প্রেমিকা

বাকী অংশ

হ্যাঁ, মায়া। অন্য কোনো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। মায়া! মায়াই!

করুণা নয় তো? সতর্ক গলায় আমি বলে উঠলাম।

করুণা?—মিসেস রাহনুমা খানিক ভাবলেন, আরেকটা সিপ নিলেন মার্টিনির, ঠোঁট মুছলেন টিসু দিয়ে, তারপর পালটা প্রশ্ন করলেন, করুণা মানে দয়া তো?

আমি চুপ করে রইলাম।

তিনি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, দয়া নয়! দয়া যদি করতে হয় তো আমার নিজেকেই করতে হয়। বলতে হয়, রাহনুমা, তুই একটা ভিখিরি, তুই একটা স্বপ্নখোর টিন এজার! তোর কী নেই যে তুই এমন পাগলি হয়ে উঠেছিলি একটা কবির জন্যে! সে তোকে কী দিতে পারত!

আমি টের পাই, মিসেস রাহনুমার মগজে এখন নেশা কাজ করছে মার্টিনির। আমার সন্দেহ হতে লাগল যে আমার আসবার আগেই তিনি পান শুরু করে দিয়েছিলেন, নইলে—ভিখিরি!—একটা মার্টিনির দু-তিন চুমুকেই এমন সংলাপ তো তাঁর মুখ থেকে বেরুবার কথা নয়!

লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিসেস রাহনুমা বললেন, দয়া মায়া করুণা ফরুণা কিচ্ছু না! কবিকে বললাম, কই আমাকে বসতে বললেন না? তিনি বেসামাল হয়ে পড়লেন। বুঝেই পেলেন না কোথায় আমাকে বসাবেন। আমিও বুঝতে পারছিলাম, বসাবার মতো কোনো ব্যবস্থাই তাঁর নেই। তবু ঠেলে তাঁর ঘরে ঢুকলাম। তাঁর চৌকিতে বসলাম। ভাবতে পারেন, কী ময়লা চাদর-বালিশ! ওখানেই বসলাম। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। বললাম, আপনিও বসুন। ঘরে একটা টেবিল—বই-খাতা এক স্তূপ, হাতলছাড়া একটা চেয়ার। হাত তুলে ইঙ্গিত করেছিলাম আমার পাশে বসতে, কবি চেয়ারে বসলেন। দুঃখ পেলাম কি? জানি না। বললাম, কবিতা শোনাবেন প্লিজ একটা? তিনি সাগরে পড়ে গেলেন! বললেন, কবিতা! এমন গলায় বললেন, যেন কবিতা কী বস্তু, তিনি জানেনই না! বললাম, শোনান না একটা, যেটা সবশেষ লিখেছেন, এখনো ছাপতে দেননি, শোনান! তিনি তখন ত্রস্ত হাতে টেবিলের ওপর একটা খোলা খাতা বন্ধ করে একটা মোটা বইয়ের তলায় লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করলেন। আমি তো বুঝে ফেললাম ওটাই তাঁর কবিতা লেখার খাতা। উঠে গিয়ে খাতাটা তাঁর হাত থেকে কেড়ে নিলাম। কাড়তে গিয়ে তাঁর হাতের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল। এই সেই হাত! যে হাত দিয়ে অমন কবিতা! প্রেমের কবিতা! তাকিয়ে যে দেখছি তাঁর হাড়সর্বস্ব হাত, বুড়োটে আঙুল, বড় বড় নখ, নখের নিচে ময়লা—ওই যে আমার হাত থেকে খাতাটা কাড়তে গিয়ে তিনি প্রায় খামচেই দিলেন আমার হাত, যেন মানুষ নয় জন্তুর একটা নখ-নখর, আমি মেলাতে পারলাম না এ হাতের সঙ্গে তাঁর কবিতাকে। খাতাটা মেলে ধরতেই দেখি—কবিতা! নিচে সেদিনেরই তারিখ! লাইনটা এখনো মনে আছে—ভুলেই গেছি কবে তোমাকে বলেছিলাম—আসছি!

মিসেস রাহনুমা উঠে পড়লেন। ড্রয়িংরুমের মাঝখানে আধো দেয়াল রচনা করে আছে বইয়ের একটি লম্বা নিচু আলমারি। সারি সারি বই। চাবি ঘুরিয়ে আলমারিটা খুলে তিনি একটি পাতলা বই বের করলেন। দূর থেকেই মলাটটি আমাকে তুলে দেখালেন।

কবির নতুন বই। আর বইয়ের প্রথম কবিতাটিই সেই কবিতা।

আমার হাতে বইটি দিয়ে মিসেস রাহনুমা ড্রিংকসের ক্যাবিনেটের কাছে গেলেন, আরও খানিক মার্টিনি নিয়ে ফিরে এসে বসলেন আমার সমুখে। ততক্ষণে কবিতাটি আমার পড়া হয়ে গেছে।

পড়লেন?

হ্যাঁ পড়লাম।

কেমন লাগল?

