হাসি ফেরাতে মানুষের পাশে

ছোট্ট তাহেদুল জন্ম থেকেই ছিল ঠোঁটকাটা। অপারেশন ক্লেফটের মাধ্যমে বিনা মূলে্য অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে হাসি ফিরে পায়।  সংগৃহীত
ছোট্ট তাহেদুল জন্ম থেকেই ছিল ঠোঁটকাটা। অপারেশন ক্লেফটের মাধ্যমে বিনা মূলে্য অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে হাসি ফিরে পায়। সংগৃহীত

বছর পঁচিশের তরুণ। কখনো দম ফাটানো হাসি, কখনো গান—মঞ্চে তাঁর উপস্থিতি মানেই সারাক্ষণ সরব মিলনায়তন। কথার পিঠে কথায় দর্শক মাতিয়ে রাখতে জুড়ি নেই তাঁর। আবার মঞ্চের বাইরে মানুষের মুখের হাসি ফিরিয়ে দিতে তাঁর নিরন্তর চেষ্টা। আরও খোলাসা করলে ঠোঁটকাটা রোগীদের বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার করিয়ে দেন তিনি।

সেই তরুণটি আমাদের চেনা মুখ কমর উদ্দিন আরমান। পরিচয় আরও বিস্তৃত করলে ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল জি বাংলার মীরাক্কেল সিজন ৯–এর দ্বিতীয় রানারআপ।
শিল্পী আরমানের এ এক অন্য জগৎ। বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচারে ঠোঁট ও তালু কাটা রোগীদের চিকিৎসা দেয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। কিন্তু কজনই জানেন এই বিষয়টি। কেউ ধরে নেন নিয়তি, কেউ চিকিৎসা খরচের ভয়ে গুটিয়ে রাখেন সন্তানকে। অথচ ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার বদলে দিতে পারে সব। মানুষের কাছে সেই বার্তা পৌঁছানোর কাজ করেন আরমান। তাঁর ভাষায়, ‘কৌতুক করা আমার পেশা। এটা করি মনের টানে।’
আরমান একসময় কাজ করেছেন চট্টগ্রাম নগরের লায়ন মোখলেছুর রহমান ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। ফাউন্ডেশন পরিচালিত ২০ শয্যার হাসপাতালে রোগীদের অস্ত্রোপচার করাতেন। এখন কাজ করছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অপারেশন ক্লেফটের স্মাইল পার্টনার হিসেবে। এই প্রতিষ্ঠান এখন সারা দেশে ক্যাম্পের মাধ্যমে কাজ করছে।
আরমান বলেন, ‘এখন আর আগের মতো নিজে সরাসরি অস্ত্রোপচারের সময় থাকতে পারি না। তবে সমন্বয় করি। কাজ করি মাধ্যম হিসেবে। কারণ মীরাক্কেলের কারণে আমার পরিচিতিটা এখন বেশি। সেটাই কাজে লাগাই।’
সেই গল্পটা এ রকম—২০১৫ সালে মীরাক্কেলের সিজন ৯–এর প্রথম পর্বে আরমানের পরিবেশনার পর কৌতুকের হাস্যরসের অনুষ্ঠানটি হয়ে পড়ে গুরুগম্ভীর। নিজেই জানান তাঁর কাজ সম্পর্কে। আরমান বলেন, ‘আমি দুভাবে মানুষ হাসাই। একটি কৌতুক বলে, অন্যটি ঠোঁট ও তালু কাটা রোগীদের হাসি ফিরিয়ে দিয়ে।’
সবাই জানার পর আরমানের ফেসবুক পেজে আসতে থাকে ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীদের খবর। এসব তথ্য ও ঠিকানা তিনি পাঠিয়ে দেন যথাযথ কর্তৃপক্ষের কার্যালয়ে। প্রতিযোগিতায় থাকা অবস্থায়ও অনেকের অস্ত্রোপচার হয়েছে আরমানের মাধ্যমে।

কমর উদ্দিন আরমান। সংগৃহীত
কমর উদ্দিন আরমান। সংগৃহীত

মীরাক্কেল থেকে আসার পর তো অবস্থা বদলে গেল। এখন বললেই মানুষ তাঁর কথায় সায় দেন। যেখানেই কোনো অনুষ্ঠান করতে যান সেখানে মানুষকে বিনা মূল্যে হাসি ফিরিয়ে দেওয়ার এ খবর পৌঁছে দেন। আরমান বলেন, ‘এখন আমার কাজের সুবিধা হয়েছে বেশি। ঘড়ি ধরে অফিস না করলেও ফেসবুকে সব সময় সক্রিয়। এর মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছি তথ্য।’
হাসির বার্তাবাহক হিসেবে আরমানের পথচলা শুরু ২০১০ সালে। লিও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এই ফাউন্ডেশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক চিকিৎসক শামীম খানের আগ্রহে কাজ শুরু। আরমান বলেন, ‘২০১৫ সাল পর্যন্ত কাজের জন্য সম্মানী পেতাম। সেই সম্মানী আমারও দরকার ছিল। চট্টগ্রাম শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ চলত ওই টাকায়। এরপর মীরাক্কেলের থাকা অবস্থায় সাত মাস মতো সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। এখন আবার আছি। তবে এখন আমি স্বাবলম্বী, তাই বিনা মূল্যে করছি কাজ।’
আরমানের কাছে অন্য রকম ভালো লাগার জায়গা এটি। বললেন, ছোট্ট একটি তথ্য দিয়ে একটি মানুষের সারা জীবনের হাসি ফেরাতে পারার আনন্দ সব সময়ের প্রেরণা। তাঁদের হাত ধরে এ পর্যন্ত অস্ত্রোপচার হয়েছে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার ঠোঁট ও তালুকাটা রোগীর। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ শিশু।

