয়ে বসে। সেই সঙ্গে পেয়ে বসে কিছুটা আকস্মিক ও অপ্রস্তুত মুহূর্তকে ধরার চেষ্টা, যা সচরাচর মানুষের অবয়বে ধরা পড়ে না। লোত্রেকের ধারণায় সেটা ছিল মানুষের অন্তর্গত কোনো গোপন স্বভাব, যা সে অসচেতনভাবে প্রকাশ করে। সেই তাৎক্ষণিক মুহূর্ত ছিল তাঁর কাছে উত্তেজক ও আরাধ্য। অঙ্কনরীতিতে তিনি প্রথাগত এচিং আর এনগ্রেভিংয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে লিথোগ্রাফের এক ভিন্ন সৌকর্য আবিষ্কার করেছিলেন। আর তা আজ অবধি প্রিন্ট মেকিংয়ের জনপ্রিয় ধারা হয়ে বেঁচে আছে।

লিথোগ্রাফ প্রিন্ট আর পেইন্টিংয়ে তিনি মঁমার্তের আভিজাত্যকে অনুসরণ করেছিলেন, রাতের আঁধারে কেবল যা জীবন্ত হয়ে উঠত। তিনি গৃহী ছিলেন না। আনুষ্ঠানিক জীবনযাপন তাঁর কাছে প্রায় পরিত্যাজ্য ছিল বলে নিশাচর ক্যাফে, পানশালা আর নাচের আসরের কেতাদুরস্ত আড়ম্বরে তিনি এক তুরীয় অভিজ্ঞতা উদ্‌যাপন করে গেছেন।

তাঁকে প্রভাবিত করেছিল এদগার দেগা। দেগার বিষয় আর অঙ্কনরীতি তিনি বেছে নিয়েছিলেন। দেগার নৃত্যপর ব্যালেরিনাময় ক্যানভাস লোত্রেককে প্রাণিত করেছিল উৎসবমুখর জীবনের ছবি আঁকতে।

১৮৮৬ সালে তাঁর পরিচয় হলো ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সঙ্গে। তাঁর ছায়া পড়ল লোত্রেকের এ সময়ের ছবিতে—তীব্র হলুদ, গোলাপি, নীল এমন সব অপ্রথাগত রং ব্যবহারের প্রবণতায় আর বিষয় হিসেবে ক্যাফের জীবনে। এ ছাড়াও গভীর প্রভাব পড়ল জাপানি প্রিন্ট শিল্পরীতির—ঘন রং, কৌণিক রেখা, শূন্য স্পেস আর গাঢ় বহিঃরেখা। আউগুস্ত রেনোয়ার ছবির বিষয়ও প্ররোচিত করল তাঁকে—অভিজাত মানুষের উৎসবমুখরতা, তাদের পরিধেয় পোশাক আর স্কার্ফ-টুপি-পালক, তাদের উৎসুক দৃষ্টির নিচে আবিষ্ট জটলা ঘিরে নৃত্যরত নারী, আর মানুষের নির্বাক নিঃসঙ্গতা।

উনিশ শতকের এই অন্তিম সময়টা ছিল প্যারিসের উদ্দীপনার কাল। অর্থনীতির ঊর্ধ্ব সূচক, জীবনযাত্রার উন্নয়ন, শিল্প-সৌকর্যের আকণ্ঠ উদ্‌যাপনের তীর্থভূমি প্যারিস এই সময়ে ছিল বহু প্রতিভার সম্মিলন কেন্দ্র। আর মঁমার্ত ছিল সব উদ্‌যাপনের কেন্দ্রভূমি। এই জায়গাটি ছেড়ে যেতে পারেননি লোত্রেক।

মাত্র ২৫ বছর বয়সে খ্যাতিমান শিল্পী হয়ে ওঠা তুলুস লোত্রেকের অধিকাংশ সন্ধ্যা ও রাত কেটেছে মুল্যাঁ রুঝ ক্যাফেতে, স্বল্প সময়ে যা পরিণত হয়েছিল আকর্ষক এক আনন্দকেন্দ্রে। ইউরোপ-আমেরিকার ধনাঢ্য মানুষের ভিড় উপচে পড়ত মুল্যাঁ রুঝে। এর এক কোণে বসে স্কেচ করতেন লোত্রেক। তাঁর ছবির চরিত্রগুলোকে সহজেই চেনা যেত। কেননা তাঁরা অগণিত হলেও কেউই ক্যানভাস আকীর্ণ করে ফর্মের ভিড় তৈরি করেননি।

