জাদুর বাঁশি

ভল্‌ফগাং আমাডিউস মোৎসার্ট
ভল্‌ফগাং আমাডিউস মোৎসার্ট

১৭৯১ মোৎসার্ট যখন প্রয়াত হন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৫। সে যুগের বিবেচনায়ও তো একে অকাল বিদায়ই বলতে হবে। কিন্তু এই মাত্র সাড়ে তিন দশকব্যাপী জীবনপরিক্রমায় যে অনন্য কীর্তি তিনি রেখে গেছেন—কি সংখ্যায়, কি উৎকর্ষের বিচারে—তা প্রায় অবিশ্বাস্য। সোনাটা, সিম্ফনি, মাস, চেম্বার মিউজিক, কনসার্ট, অপেরা—কোথায় পড়েনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর! পাশ্চাত্য উচ্চাঙ্গসংগীত তাঁর অনলস সৃষ্টিসুখে নিরন্তর ঝংকৃত হয়েছে। আরও দীর্ঘজীবন পেলে নিজেকে কোন অনতিক্রম্য উচ্চতায় তিনি নিয়ে যেতেন, সে ভাবনা যেন সুদূর কল্পনাকেও হার মানায়।
ভল্‌ফগাং আমাডিউস মোৎসার্ট—শুধু মোৎসার্ট নামেই যিনি সুবিদিত—জন্মেছেন ১৭৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি, অস্ট্রিয়ার সাল্‌জ্‌বুর্গ নগরে। লিওপোল্ড মোৎসার্ট ও আনা মারিয়ার একমাত্র এই ছেলের সাংগীতিক প্রতিভার কিছুটা নিশ্চয়ই উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। লিওপোল্ড ছিলেন সাল্‌জ্‌বুর্গের প্রতিষ্ঠিত সংগীতকার, বেহালাবাদক ও দরবারের সহকারী কনসার্ট মাস্টার। মেয়ে নার্নেলকে মাত্র সাত বছর বয়সেই পিয়ানো প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন লিওপোল্ড। তিন বছরের ছোট্ট ভল্‌ফগাং মোৎসার্ট বড় বোনকে দেখে দেখেই সুর তুলতে শুরু করেন পিয়ানোয়। শিশুপুত্রের সাংগীতিক মেধায় বিস্মিত লিওপোল্ড তাকেও প্রশিক্ষণার্থী করে নেন। মহাউদ্যমে চলতে থাকে দুই ভাইবোনের সংগীত শিক্ষণপর্ব।
লিওপোল্ড একদিকে যেমন ছিলেন নিষ্ঠাবান শিক্ষক, তেমনি আবার শিক্ষাটাকে কী করে আনন্দময় করে তুলতে হয় সে জাদুটাও জানা ছিল তাঁর। ফলে তাঁর তত্ত্বাবধানে ভাইবোন দুজনেই যে সংগীতশাস্ত্রে কুশলী হয়ে উঠবে, তাতে আর সন্দেহ কী! শিশু মোৎসার্ট পাঁচ বছর বয়সেই প্রথম সুর রচনা করেন এবং বেহালা ও হার্পসিকর্ড বাদনে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখান। এরপর অতি দ্রুত তিনি পিয়ানো, অরগ্যান ও ভায়োলাতেও উজ্জ্বল প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৬৬২ সালে বাবা ও বোনের সঙ্গে ছয় বছরের ছোট্ট মোৎসার্ট বের হন ইউরোপ-ভ্রমণে। মিউনিখ, প্যারিস, লন্ডন, হেগ, জুরিখের মতো বড় বড় ইউরোপীয় নগরীর সংগীতপিপাসু শ্রোতৃমণ্ডলীকে সুরের জাদুতে মোহিত করে এই শিশুপ্রতিভাদ্বয়। তবে দীর্ঘ ও কষ্টকর যাত্রাপথের ধকল সামলাতে না পেরে মোৎসার্ট পরিবারের সদস্যরা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে এ সফর সম্পূর্ণ করার আগেই বাতিল করতে হয়।

অস্ট্রিয়ার সাল্‌জ্‌বুর্গ শহরে মোৎসার্টের পৈতৃক বাড়ি
অস্ট্রিয়ার সাল্‌জ্‌বুর্গ শহরে মোৎসার্টের পৈতৃক বাড়ি

