আফসানার নকশায় দেশি ঐতিহ্য

আফসানা ফেরদৌসী। ছবি: কবির হোসেন
আফসানা ফেরদৌসী। ছবি: কবির হোসেন

ফ্যাশন ডিজাইনার আফসানা ফেরদৌসী জানতেন না তাঁর ভেতরে কী প্রতিভা লুকিয়ে ছিল। অনেকের মতো তিনিও ভাবতেন, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবেন। তারপর ভেবেছিলেন, ওসবের কিছুই হবেন না, হবেন সুখী গৃহিণী।

কিন্তু ঢাকার বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজিতে স্নাতক পর্যায়ে পড়ার সময় লাইব্রেরিতে বইপত্রের পাতা ওলটাতে ওলটাতে তাঁর মনের পটে নানা রকমের পোশাকের নকশা রূপ নিতে শুরু করে। তিনি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন, তিনি যেসব পোশাকের নকশা করবেন, সেগুলো শোভা পাবে বিদেশি মডেলদের শরীরে।
২০১০ সালে আসে প্রথম সুযোগ। সে বছর ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের আয়োজিত ‘ইউরো–বাংলা ফিউশন ফ্যাশন শো’তে অংশ নেন তিনি। জীবনে প্রথমবারের মতো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েই পেয়ে যান প্রথম পুরস্কার। ওই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী। আর অংশগ্রহণকারী মডেলদের সবাই ছিলেন স্প্যানিশ।
এই সাফল্যের মধ্য দিয়ে আফসানা নিজেকে আবিষ্কার করেন। বুঝতে পারেন, ফ্যাশনের জগৎই তাঁর সৃজনক্ষমতা কাজে লাগানোর সঠিক ক্ষেত্র।
তারপর থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের জগতে আফসানার স্বচ্ছন্দ বিচরণ শুরু হয়। ২০১১ সালে অংশ নেন হংকংয়ে এসডিসি ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ডিজাইন কমপিটিশনে। এ পর্যন্ত তিনি ১৫টির বেশি দেশি ও আন্তর্জাতিক ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণ করেছেন। দিনে দিনে তাঁর ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে, নিজের সংস্কৃতির প্রতি মনোযোগ বেড়েছে। তিনি বাংলাদেশে খাদি উৎসবের তিনটি আয়োজনেই চমক সৃষ্টি করেছেন। শীতলপাটি, তারা মসজিদ ও পটচিত্রের মতো ঐতিহ্য পোশাকে তুলে ধরেছিলেন নিপুণভাবে।

>আফসানা ফেরদৌসী
 জীবনের প্রথম প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন।
 পোশাকের নকশায় তুলে ধরেন দেশি ঐতিহ্য
 পরিবেশদূষণ রোধের কথা বলেন
 পোশাক কারিগরদের মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার

এ বছর অংশগ্রহণ করেছেন মেক্সিকো ফ্যাশন শোতে। হংকংয়ে অনুষ্ঠিত সোসাইটি অব ডাইয়ারস অ্যান্ড কালারিস্ট ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ডিজাইন কমপিটিশন, বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক লন্ডন, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত লোকাল ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ অ্যাপারেল অ্যান্ড টেক্সটাইল এক্সপোজিশন ইত্যাদি ফ্যাশন শোতে তাঁর করা পোশাকের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন বিভিন্ন সামাজিক বক্তব্য। পোশাকের নকশায় কখনো বলেছেন পৃথিবীকে দূষণমুক্ত করার কথা, কখনো লিখেছেন মাদকের বিরুদ্ধে উক্তি। একধরনের নৈতিক দায়বোধ লক্ষ করা যায় তাঁর পোশাকের নকশায়: একদিকে দেশি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরা, অন্যদিকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশের বিপর্যয় রোধ করার জন্য সচেতনতা সৃষ্টি করা। নিজের কাজ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি নৈতিক ডিজাইনার ও ফ্যাশন অ্যাকটিভিস্ট। মানুষের জন্য কল্যাণকর, পরিবেশবান্ধব উপায়েই কাজ করে যাব আজীবন।’ তিনি আরও বলেন, পোশাকে যদি দেশের নকশা তুলে ধরা না হয়, তাহলে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে এগোনো সম্ভব নয়।
আফসানা ফেরদৌসী ২০১২ সাল থেকে টিম সোর্সিং কোম্পানি লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ডিজাইন ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশের একজন কাউন্সিল মেম্বার। ২০১৬ সালে সোসাইটি অব ডাইয়ারস অ্যান্ড কালারিস্ট নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগ দেন বাংলাদেশের কান্ট্রি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে । চলতি বছর যুক্তরাজ্যে যে প্রতিযোগিতা হবে, সেখানে তিনি থাকবেন বিচারক হিসেবে।
আফসানা ফেরদৌসীর নিজের ব্র্যান্ড আছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে ফ্যাশনের সম্ভাবনা অনেক। তিনি প্রথম আলোকে বলে, ‘আমাদের দেশের নারীদের মতো সেলাইয়ের নিপুণতা অনেক দেশে নেই। বিদেশিরা নিপুণ কাজ করিয়ে নিয়ে যায় আমাদের গ্রামীণ নারীদের কাছ থেকে।’ দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বলেন, লন্ডনের পিপল ট্রি, কোরিয়ার ব্র্যান্ড গুরু বাংলাদেশ থেকে পণ্য তৈরি করে নিয়ে যায়। তিনি মনে করেন, যাঁরা স্থানীয়ভাবে কাজ করছেন, তাঁরা কারিগরদের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন না। মজুরিও খুব কম। এখানে সরকারের বড় ভূমিকা প্রয়োজন।
আফসানার অনেক পরিকল্পনার একটি হলো বাংলাদেশের ফ্যাশনের ইতিহাস নিয়ে বই লেখা।

 রয়া মুনতাসীর প্রথম আলোর সহসম্পাদক