ক্যাফেতে বসে স্কেচবোর্ডে তিনি মানুষের কোলাহল, বাগ্‌বিতণ্ডা আর পানীয়ের গ্লাসে গনগনে উৎসব আঁকতেন। ক্যারিকেচারের খসড়া স্কেচে তুলে নিতেন তাদের প্রতাপ, বাহুল্য আর মুখভঙ্গিতে উদগ্র বাসনার প্রকাশ। রাত শেষে ক্যাফে বন্ধ হলে তাঁর গন্তব্য হতো নিজের স্টুডিও। আবার সেখানে বসতেন ক্যানভাসের সামনে, খসড়া স্কেচকে রূপান্তরিত করতেন পেইন্টিং আর প্রিন্টে। ক্যাফেতে গ্লাসের পর গ্লাস পানীয়, জাগ্রত রাত জাগা আর অনেকটা নির্ঘুম দিনের সময়ব্যাপী ইজেলে পড়ে থাকা—এই ছিল লোত্রেকের জীবন। অনিয়ন্ত্রিত এই জীবন তাঁর খর্বকায় শরীরটি ভেঙে দিয়েছিল পুরোপুরি।

তুলুস লোত্রেকের অাঁকা মুল্যঁা রুঝের বিখ্যাত পোস্টার
তুলুস লোত্রেকের অাঁকা মুল্যঁা রুঝের বিখ্যাত পোস্টার

