বাংলা পঞ্জিকার ইতিবৃত্ত

পঞ্জিকা শব্দটি সংস্কৃত শব্দজাত। ইংরেজিতে একে অ্যালামনাক নামে অভিহিত করা হয়। বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ—এই পাঁচ বিষয়ের ওপর আলোকপাতকারী বইবিশেষ বাঙালির কাছে সাধারণত পঞ্জিকা নামে পরিচিত। প্রতিদিনকার তারিখ, তিথি, শুভক্ষণ, লগ্ন, যোগ, রাশিফল, বিভিন্ন পার্বণের খবরাখবর জানার সহজ মাধ্যম পঞ্জিকা। স্বল্প মূল্যে, সস্তা কাগজে ছাপা এই প্রকাশনার অমোঘ প্রভাব বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে বর্তমান। প্রাত্যহিক জীবনে জড়িত এমন গ্রন্থের আর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। বাঙালির জীবনে অত্যাবশ্যকীয় এ গ্রন্থ ব্যবহারের শুরুর দিন-তারিখ সুনির্দিষ্ট করে বলার জো নেই। তবে অনুমিত হয়, অষ্টাদশ শতকের আগে বাঙালি সমাজে পঞ্জিকার এমন প্রভাব বা প্রচলন ছিল না।

গ্রামীণ বাংলার মানুষের দিন শুরুই হয় পঞ্জিকা দেখে, আবার সারা বছর কাটেও পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে। যে বাঙালি সারা বছর কোনো বই কেনে না, তেমন বাঙালিকেও দেখা যায় বছরের প্রারম্ভে গোলাপি ফিনফিনে কাগজে মোড়ানো অল্প টাকার প্রকাশনাটি বাড়িতে নিয়ে আসতে। সারা বছর আদর-যত্নে থাকার পর বর্ষ শেষে একে বিদায় জানিয়ে নিয়ে আসা হয় নতুন পঞ্জিকা। বাঙালি সংস্কৃতির তথা নববর্ষের সঙ্গে পঞ্জিকা ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। গ্রামীণ মানুষের কাছে অত্যাবশ্যকীয় ও আদরণীয় এবং শহুরে মানুষের কাছে বর্তমানে কিছুটা অচেনা পঞ্জিকার সাতকাহনে গাঁথা আছে বাঙালির এক অন্য ইতিহাস।

ভারতীয় তথা বাঙালি সমাজে বার, তিথি, নক্ষত্র, যোগ ও করণ—এই পাঁচটিকে গুরুত্বসহকারে মান্য করা হয়। এ অঞ্চলের মানুষ বহু শতাব্দী ধরে শুভাশুভ নির্ণয়ের ঠিক পন্থা জেনে এসেছে পঞ্জিকায় বর্ণিত নিয়মনীতি অক্ষরে অক্ষরে পালনের মাধ্যমে। পঞ্জিকার মূলে থাকা পাঁচটি বিষয়, যাকে পঞ্চাঙ্গ বলা হয়, তা-ই এর প্রাণ।

বাঙালি জীবনে পঞ্জিকার প্রচলন

তিথি-নক্ষত্র ধরে শুভ কাজ করবার রীতি বাঙালির বহু পুরোনো প্রথা। যদিও সেসব বিধান দিতেন গোঁড়া ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা। এক পণ্ডিতের বিধানের সঙ্গে অন্য পণ্ডিতের বিধানে থাকত পার্থক্য। এতে বিপাকে পড়তেন সাধারণ মানুষ। এমতাবস্থায় কৃষ্ণনগর নিবাসী স্মার্ত রঘুনন্দন হিন্দু সমাজে নানা রকম বিধিনিষেধ নতুন করে প্রবর্তন করেন। এই বিধিনিষেধ তিনি হাতে লিখে পুঁথি আকারে সাধারণের কাছে প্রচার করেন, আর এভাবেই প্রচলন হয় বাংলায় হাতে লেখা পঞ্জিকার। কিন্তু প্রচলিত পঞ্জিকাটি নানা অসংগতিতে পূর্ণ ছিল। সমস্যা সমাধানে নবদ্বীপের মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র নদীয়ার শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত রামচন্দ্র বিদ্যানিধিকে দিয়ে এর একটি সংশোধিত রূপ রচনা করান। সেই সংশোধিত রূপটি পরে ‘চন্দ্রের অনুমত্যনুসারে’ অথবা ‘নবদ্বীপাধিপতির অনুমত্যনুসারে’ সংকলিতাকারে প্রচার হতে থাকে। এটিও ছিল হাতে লেখা। প্রচারিত এই পঞ্জিকাটির মূল্য ছিল দুই আনা, যা সবার পক্ষে কিনে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। গুটি কয়েক লোকের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। সাধারণের কাছে পঞ্জিকার আদর লাভ হয় মূলত উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে মুদ্রিত আকারে প্রকাশের পর থেকে।