মন্দ নয়।

ভ্রু কুঁচকে মিসেস রাহনুমা তিরস্কারের ভঙ্গিতে বললেন, মন্দ নয়! বলেন কী! অসাধারণ! আমি তো মনে করি অসাধারণ!

মনে মনে বললাম—না, ম্যাডাম, খুবই সাধারণ একটা কবিতা! কিন্তু মুখে উচ্চারণ করলাম না।

মিসেস রাহনুমা বললেন, আপনি কি কখনো এরকম হয় মনে করেন না, যে, কারও জন্যে আপনার এত ভালোবাসা যে জীবনে শুধু একমাত্র তাকেই ভালোবেসেছেন, তাকে পাননি, কিন্তু তারই দিকে এখনো প্রতিদিন একটু একটু করে এগোচ্ছেন?

আমি কবিতাটির চেয়ে মিসেস রাহনুমার কথাই ভাবছিলাম। তিনিও কি তবে কাউকে ভালোবেসেছিলেন? এমন কাউকে, যাকে তিনি পাননি, কিন্তু তারই দিকে মুখখানি তাঁর ফেরানো আছে আজও, তারই দিকে মনে মনে তাঁর একটু একটু করে প্রতিদিনই এগিয়ে যাওয়া?

চমক ভাঙল মিসেস রাহনুমার কথায়। তিনি বলে উঠলেন, আশাভঙ্গ!

প্রতিধ্বনি করে উঠলাম আমি, আশাভঙ্গ!

মনে হলো, তাঁর ব্যক্তিগত গোপন প্রেমের প্রসঙ্গেই কথাটা তিনি ভরলেন। সম্ভবত। উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে তাকালাম। হয়তো এর পরেই তিনি তাঁর গোপন কাহিনিটি বলবেন।

কিন্তু না! তিনি বললেন, জানেন, কবি আমাকে ভীষণ একটা আঘাত করেছেন। আমি বুঝতে পারছি না, কেন তিনি এমনটা করলেন?

কী করলেন?

আমি ওই দিন তাঁকে বলেছিলাম, আপনি বাসাটা বদল করুন। আমার একটা ছোট ফ্ল্যাট আছে সেগুনবাগানে। পড়েই আছে। খালি। একেবারে খালি। আমি আপনাকে সেখানে নিয়ে যেতে চাই। তিনি না-না করে উঠলেন। কয়েকবার বললাম, তিনি বললেন—না, এখানেই তাঁর মন বসে গেছে, এখানেই তিনি বেশ আছেন, এ জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তাঁর নেই। বললাম, ফর আ পোয়েট লাইক ইউ দিস ইজ নট ইয়োর প্লেস! এ পরিবেশ আপনার জন্যে নয়। বললেন, আমি এখানেই ভালো আছি। বললাম, ইউ উইল নট বি আ টেনান্ট। ইউ উইল বি মাই গেস্ট। আই উইল বি অনার্ড। আপনার ভাড়া দিতে হবে না। তিনি ঘাড় শক্ত করে রইলেন। বললাম, আমি আপনার কবিতার ফ্যান। তিনি মাটির দিকে মুখ নিচু করে বসে রইলেন। বললাম, কী? যাবেন সেগুনবাগানে? তিনি মাথা নাড়লেন। যখন দেখলাম তিনি কিছুতেই আমার দেওয়া ফ্ল্যাটে উঠবেন না, তখন আমি বিদায় নেবার সময় বললাম, আপনাকে তবে একটা মোবাইল দিতে পারি কি? আপনার তো মোবাইল নাই, ক্যান আই প্রেজেন্ট ইউ উইথ আ সেট? আমি আপনার কবিতা খুব ভালোবাসি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে। মোবাইল তো নেবেন?

মহিলার উপহার দেবার জেদ দেখে বিস্ময়ে আমি হালকা শিস দিয়ে উঠলাম।

মিসেস রাহনুমা আমার শিসটিকে উপেক্ষা করে বলে চললেন, কবি ঘাড় গোঁজ করে রইলেন। বুঝলাম, মোবাইলও তিনি নেবেন না। দেন আই ফেল্ট ভেরি ব্যাড। আমার খুব কষ্ট হলো তখন। ভেরি ডিজঅ্যাপয়েন্টেড আই ওয়াজ। এত পছন্দ করি যে কবিকে, কেন তিনি বুঝছেন না যে তাঁর জন্যে কিছু করতে পারলে আমার কত ভালো লাগবে। উপহার হিসেবেও কি কেউ কাউকে কিছু দিতে পারে না? ক্যান আই নট টু মাই ফেভারিট পোয়েট? গাড়ি পর্যন্ত তিনি আমাকে এগিয়ে দিলেন। বস্তির ভেতর দিয়ে নীরবে হাঁটতে হাঁটতে আমরা যখন গাড়ির কাছে, গাড়িতে বসতে বসতে কবিকে বললাম—আমি কিন্তু কিছু একটা আপনাকে দিতেই চাই। বেশ তো, আপনি মোবাইল নেবেন না, সেগুনবাগানেও যাবেন না, আমি আপনাকে একটা খাট আর বালিশ-চাদর, একটা সোফাসেট পাঠিয়ে দেব, না করতে পারবেন না কিন্তু। প্লিজ! সোফাসেটে আপনি না বসুন, আমি এসে তো মাঝে মাঝে বসতে পারব, গল্পটল্প করতে পারব! এই বলে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললাম ড্রাইভারকে কবিকে না বলবার কোনো সুযোগ না দিয়ে। একবার পেছন ফিরে দেখলাম—তিনি তখনো পথের ওপরেই দঁড়িয়ে আছেন! না, আমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে নয়, মাথা নিচু, মাটির দিকে চোখ। ইয়েস, তখনি আমার বোঝা উচিত ছিল।

আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা গড়িয়ে পড়ল, কী? কী বোঝা উচিত ছিল?

যে, এসবও তিনি নেবেন না। নেবেন না তো এমন এক কাণ্ড করবেন, যা আমি ভাবতেও পারিনি। বেয়োন্ড মাই ওয়াইলডেস্ট ড্রিম।

তার মানে?

মানে আর কী! আমার কেয়ারটেকার ট্রাকে করে খাট তোশক গদি বালিশ চাদর সোফাসেট নিয়ে সেই বস্তিতে গিয়ে দ্যাখে কবি সেখানে আর নেই।

নেই মানে?

লেফ্ট! চলে গেছেন! পরদিনই বস্তি ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন, কাউকে ঠিকানা দিয়ে যাননি! একেবারে রাতারাতি! কী কাণ্ড বলুন তো! যে বস্তিতে তাঁর মন বসে গেছে, যে বস্তি থেকে জীবনেও যিনি নড়তে চাননি, সেই বস্তি থেকে রাতারাতি উধাও হয়ে গেলেন? স্ট্রেঞ্জ!

আমাকে বলতেই হলো, বললাম, ম্যাডাম, আপনি যাকে বস্তি-বস্তি বলছেন, ওটা হয়তো আপনার কাছে বস্তিই মনে হয়েছে, আসলে হয়তো নয়, কম রোজগারি মানুষদের একটা পাড়া। গুলশানের তুলনায় বস্তি মনে হতে পারে, আসলে নিশ্চয় নয়, আই অ্যাম অলমোস্ট সার্টেন।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল, আমিও ঈষৎ তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ছিলাম, বললাম, এবার আমাকে না হয় আপনার ওই সুইট মার্টিনিই একটু দিন। জাস্ট আ ড্রপ! আহ, হোয়াট আ স্টোরি!

ইয়েস, হোয়াট আ স্টোরি। অ্যান্ড হাও ফুলিশ অব মি টু চেজ আ পোয়েট!

আমি বললাম, আপনি খামোকা উতলা হচ্ছেন। বরং আপনি—ইউ ডিজার্ভ মাই প্রেইজ যে আপনি বাংলা কবিতা পড়েন, কবিতা ভালোবাসেন।

মিসেস রাহনুমা টলোমলো গলায় গাঢ় উচ্চারণ করলেন, ইয়েস! আমি পড়ি! মনের ভেতরে একটা সান্ত্বনা পাই। সান্ত্বনা আনে কবি যে পৃথিবীতে এখনো ভালোবাসা আছে।

অ্যান্ড—বিচ্ছেদও আছে, না-পাওয়াও আছে!

আমি বুঝতে পারছি সুইট মার্টিনি আমার ভেতরে কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে।

অফকোর্স! না-পাওয়া! কত না-পাওয়া! টেল মি, কবিরা কি সব বানিয়ে লেখেন?

কবিকেই আপনার জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আমি তো আর কবি নই!

আমি একের পর এক পান করে চলি। বেয়ারা এসে কাবাব-সমুচা রাখে। আমি চিবিয়ে চলি। হাত বাড়িয়ে শূন্য পাত্রটা তুলে ধরে বলি, ক্যান আই হ্যাভ ওয়ান মোর?

তারপর কী হয়, পান করতে করতে আমার ভেতরে কবি রেজানুর হোসেনের সেই রংপুরের মাহীগঞ্জ জেগে ওঠে, জায়গিরবাড়ির সেই মেয়েটির ছবিও। হয়তো রাহনুমার সঙ্গে রহিমা নামের খানিক মিলটাও অবেচেতন মনে আমি দেখে উঠি একসময়। চমকে উঠি। আর তখনই আমি এই অনুমানে এসে পৌঁছোই—সেদিন মিসেস রাহনুমা চলে আসার পর রহিমার কথা কবিরও মনে পড়ে গিয়েছিল নিশ্চয়! অনুমান কেন, নিশ্চয় করেই আমার মনে হতে থাকে যে চোরের মার দ্বিতীয়বার খাবার ইচ্ছে আমাদের এ কবির ছিল না, তাই এবারও তিনি পালিয়েই গেলেন!