স্বাস্থ্যবান্ধব ভবনের স্বপ্ন

সজল চৌধুরী।  প্রথম আলো
সজল চৌধুরী। প্রথম আলো

ভবনের নকশা করার সময় বসবাসকারীদের স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রাখতেই হয় স্থপতিদের। তবে স্বাস্থ্যসম্মত বা স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত ভবনের ধারণা অনেকটাই নতুন। কোনো নির্দিষ্ট ভবনের বাসিন্দাদের কতটুকু স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে, স্থপতিরা ইদানীং সে বিষয়েও ভাবছেন।

সজল চৌধুরী এ দেশের হাতে গোনা স্থপতিদের একজন, যাঁর গবেষণার বিষয় ভবন ও এর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্পর্ক নিরূপণ করা। চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক দেশের তৈরি পোশাক কারখানাকে তাঁর গবেষণার বিষয় করেছেন। কারখানার ভবনের সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয় নিয়ে গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৬ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব বিল্ডিং সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার্সের(সিআইবিএসই) বর্ষসেরা স্থপতির স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তিনি এই স্বীকৃতি পান। এর আগের বছরগুলোতে এই পুরস্কার পেয়েছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের মতো নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।

কোনো ভবনের বাসিন্দাদের কতটুকু স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে, সেটা পরিমাপের কৌশল জানতে সজল চৌধুরী ব্যবহার করেছেন অত্যাধুনিক বিল্ডিং সিমুলেশন টুলস সফটওয়্যার। বিশেষ এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভবনের স্থান, অবস্থা, অভ্যন্তরীণ পরিবেশ, বাসিন্দাদের সংখ্যাসহ আরও নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে বলে দেওয়া সম্ভব ভবনটির বাসিন্দাদের কতটুকু স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। কেবল তা–ই নয়, কোনো নতুন ভবনের নকশা করার সময়ও এই সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভবনকে অনেক বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত করা যাবে। সজল তাঁর গবেষণার জন্য বাংলাদেশের ২০ থেকে ২২টি তৈরি পোশাক কারখানা বেছে নিয়েছেন।

সজলের গবেষণায় দেখা গেছে, কারখানা ভবনের নকশার সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্পর্ক আছে। মানবদেহের গড় তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে কারখানার ভেতরের তাপমাত্রা প্রায়ই এর চেয়ে বেশি হয়। তাপমাত্রার এই তারতম্যের কারণে শ্রমিকেরা ক্লান্তি, অবসাদ, জ্বর, হিট স্ট্রোক, কিডনি ও চর্মরোগের মতো নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে সামগ্রিক উৎপাদনেও এর প্রভাব পড়ে।
গবেষণায় সজল দেখিয়েছেন, কারখানার নকশায় পরিবর্তন আনলে সহজেই এই সমস্যার সমাধান করা যায়। নকশা পরিবর্তনের কারণে ভবনটি কেবল স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্তই হয় না, জ্বালানি সাশ্রয়ীও হয়। সজল চৌধুরী স্বপ্ন দেখেন, অদূরভবিষ্যতে দেশে এমন স্বাস্থ্যঝুঁকিমুক্ত কারখানা ও ভবন তৈরি হবে।
সজল চৌধুরীর জন্ম সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়। ছোটবেলা থেকেই বাবা বিমলেশ চৌধুরীর কাছ থেকে আঁকাআঁকি আর লেখালেখিতে হাতেখড়ি তাঁর। মফস্বলের কলেজের পাট চুকিয়ে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে। ছাত্র অবস্থায় একসময় সংবাদমাধ্যমে কার্টুন আঁকতেন শখের বসে। তারপর এক–আধটু স্থাপত্য নিয়ে লেখা। দেশের প্রধান দৈনিকগুলোতে নগরায়ণ ও স্থাপত্য নিয়ে নিয়মিত লেখেন তিনি। পাশাপাশি তাঁর গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছে এলসেভিয়র জার্নালের মতো খ্যাতনামা গবেষণা পত্রিকায়।

সজল চৌধুরীর নকশায় স্বাস্থ্যবান্ধব ভবন।  সংগৃহীত
সজল চৌধুরীর নকশায় স্বাস্থ্যবান্ধব ভবন। সংগৃহীত

সজলের এই গবেষণার অনুপ্রেরণা তাঁর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়( বুয়েট)। বুয়েটে তাঁর ব্যাচেলর যেদিন শেষ হলো, সেদিনই স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষকেরা তাঁকে সদ্য গঠিত গ্রিন আর্কিটেকচার সেলের হয়ে বাংলাদেশের সবুজ গার্মেন্টস কারখানা নিয়ে গবেষণা করার প্রস্তাব দিলেন। ২০০৯ সাল থেকেই স্থাপত্য বিভাগের গ্রিন আর্কিটেকচার সেলের একজন গবেষক স্থপতি হিসেবে কাজ করছেন তিনি। অল্প দিনের মধ্যেই তাঁরা বাংলাদেশের জন্য সবুজ গার্মেন্টস কারখানার পরিবেশগত নকশা কেমন হবে, সেটির একটি নীতিমালা প্রাথমিকভাবে প্রণয়ন করেন। চলতে থাকে সবুজ স্থাপত্যের ওপর গবেষণা। ২০১০ সালে তিনি যোগ দেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের একজন প্রভাষক হিসেবে। সজল বর্তমানে চুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং সেই সঙ্গে পরিবেশ ও স্থাপত্য–বিষয়ক গবেষক ও সমন্বয়ক।
শিক্ষকতায় থাকাকালেই বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগে শেষ করেন মাস্টার্স পর্ব। বিষয় ছিল বাংলাদেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলোর ভেতরে কীভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, যাতে একজন গার্মেন্টস কর্মী সুস্থ-স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে সক্ষম হবেন। বুয়েটের মাস্টার্স শেষ হওয়ার এক মাসের মাথায় জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে চলে যান হোক্কাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ের ওপর আরও গভীরে কাজ করার জন্য শিক্ষাছুটি নিয়ে। শুরু হয় তাঁর দ্বিতীয় মাস্টার্স পর্ব। সেখানে তিনি উন্নত গবেষণাগারে বিল্ডিং সিমুলেশন টুলস ব্যবহার করে একের পর এক গবেষণা চালাতে থাকেন। আর এই জটিল বিষয়ে স্থাপত্য গবেষণায় নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য ২০১৬ সালে দ্য চার্টার্ড ইনস্টিটিউট অব বিল্ডিং সার্ভিস ইঞ্জিনিয়ার্সের (সিআইবিএসই) বর্ষসেরা স্থপতি হন তিনি।
পিএইচডি গবেষণার জন্য জাপান সরকার তিন বছরের জন্য বৃত্তি দিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে আসেন, চুয়েটে যোগ দিয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। নিজেই নতুন কিছু গবেষণায় হাত দেন, যা এখনো চলমান। বর্তমানে তাঁর হাতে রয়েছে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণার প্রস্তাব।
সজল এমন একদিনের অপেক্ষায় আছেন, যখন ভবন অনুমোদন দেওয়ার সময় নগর কর্তৃপক্ষ বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির বিষয়টিও বিবেচনায় আনবেন। এটি করা গেলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়াও জ্বালানি বা বিদ্যুতের পেছনের ব্যয়ও কমানো যাবে। দেশ ধীরে ধীরে প্রবেশ করবে স্থাপত্যের নতুন এক যুগে।