১৭৬৯-এর ডিসেম্বরে বাবার সঙ্গে মোৎসার্ট লম্বা সফরে বেরোলেন ইতালির বিভিন্ন প্রান্তে। বোন নার্নেল তত দিনে সে যুগের হিসেবে বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছেন। ফলে অত সম্ভাবনাময়ী হওয়া সত্ত্বেও সংগীতের ক্যারিয়ারে দাঁড়ি টানতে হয়। মোৎসার্টের সেসব ঝামেলা নেই, ফলে তাঁর প্রতিভার পূর্ণ বিকাশের অনুকূল সুযোগ ও পরিবেশ তিনি পেলেন ও তার সদ্ব্যবহার করলেন। এই সফরেই নতুন তিনটি অপেরা রচনা করলেন তিনি। বয়স তখনো ১৬ পেরোয়নি। ফিরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে কর্মজীবনে ঢুকলেন, সাল্‌জ্‌বুর্গের আর্চবিশপ তাঁকে স্বল্পবেতনে সহকারী কনসার্ট মাস্টার হিসেবে নিয়োগ দিলেন। ক্রমেই মোৎসার্ট আরও পরিণত সুরস্রষ্টা হয়ে উঠতে থাকলেন। জন্ম দিলেন নিরীক্ষাধর্মী, অভিনব ও দুরূহ সব সুরমূর্ছনার। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি একাধিক সিম্ফনি, স্ট্রিং কোয়ার্টেট, সোনাটা, অপেরা, ভায়োলিন কনসার্টো, পিয়ানো কনসার্টো রচনা করলেন।
তবে এসব অর্জন তাঁকে আত্মবিশ্বাসী আর উচ্চাভিলাষীও করে তুলেছিল। ফলে সাল্‌জ্‌বুর্গের ছোট্ট গণ্ডিতে তাঁর আর মন টিকতে চাইছিল না। ১৭৭৭-এর আগস্টে মাকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ভাগ্যান্বেষণে—মানহাইম, প্যারিস, মিউনিখের মতো বড় বড় শহরে। অনেকেই নানা রকম আশ্বাস দিলেও ঠিকঠাকমতো কিছু মিলল না। এর মধ্যে ১৭৭৮-এর ৩ জুলাই মা মারা গেলেন। অবশেষে বাবার দৌত্যে কোর্ট অরগ্যানিস্টের চাকরি নিয়ে আবার সাল্‌জ্‌বুর্গেই ফিরলেন। এ দফায় করোনেশন মাসসহ প্রচুর চার্চসংগীত রচনা করলেন। রচিত হলো অপেরাও। তবে কর্মক্ষেত্রে মনোমালিন্য আবার মাথাচাড়া দিল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলেন ভিয়েনাতেই থিতু হবেন এবং স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।
ভিয়েনাতে বেশ গুছিয়ে বসেন মোৎসার্ট। কাজ জুটিয়ে নেন, ছাত্রছাত্রী মেলে অনেক, কনসার্টে বাজানোর আমন্ত্রণও আসে বেশুমার। এদিকে ভিয়েনায় প্রথম উঠেছিলেন যাঁর বাড়িতে, সেই ফ্রিডোলিন ওয়েবারের কন্যা কনস্ট্যাঞ্জার সঙ্গে হৃদয় বিনিময়ও তত দিনে সম্পন্ন। বাবা লিওপোল্ডের প্রাথমিক অনাপত্তি কাটিয়ে এ সম্পর্ক পরিণতি পেল ১৭৮২ সালের ৪ আগস্ট। এ দম্পতি ছয় সন্তানের জনক-জননী, তবে এর মধ্যে কেবল দুজন ছাড়া আর সবাই বাল্যেই গত।
পরের বছরগুলো যথারীতি মোৎসার্ট সংগীতসৃষ্টিতে উদ্বেল। এ সময়, বিশেষত বাখ ও হান্ডেলের রচনা তাঁকে প্রাণিত করে এবং বারোক রীতির প্রভাব স্পষ্টতই পরিলক্ষিত হয় তাঁর পরের দিককার রচনাগুলোতে। তা ছাড়া, এ সময় জোসেফ হেইডনের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। ১৭৮২-৮৫ সালের মধ্যে মোৎসার্ট হেইডনকে উৎসর্গ করে ছয়টি কোয়ার্টেট রচনা করেন। এ সময় তাঁর অপেরা ‘ডাই এন্টফুহরুং’ বিপুল সফলতা লাভ করে এবং ইউরোপের একজন অগ্রগণ্য সংগীতকার হিসেবে তাঁর আসনটি পাকাপোক্ত করে দেয়। এসব সাফল্য হাত ধরে নিয়ে আসে আর্থিক সচ্ছলতাও। ভিয়েনার বিলাসী অ্যাপার্টমেন্টে সপরিবারে ঠিকানা হয় মোৎসার্টের।

