প্রতিবছর দেড় লাখ তরুণ করদাতা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি
>

• ৪০ বছরের নিচের করদাতারা তরুণ
• কর দেওয়ায় তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে
• বেশির ভাগই বেসরকারি চাকরিজীবী
• চার বছরে তরুণ করদাতা বেড়েছে ৬ লাখ

প্রতিবছর গড়ে দেড় লাখ তরুণ করদাতা কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিচ্ছেন। কেউ তরুণ উদ্যোক্তা, কেউ চাকরিজীবী। এভাবে গত চার বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ছয় লাখ আগ্রহী নতুন করদাতা পাওয়া গেছে। তাঁরা নতুন টিআইএন নিয়েছেন, কর দিতে চান। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কর দেওয়ার আগ্রহ বেড়েছে। রিটার্ন দিয়ে কর দেন এমন করদাতার সংখ্যাও কম নয়; বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। তাঁরা হলেন মোট করদাতার এক-চতুর্থাংশ। সেই হিসাবে এখন দেশে প্রায় চার লাখ তরুণ করদাতা আছেন।

চার বছর ধরে টিআইএন নেওয়ার প্রবণতাও বেশ বেড়েছে। ২০১৫ থেকে ২০১৮, অর্থাৎ গত চার বছরে টিআইএনধারী দ্বিগুণ হয়েছে। ওই সময়ে নতুন করে ১৮ লাখের বেশি ব্যক্তি টিআইএন নিয়েছেন। এই তরুণ-তরুণীদের বেশির ভাগই বেসরকারি চাকরি করেন, ছোটখাটো উদ্যোক্তা কিংবা তরুণ পেশাজীবী। গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেশে এখন টিআইএনধারী ৩৬ লাখ ৯০ হাজার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দায়িত্বশীল সূত্রগুলো থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে।

যেসব করদাতার বয়স ৪০ বছরের নিচে, তাঁদের তরুণ করদাতা হিসেবে মনে করে এনবিআর। প্রতিবছর রিটার্ন জমার মৌসুমে কর মেলার আয়োজন করে এনবিআর। এসব মেলায় অল্প বয়সী করদাতাদের ব্যাপক ভিড় দেখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তাঁরা কর বিবরণী জমা দেন।

এই বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, অপেক্ষাকৃত কম বয়সী উপার্জনক্ষম জনগোষ্ঠী কর দিতে আগ্রহী হচ্ছেন, এটা খুব ইতিবাচক লক্ষণ। কর দেওয়া না-দেওয়া শুধু আইনের বিষয় নয়, এটি অভ্যাসের বিষয়। কর না দেওয়ার একটি বহুদিনের অভ্যাস তৈরি হয়েছে। যেন কর না দেওয়াই নিয়ম। তাঁর মতে, তরুণ প্রজন্ম এখন আগের চেয়ে বেশি হারে কর্মবাজারে ঢুকছে, তারা পুরোনো অভ্যাস বদলে দিতে পারে, যেন ‘কর দেওয়াই স্বাভাবিক নিয়ম’। তরুণ প্রজন্ম কর দেওয়ায় আগ্রহী হওয়ার সুবিধা হলো তারা অনেক দিন পর্যন্ত উপার্জনক্ষম থাকবে, রাষ্ট্র কর পাবে। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘জনসংখ্যার বয়সকাঠামোয় যে সুবিধা আমরা পাচ্ছি, তাতে তরুণ শ্রমশক্তি বাজারে ঢুকেছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে তরুণদের কর দেওয়ার প্রবণতা ভালো লক্ষণ।’

তরুণ করদাতাদের করজালে আনতে গত দুই-তিন বছরে এনবিআর অবশ্য বেশ কিছু উদ্যোগও নিয়েছে। যেমন বেসরকারি চাকরিজীবীদের টিআইএন নেওয়া ও রিটার্ন জমা বাধ্যতামূলক করা; বিকাশ, রকেট, মুঠোফোনের ফ্লেক্সি লোডের এজেন্ট; পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ট্রেড লাইসেন্স নেওয়া; রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি প্রদানকারীসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা করলে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এসব কাজে সাধারণত তরুণদের আধিপত্য থাকে। এ ছাড়া নানা ধরনের স্টার্টআপ ব্যবসায় ঢুকছেন তাঁরা।

গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যে টিআইএন নেওয়া যেমন বেড়েছে, তেমনি রিটার্ন জমা দিয়ে কর দেওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। ৪-৫ বছর আগে মাত্র ৯-১০ লাখ করদাতা বছর শেষে আয়-ব্যয়ের বিবরণী জমা দিতেন। গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১৫ হাজার ৫৬ হাজার করদাতা আয়-ব্যয় বিবরণী জমা দিয়ে কর দিয়েছেন। তাঁরা সোয়া চার হাজার কোটি টাকা কর দিয়েছেন। গতবার রিটার্ন জমাকারীদের মধ্যে চার লাখই ছিলেন তরুণ করদাতা। অবশ্য তাঁদের তুলনামূলক আয় কম, তাই এনবিআরও কর কম পায়। এনবিআর বলছে, রিটার্ন জমায় যত কর পাওয়া যায়, এর ১০-১৫ শতাংশ আসে অল্প বয়সী করদাতাদের কাছ থেকে।