১৮৮৮ ও ১৮৮৯ সালে একক ও দলীয় প্রদর্শনীতে তুলুস লোত্রেকের ছবি প্রদর্শিত হতে শুরু করে। তবে বিস্ময়করভাবে তাঁকে অনন্য মাত্রা এনে দেয় ১৮৯১ সালে আঁকা পোস্টার ‘লা গুল্যু’। লিথোগ্রাফে করা এই পোস্টারে বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী লা গুল্যুকে তিনি এঁকেছিলেন ছবির কেন্দ্রে; তার পেছনে কালো অবয়বের দর্শক আর পুরোভাগে ধূসর বর্ণের এক সহশিল্পী। লা গুল্যু আছেন উজ্জ্বল বর্ণের পরিধেয়তে, ক্যানক্যান নৃত্যের ভঙ্গিমায় ঊর্ধ্বপদে। ছবিতে তাঁর উপস্থিতি পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে বিপরীত উপস্থাপনায়, কনট্রাস্টে—তাঁর ওপর এসে পড়েছে তীর্যক আলো। সব মিলিয়ে এটি ছিল কিছু সহজ ফর্মের বিন্যাস-রেখার বৈচিত্র্যে, রঙের বৈপরীত্যে, প্রধান-অপ্রধান চরিত্রের ক্যারিকেচারে এ ছিল উপস্থাপনার অপ্রচলিত এক রীতি। পোস্টার আগে ছিল কেবলই কিছু লেখা। তুলুস লোত্রেকের হাতে এভাবে তা অনবদ্য শিল্পরূপ হয়ে ওঠে। প্রকাশের এই ভিন্নতা দেগা, রেনোয়া আর ভ্যান গঘ থেকে লোত্রেককে আলাদাও করে দেয়। এরপর একের পর এক অসংখ্য পোস্টার এঁকে গেছেন তিনি। এসবের মধ্যে বিখ্যাত হয়ে আছে ‘দিভান জাপোন্যা’, ‘রাইন দ্য জো’, ‘কনফেত্তি’, ‘আরিস্তিদে ব্রুয়ান্ত দান্স সন ক্যাবারে’।
উনিশ শতকের শেষ দিকে তিনি যে ভিন্নধর্মী পোস্টারের জন্ম দিয়েছিলেন, আজকের বিচিত্র মাল্টিমিডিয়ার উপস্থাপনা তাঁর কাছে ঋণী। তাঁর সময়কাল থেকে আজ অবধি যাবতীয় শিল্পিত নাগরিক সম্প্রচার—বিজ্ঞাপন, সিনেমা বা প্যাম্ফলেট, সেটি যা-ই হোক—সর্বত্র তুলুস লোত্রেক থেকে গেছেন অবচেতনে।
তুলুস লোত্রেক গ্যালারির অভ্যন্তর থেকে পেইন্টিংকে নগরের দেয়ালে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর হাত ধরে ‘পাবলিক আর্ট’-এর উপস্থাপনার ভিন্নতর ধারণার জন্ম হয়। লোত্রেকের এই অবদান তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। বস্তুত শিল্পীসমাজের সঙ্গে সাধারণ নাগরিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্কের রচনার দিক থেকে তিনি প্রভূত ভূমিকা রাখলেন। চলমান প্রথার বিপরীতে এই উদ্যোগ অভিজাত আর সাধারণের ভেদ কমিয়ে আনল। কোনো তথ্যকে বিজ্ঞাপিত করার জন্যও তা ছিল সহজ ও বিস্তৃত এক রূপকল্প। শিল্পীর অঙ্কন-প্রতিভার কারণেই গ্যালারির পেইন্টিং সুলভে ছড়িয়ে পড়ার কারণে তার মূল্যহ্রাস হলো না। লোত্রেক এখানেই বড় হয়ে উঠলেন, যিনি নিজের শিল্পকর্মকে পোস্টারে বিজ্ঞাপিত করার ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে চ্যালেঞ্জের সামনে রাখলেন এবং তাঁকে শিল্পমানে উত্তীর্ণ করলেন।
শারীরিক বৈসাদৃশ্যের কারণে তাঁর জীবনে নারীসঙ্গ সহজ ছিল না। একসময় রীতিমতো ঘর ভাড়া করে তিনি নিয়মিত পতিতালয়ে থাকতে শুরু করেন। প্যারিসের বিখ্যাত পতিতালয় রু দ্য ম্যুলয়ে আঁকা পেইন্টিং সিরিজ আজও তাঁর সেরা কাজের একটি ধারা।
এভাবেই তুলুস লোত্রেক জীবনকে দেখতে চেয়েছেন, ছবির বিষয় নির্বাচন করেছেন আর তা প্রকাশে অকপট থেকেছেন। এই সময়ের তাঁর সেরা একটি কাজ ‘দ্য সালোঁ ইন দ্য রু দ্য ম্যুলয়’। তত দিনে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে সিফিলিস। সেই সঙ্গে পানীয়ের প্রতি ক্রমবর্ধমান আসক্তির একপর্যায়ে তিনি ডেলিরিয়াম ত্রেমেন্সে আক্রান্ত হলেন। তখন ১৮৯৯ সাল।
তাঁর জীবনের এই শেষ অঙ্কের অনেকটা সময় কেটেছে নিইলির সেন্ট জেমস স্যানিটোরিয়ামে। সুস্থ জীবনে না ফেরার সম্ভাবনায় দীর্ঘ উৎকণ্ঠার প্রহর কেটেছে, যেন আর কোনো দিন আঁকবেন না তিনি, আর কখনো রাতের বাতাসে হেঁটে ফিরবেন না মঁমার্তের উৎসবমুখর সমাগম থেকে। তারপরও মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বন্ধ দরজার পেছনে আঁকা হলো বিখ্যাত সার্কাস চিত্রগুলো। এগুলো তিনি এঁকেছিলেন প্যারিসের প্রথম জীবনের স্মৃতি থেকে। এরপর আর মাত্র দুই বছর বেঁচেছিলেন লোত্রেক। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাঁর ছবি ছিল অন্ধকারের মতো বিষণ্ন, গম্ভীর আর শীতার্ত। তিনি জানতেন, তাঁর সময় ফুরিয়েছে।

অপ্রতিসম ভঙ্গুর একটি দেহ নিয়ে তুলুস লোত্রেক সারা জীবন পড়েছিলেন প্যারিসের মঁমার্তে। ভ্যান গঘ চলে গেলেন দক্ষিণ ফ্রান্সে, তিনি গেলেন না। কয়েকটি ক্যাফে, ক্যাবারে, পাব, বিশেষত মুল্যাঁ রুঝ ছিল তাঁর একান্ত পরিসর। কিছু চেনা পথ, কয়েকজন বন্ধু আর পানীয়ের আসরে উত্তেজনা তাঁকে আজন্ম পূর্ণ করে রেখেছিল। শিল্পীদের অনেক জীবন, অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে বিচরণ করার যে তাড়না থাকে, তুলুস লোত্রেক তা থেকে দূরে সরে ছিলেন। তিনি ছিলেন এক নিভৃত জীবনের অধিবাসী। সন্ধ্যার অন্ধকারে যে জগৎ জ্বলে উঠত মঁমার্তের পথে পথে, তিনি ভালোবেসেছিলেন শুধু সেই পথের গুঞ্জন।

আমিমুল এহসান: স্থপতি ও নগর পরিকল্পক