পঞ্জিকার বর্তমান হালচাল

বর্তমান ব্যস্ত সময়ে নাগরিক জীবনে পঞ্জিকার ব্যবহার শহরে খুব একটা দেখা না গেলেও গ্রামীণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আজও পঞ্জিকার ব্যবহার রয়েছে। বাজারে প্রচলিত বেশির ভাগ পঞ্জিকা প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। কলকাতার বেনিয়াটোলা লেন থেকে প্রকাশিত হয় ‘গুপ্তপ্রেস ফুল পঞ্জিকা’। এর প্রকাশক ছিলেন দুর্গাচরণ গুপ্ত। বর্তমানে তাঁর বংশধরেরা তা প্রকাশ করে চলেছেন। শতাব্দীপ্রাচীন এ প্রকাশনা তার স্বীয় ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। এমনই আরেকটি পুরোনো প্রকাশনা শ্রীমদন গুপ্তের ‘ফুল পঞ্জিকা’। রাজেন্দ্র লাইব্রেরির এই প্রকাশনাটির বিক্রি পঞ্জিকাজগতে সবচেয়ে বেশি। ৩১ নম্বর অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত বেণীমাধব শীলের ‘ফুল পঞ্জিকা’র অবস্থান সুদৃঢ়। পুরোনো লোকেরা এখনো ব্যবহার করেন পূর্ণচন্দ্র শীলের ‘ফুল পঞ্জিকা’। ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’রও রয়েছে অনেক পাঠক। কলকাতার পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকটি পঞ্জিকা বের হয়। এর মধ্যে ‘লোকনাথ ডাইরেক্টরী নূতন পঞ্জিকা’র প্রচারসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এটি লোকনাথ বুক এজেন্সি থেকে প্রকাশিত হয়। এর প্রকাশস্থল ঢাকার ৩৩/১ নম্বর বাংলাবাজার। এর একটি পকেট সংস্করণ বের হয়। এরপর রয়েছে নিউ এজ পাবলিকেশনসের ‘নবযুগ ফুল পঞ্জিকা’। বাংলাবাজারের ৬৫ নম্বর প্যারী দাস রোড হলো এ প্রকাশনীর ঠিকানা। এরা হাফ পঞ্জিকাও বের করে। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু সমাজসংস্কার সমিতি থেকে বের হয় ‘সুদর্শন ডাইরেক্টরী’ বা ‘সুদর্শন ফুল পঞ্জিকা’। এগুলো সবই হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের পাঠকের কথা চিন্তা করে প্রকাশিত হয়। তবে শুধু মুসলমান পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হয় ‘তাজ নূরাণী মোহাম্মদী পকেট পঞ্জিকা’। এর প্রকাশক পুরান ঢাকার দি তাজ পাবলিশিং হাউস। এটিও প্যারী দাস রোডে অবস্থিত। এসব ছাড়াও উভয় বাংলায় আরও বেশ কয়েকটি পঞ্জিকা প্রতিবছর বাংলা নববর্ষের শুরুতেই নিয়মিত প্রকাশিত হয়।

উদয় শংকর বিশ্বাস: সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়