২০১৬ সাল থেকে প্রতিবছর তরুণ ও নতুন করদাতাদের সম্মাননা দিয়ে আসছে এনবিআর। এই দুই ক্যাটাগরিতেই তরুণেরা এই সম্মাননা পেয়েছেন।

এনবিআরের সদস্য জিয়া উদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, সেরা তরুণ করদাতা বাছাই করতে গিয়ে দেখা গেছে, যত লোক প্রতিবছর রিটার্ন জমা দিয়ে কর দেন, তাঁদের মধ্যে ২৫ শতাংশের বয়স ৪০ বছর পার হয়নি। তরুণেরা এখন কর দিতে বেশ আগ্রহী। তাঁদের কাছে খুব বেশি কর পাওয়া যায় না, কিন্তু তাঁদের মধ্যে কর দেওয়ার অভ্যাস গড়ে উঠছে। এনবিআরের জন্য তাঁরা ভবিষ্যতের সম্পদ হয়ে যাচ্ছেন। 

তরুণেরা কী বলেন
কয়েক বন্ধু মিলে তিন বছর আগে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরে গবাদিপশুর খামার তৈরি করেছেন। নাম ‘আমাদের খামার’। এই খামারের ব্যবস্থাপনা অংশীদার আরিফুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, তরুণদের পক্ষে একটি ব্যবসা শুরু করার মতো পর্যাপ্ত মূলধন থাকে না। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে টিআইএন লাগে বা কর নথি হালনাগাদ থাকতে হয়। এসব কারণে তরুণ উদ্যোক্তারা করের বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। এ ছাড়া তরুণেরা কর দিতে চান। কর দেওয়ার প্রক্রিয়া আরও সহজ করা উচিত।

২০১৪ সাল থেকে আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা শুরু করেন উষা ট্রেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুলতান মাহমুদ। এখন বয়স ৩৬ বছর। তিনি ২০১৬ সালে সেরা নতুন করদাতা হিসেবে এনবিআরের সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কর দেওয়া নিয়ে আগে ভয় ছিল। এখন সেই ভয় অনেকটাই কেটে গেছে। কর দিতে তেমন কোনো ঝামেলা হয় না। দেশের উন্নয়নে অংশীদার হতেই আমরা কর দিই।’

রাজধানীর খিলগাঁও কাবাব এক্সপ্রেস নামে একটি রেস্তোরাঁর মালিক ফেরদৌসী লতা। তিনি বলেন, এখন টিআইএন ছাড়া কোনোভাবেই ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এনবিআরের আগের সেই ‘ধর-মার’ দৃষ্টিভঙ্গিও নেই। এখনকার তরুণেরা কর ফাঁকি দিতে চান না, কর দিতে চান। এর বিনিময়ে ব্যবসার ভালো পরিবেশ চান তাঁরা। 

আয়ের সুযোগ কতটা
দেশের তরুণদের আয় করার সুযোগটি কেমন। ২০১২ সাল থেকে বাংলাদেশ জনসংখ্যা বোনাসের যুগে প্রবেশ করেছে। জনসংখ্যা বোনাসের সময় কর্মক্ষম মানুষ (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) সবচেয়ে বেশি থাকে। অর্থনীতিতে এই সুবিধা থাকে অন্তত দুই দশক। কর্মবাজারে এ দেশের তরুণ প্রজন্ম নেতৃত্ব দিচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের শ্রমশক্তির আকার বা কাজ করতে সক্ষম মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৩৪ লাখ। এর মধ্যে কাজ করেন ৬ কোটি ৮ লাখ। এসব কর্মজীবী মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বেশি, অর্থাৎ ৩ কোটি ৫১ হাজার জনের বয়স ৪০ বছর পার হয়নি। তাঁরা বেকার নন, উপার্জন করেন। বিবিএস তরুণ শ্রমশক্তি হিসেবে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ধরে থাকে। এই বয়সীদের সংখ্যাও কম নয়, ১ কোটি ৮০ লাখ।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে তরুণ করদাতা বাড়ছেন, এটি খুবই ভালো খবর। এটি অব্যাহত রাখতে হবে। তরুণদের কর দিতে উৎসাহিত করতে তাঁদের জন্য প্রণোদনা থাকা উচিত। একদম নতুন করদাতাদের জন্য প্রথম দুই-তিন বছর কিছুটা কর রেয়াত দেওয়া যেতে পারে। এতে তাঁরা উৎসাহিত হবেন, কর দেওয়ার অভ্যাসও গড়ে উঠবে।