তাহেদুলদের হাসি ফেরানোর গল্প
ঘটনাটা চলতি বছরে ছয়-সাত মাস আগের। একদিন আরমানের ফেসবুকে দুবাইপ্রবাসী শ্রমিকের আর্তি। তাঁর নাম হারুন মিয়া। বাড়ি ফেনীতে। তাঁর প্রথম সন্তান তাহেদুল আলম জন্ম থেকেই ঠোঁটকাটা। আরমান সব জেনে ব্যবস্থা নেন। ঢাকার একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করিয়ে দেন। অবশেষে সুস্থ অবিকৃত সুন্দর হয়ে হাসি ফিরে পেল ছোট্ট তাহেদুল। তার অস্ত্রোপচার হয় অপারেশন ক্লেফটের মাধ্যমে।
গত বছরের (২০১৭) শেষের দিকে একদিন ছোট্ট শ্রাবণীর খোঁজ পান আরমানদের একজন কর্মী। চট্টগ্রাম নগরের চকবাজারে টেম্পোতে দেখা। দাদির সঙ্গে এক আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ওই স্বেচ্ছাসেবক ফোন নম্বর নিল। পরে খোঁজ শুরু করেন আরমান। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার বানীগ্রামে তাঁদের বাড়ি। বাবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। মেয়ে ঠোঁটকাটার যে চিকিৎসা করাবেন সেই সামর্থ্য নেই। আরমান বিনা মূল্যে অস্ত্রোপচার করে সুস্থ হওয়ার কথা বললে প্রথমে তাঁদের বিশ্বাস করাতে কষ্ট হয়। পরে বুঝিয়ে নিয়ে আসা হয় হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর এক সপ্তাহের মধ্যে সুস্থ হয় শ্রাবণী। হাসপাতাল ছাড়ার দিন সেকি হাসি তার মায়ের।
অন্যদিকে মোস্তাকের গল্পটা আরও করুণ। ১২ বছরের মোস্তাক জন্মান্ধ। তার ওপর ঠোঁটকাটা। তবে সে ভালো গান করে। আরমানকে ফেসবুকের মেসেঞ্জারে মোস্তাকের গানের ভিডিও দেয় কেউ একজন। শুরু করেন খোঁজ। অবশেষে দেখা পান মোস্তাকের। কুড়িগ্রামের নুনখাওয়া ইউনিয়নে তার বাড়ি। আরমান ছুটে যান। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মোস্তাকের সঙ্গে সাক্ষাৎ। কুড়িগ্রামে তার বাড়িতে গিয়ে আরমান দেখেন খুবই দরিদ্র তারা। বাবা দিনমজুর। তিন বেলা খাবার জোটাতে হিমশিম অবস্থা। আরমান পরিবারটির সঙ্গে এক দিন কাটান। মোস্তাককে সঙ্গে করে চট্টগ্রামে এনে অস্ত্রোপচার করাবেন। কিন্তু মোস্তাকের যে শারীরিক অবস্থা তাতে তাকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আনা অসম্ভব। শেষে বের করলেন উপায়—সেখানে যারা কাজ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অপারেশন ক্লেফটের মাধ্যমে তার অস্ত্রোপচার করিয়ে দেন আরমান। এখন ঠোঁটকাটা সেরেছে।
অপারেশন ক্লেফটের কান্ট্রি ম্যানেজার মইনুল ইসলাম বলেন, ‘ঠোঁট ও তালুকাটা চিকিৎসায় আমাদের দেশে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হলো তথ্যের অপ্রতুলতা। অনেক রোগী জানে না কবে, কোথায় তার চিকিৎসা করাতে হবে। আরমান যেমন গানপাগল, কমেডি পাগল, তেমনি তাঁর মন পড়ে থাকে এসব অবহেলিত ঠোঁটকাটা, তালুকাটা রোগীদের চিকিৎসার জন্য। আরমান তাঁর পরিসর থেকে এসব অবহেলিত বাচ্চাদের জন্য যা করছেন, তা প্রশংসনীয়।’

আরও কিছু
জীবন বাঁচাতে স্বেচ্ছায় রক্ত দেন আরমান। এ পর্যন্ত ৩৮ বার রক্ত দিয়েছেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়ায়। তিনি তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেন রক্তদানে। এ জন্য প্রতি মাসে সেখানে ক্যাম্প করেন। সময় পেলেই ছুটে আসেন বাড়িতে। আরমানের গানের গলাও বেশ। নিজের গানের অ্যালবামের কাজ চলছে।
আরমান বলেন, ‘মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকতে চাই। এ জন্য সবার মুখে হাসি ফোটাতে আমার নিরন্তর চেষ্টা।’