আলোকচিত্রে আমার স্বর

ছবি: দীপু মালাকার
ছবি: দীপু মালাকার

ফটোগ্রাফি আমার কণ্ঠস্বর। যে বাস্তবতা আমাকে আলোড়িত করে, তা প্রকাশ করার ভাষা। আলোকচিত্র, লেখা, বিকল্প ধারার ছাপা—এসব বহুবিচিত্র মাধ্যমে কাজ করতে আমি পছন্দ করি। সমাজের কাঠামো নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা থাকে আমার কাজে; শ্রেণীকরণের প্রতি আমার বিশেষ আগ্রহ।

ফটোগ্রাফি শুরু করার পর থেকেই আমি আমার নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেতে চেয়েছি। সময়ের ব্যবধানে আমার এই যাত্রা নানা বাঁক ধরে এগিয়েছে। ফটোগ্রাফির মধ্যে আমি নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছি তখন, যখন আবিষ্কার করেছি, আমার সমাজকর্মী মা তাঁর বিশ্বাসের পথে চলতে চেষ্টা করছেন সমাজকর্মের মধ্য দিয়ে। আমি কাজ শুরু করি বাংলাদেশের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের নিয়ে। আমার প্রতিটি কাজে এই মানুষদের সম্পর্কে মূল ধারার দৃষ্টিকোণকে আমি চ্যালেঞ্জ করি।
আমার জন্ম নাটোরে, ১৯৮৯ সালে। এক বছর বয়সে বাবাকে হারিয়েছি, শৈশবেই হারিয়েছি ভাইকে। আমার গৃহিণী মায়ের পক্ষে আমাকে ও আমার বোনকে লালন–পালন করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। দেশের নানা জায়গায় আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমাকে থাকতে হয়েছে। নাটোরে আমার শৈশবে নানিমার ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই কথা বলা যায় বড় মামা ও মামির সম্পর্কে।
সব সময়ই মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। নিজের পরিবার ছাড়া শৈশব কাটানো বেশ কঠিন, কিন্তু আমি আমার অভিজ্ঞতাগুলো ব্যাখ্যা করতে চাই ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে। আমি যেসব শহরে যেসব পরিবারের সঙ্গে থেকেছি, সেগুলোর প্রতিটিই একটি করে ছোট ছোট গল্প। আমি সৌভাগ্যবান যে এক জীবনেই অনেকগুলো জীবনের স্বাদ পেয়েছি। আমার মনে হয়, ফটোগ্রাফির মধ্য দিয়ে গল্প বলার ক্ষেত্রে আমার এসব অভিজ্ঞতার গভীর প্রভাব পড়েছে। ছেলেবেলা থেকেই আমি এগুলোকে নিজের গল্প বলে অনুভব করতে শিখেছি। এখনো শিখছি আমি।

>আশফিকা রহমান 
২০১৬: ঢাকায় মসলিন উৎসব।
২০১৭: জার্মানির হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত ক্রস রোড উৎসব।
২০১৮: ঢাকা আর্ট সামিট, ইন্ডিয়ান ফটো ফেস্টিভ্যাল, জার্মানির লুমিক্স ফেস্টিভ্যাল, দিল্লির আকারপ্রকার গ্যালারি।
২০১৮: ওয়ার্ল্ড প্রেস অর্গানাইজেশনের জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাস
 হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি আর্ট রিসার্চ ফেলোশিপ, ২০১৯

আমি ফিন্যান্স বিষয়ে বিবিএ করেছি, ব্যাংকে চাকরি করেছি। কিন্তু আমি যা করতে চেয়েছি, তা এসব নয়। আমি সাড়া দিয়েছি আমার অন্তরের ডাকে।
ঢাকার ‘পাঠশালা’ নামের শিক্ষায়তনে ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করেছি; ফটোসাংবাদিকতা পড়েছি জার্মানির হ্যানোভারে ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স অ্যান্ড আর্টসে । এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আমি জটিল দৃশ্যগল্প বলার ক্ষেত্রে ভিন্ন রকমের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনের স্টুডিও গপ্পো–তে উনিশ শতকের ভারতে ফটোগ্রাফি চর্চা নিয়ে গবেষণা করার সময় লক্ষ করেছি, যে দিকটাতেই কাজ করি না কেন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই আগের ধাপের সঙ্গে পরের ধাপের টানাপোড়েন সৃষ্টি হচ্ছে।
তারপর থেকে অবচেতনভাবে আরও বিচিত্র নান্দনিক কৌশলের মিশ্রণে অপ্রত্যাশিত রকমের গল্প সৃষ্টির ঝোঁক শুরু হয়। সে জন্য আমাকে মাধ্যম প্রসারিত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, তথাকথিত রীতিগুলো ভাঙতে হয়। এভাবেই আমি নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে পাই।
আমি মনে করি, জীবন হলো সময়কে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাপন করা। ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভেতর দিয়ে আমার সেই যাপন ঘটেছে। এই যাত্রার একটা অংশ হলো সংগ্রাম এবং কিছু অর্জন, যেমন ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস অর্গানাইজেশনের জুপ সোয়ার্ট মাস্টারক্লাসের জন্য মনোনীত হওয়া; একই বছরে সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড ও আইপিএর আর্ট ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্যায়ে অংশগ্রহণ; ২০১৯ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি আর্ট রিসার্চ ফেলোশিপের চূড়ান্ত তালিকায় মনোনয়ন। আমার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে অনেকগুলো দেশি–বিদেশি প্রদর্শনী ও উৎসবে: ২০১৬ সালে ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত মসলিন উৎসব, ২০১৭ সালে জার্মানির হ্যানোভারে অনুষ্ঠিত ‘ক্রস রোড’ উৎসব এবং ২০১৮ সালে ঢাকা আর্ট সামিট, ইন্ডিয়ান ফটো ফেস্টিভ্যাল, জার্মানির লুমিক্স ফেস্টিভ্যাল ও দিল্লির আকারপ্রকার গ্যালারিতে।
বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি আন্তর্জাতিকভাবে একটা মর্যাদাসম্পন্ন জায়গা অর্জন করেছে। আমরা আমাদের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছি। আমি বিশ্বাস করি, ফটোগ্রাফির সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের অন্য মাধ্যমগুলোরও উন্নতি হচ্ছে। এমন একটা সময় আসবে, যখন বিশ্ববাসী বাংলাদেশকে চিনবে এর শিল্পসংস্কৃতির গুণে, হাজারো সমস্যা আর দূষণের কারণে নয়।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

 আশফিকা রহমান আলোকচিত্রী