মোৎসার্টের হাতে লেখা তাঁর সংগীতের স্বরলিপি
মোৎসার্টের হাতে লেখা তাঁর সংগীতের স্বরলিপি

পাশাপাশি এগিয়ে চলে তাঁর সংগীতজীবনও। বস্তুত, ১৭৮২-১৭৮৫ সাল পর্যন্ত সময়টাকে বলা যায় মোৎসার্টের সৃষ্টিশীলতার সর্বোৎকৃষ্ট পর্ব। এমনও হয়েছে, পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে একাদিক্রমে ২২টি কনসার্টে তিনি বাজিয়েছেন, এর মধ্যে পাঁচটিই ছিল তাঁর একক পরিবেশনা—তাঁরই প্রযোজনা। ব্যস্ত এ সময়ে থিয়েটারে জায়গা না পেয়ে অনেক সময় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের বড় কক্ষ অথবা রেস্টুরেন্টের বলরুমেও আয়োজিত হয়েছে তাঁর অনুষ্ঠান। যেখানেই হোক, বিপুলসংখ্যক শ্রোতা আবিষ্ট হয়েছে তাঁর মূর্ছনামাধুরীতে। যুগশ্রেষ্ঠ এক সংগীতজ্ঞের সৃষ্টিসুখ প্রত্যক্ষরূপে উপভোগের এই সুবর্ণ মুহূর্তের সাক্ষী হওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি হয় কেউ?
১৭৮৫-এর শেষ নাগাদ, মোৎসার্টের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভেনিশীয় সংগীতজ্ঞ ও কবি লরেঞ্জো দা পন্টের। দুজনে মিলে নির্মাণ করলেন ‘দ্য ম্যাজিক অব ফিগারো’ অপেরাটি। ভিয়েনা-প্রাগে এটি দুর্দান্ত সাফল্য পায়। এই সাফল্যের রেশ ধরেই পরপর এল তাঁদের দ্বিতীয় যৌথ নির্মাণ ‘দোন জিওভান্নি’। জটিল সূক্ষ্ম সাংগীতিক কুশলতার জন্য এ দুটো অপেরা কেবল মোৎসার্টের ক্যারিয়ারেই নয়, সমগ্র অপেরা রেপার্টরিতেই বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। নাটকীয় মুহূর্তকে উত্তুঙ্গ করে তুলতে সংগীতের অপূর্ব প্রয়োগ এগুলোকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে। এ পর্যায়ে মোৎসার্টের জীবনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ১৭৮৭-এর ডিসেম্বরে, সম্রাট দ্বিতীয় জোসেফের তাঁকে চেম্বার কম্পোজার হিসেবে নিয়োগদান।

১৭৮০-এর দশকের শেষভাগ থেকে মোৎসার্টের জীবনে যেন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। অস্ট্রিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত, যুদ্ধের ডামাডোলে সংগীত-শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকেরাও গুটিয়ে নিয়েছেন হাত। এ অবস্থায় মোৎসার্টের আয়-রোজগার গেল ভীষণ কমে। অবসাদ ও বিষণ্নতা চেপে ধরল তাঁকে। সংসারখরচ চালাতে বন্ধুদের কাছ থেকে বিস্তর ধারদেনা করলেন। ১৭৮৮-এর মধ্যভাগে ভিয়েনার আয়েশি জীবন ছেড়ে চলে এলেন কাছাকাছি এক উপশহরে। তবু মহান শিল্পীর সৃষ্টিশীলতা তো থেমে থাকার নয়! এ সময়েই রচিত হলো তাঁর শেষ তিনটি সিম্ফনি আর অপেরা ‘কোসি ফান তুত্তে’।

১৭৯০ সাল নাগাদ হাওয়া আবার ঘুরতে শুরু করল। অবসাদ ঝেড়ে ফেলে কাজে ডুবে গেলেন মোৎসার্ট। সৃষ্টি হলো অনবদ্য সব সুরঝংকার। ‘দ্য ম্যাজিক ফ্লুট’, বি ফ্ল্যাটে শেষ পিয়ানো কনসার্টো, এ মেজর-এ ক্ল্যারিনেট কনসার্টো মাতিয়ে দিল সংগীতামোদীদের। বিভিন্ন জায়গা থেকে বাজানোর ডাক পড়তে লাগল। অর্থসমাগম বাড়ায় ধারদেনাও শুধিয়ে ফেললেন।

তবে কে জানত, জীবন তাঁর তখনই শেষের সেদিনের ডাক শুনে ফেলেছে? ১৭৯১-এর শেষ নাগাদ মোৎসার্টের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হতে থাকে। এর মধ্যেও রাজকীয় আমন্ত্রণে গিয়েছিলেন প্রাগে। তবে নভেম্বর মাসে অসুস্থতা এমন চেপে ধরে যে মোৎসার্ট একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তবে কাজপাগল সুরের কারিগরকে থামাবে কে? এ অবস্থাতেও অসমাপ্ত রিক্যুয়েমের ভাবনা তাঁর চেতনাজুড়ে।

শেষ রক্ষা হলো না অবশ্য। ১৭৯১-এর ৫ ডিসেম্বর জীবনপ্রদীপ নির্বাপিত হলো বিশ্বসংগীতের এই অবিস্মরণীয় প্রতিভার। বয়স তখন মাত্রই ৩৫। তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে মতভিন্নতা আছে, তবে অফিশিয়াল রেকর্ড অনুসারে মিলিয়ারি ফিভারে মৃত্যু ঘটে মোৎসার্টের।

মোৎসার্টসৃষ্ট সুরসম্ভার বিশ্বসংগীতের এক চিরকালীন অমূল্য সম্পদ। মানবমনের নিগূঢ় ভাবপ্রকাশে সাবলীল অথচ জটিল সূক্ষ্ম কারুকার্যময় সুরের এমন ফল্গুধারা সে যুগে যেমন, তেমনি আজও বিমোহিত করে চলেছে সংগীতামোদীদের। বেটোফেন থেকে শুরু করে ভাগনার-চাইকভ্স্কিসহ উত্তরকালের প্রায় সব উল্লেখযোগ্য সংগীতকারকে প্রভাবিত করেছে তাঁর সৃষ্টি। চাইকভ্স্কি তাঁকে ডেকেছেন মিউজিক্যাল ক্রাইস্ট বলে। আর ভাগনার তাঁকে সর্বকালের সর্বসেরা শিল্পগুরু আখ্যা দিয়ে বলেছেন, ‘এক অসামান্য প্রতিভা মোৎসার্টকে নিয়ে গিয়েছিল সব শতক ও সব শিল্পের শিল্পগুরুদের ওপরে।’ সর্বকালের সেরা সংগীতজ্ঞদের তালিকায় তো ঢুকে পড়েছিলেন জীবদ্দশাতেই।

সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে মোৎসার্ট বিরাট প্রতিভাধর ব্যক্তি। কিন্তু কেবল প্রতিভাকেই পুঁজি করে নয়, বরং সফল হওয়ার স্বপ্ন দেখা আর সে স্বপ্ন পূরণে কঠোর অধ্যবসায় আর নিরলস পরিশ্রমকে হাতিয়ার করেই সামনে এগিয়েছেন তিনি। পর্যাপ্ত ও যথাযথ প্রশিক্ষণ আর একনিষ্ঠ অনুশীলন তাঁর পথচলাকে অনেকটাই মসৃণ করেছে। আর সবটা মিলে সম্ভব করেছে তাঁর আপাত ‘ছোট’ জীবনকে এত ‘বড়’ করে তুলতে। সে এত বড় যে যত দিন এই পৃথিবী থাকবে, বাজবে তাঁর সুরও।

মৃত্তিকা সহিতা: শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়