আমার সব কাহিনিই কিন্তু অতীত হয়ে যায়নি

>কেমন ছিলেন বাংলা সংস্কৃতির দুই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন ও সংগীত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ? সে কথাই অধ্যাপক মালেকা বেগম শুনেছেন তাঁদের সহধর্মিনিদের কাছ থেকে। ছাপা হয়েছিল সচিত্র সন্ধানীতে। আমরা তা পেলাম প্রথমা থেকে প্রকাশিত শুভ্র সমুজ্জ্বল বইয়ে। সচিত্র সন্ধানী, ৩ বর্ষ, ৩৯ সংখ্যা, ১৮ জানুয়ারি ১৯৮১
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (১৮৮৮–১৯৯৪)
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন (১৮৮৮–১৯৯৪)

এই সংসারে বউ হয়ে যখন এসেছি, তোমাদের চাচা তখন যুবক, আমি ১০ বছর বয়সের বালিকা, তখন তো এমনই রীতি ছিল। কিছু বোঝার বয়স ছিল না। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার চাঁদপুর মহকুমার গ্রাম পাইকারদিতে আমার বিয়ে হয়। শ্বশুর অনেক আগেই দেহত্যাগ করেছেন। শাশুড়ির এক মেয়ে, সাত ছেলে। তাঁর শখ ছিল বড় ছেলের বিয়ে দিয়ে বউ নয়, মেয়ে আনবেন ঘরে। আমাকে শাশুড়ি নিজের কাছে রেখে বড় করেছেন।

সে সময় স্বামীকে জানার অবসর কোথায়? শাশুড়ি-ননদ-জা—তাঁদের বরং জানতে হয়েছে অনেক বেশি করে। পড়াশোনা শেষ করে নাসিরউদ্দীন সাহেব তখন কলকাতায় সওগাত পত্রিকা নিয়ে ব্যস্ত।

যখন মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন, তিনিও তখন আমাকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেছেন, লালন-পালন করে বড় করার কথাই ভেবেছেন। পরিবারের মতো মনে করেননি। এর মধ্যে কাণ্ড ঘটে গেল। সব বন্ধু মিলে যুক্তি করলেন বোরকা চলবে না। সবার বউয়ের বোরকা সরাতে হবে। যে কথা, সেই কাজ। তিনি আমার বোরকা তুলে দিলেন।

সংসারজীবনের প্রথম অভিজ্ঞতাই হলো স্বামীর এসব অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখে। তিনি আমাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তাঁর সব কাজেই আমাকে টেনে নেবার চেষ্টা করলেন। এদিকে আমার তখন সংসারের কাজ, মেয়ের দেখাশোনা, কত ব্যস্ততা!

আমার পড়াশোনা তো কিছু ছিল না। গ্রামসমাজে আরবি, নামাজ, রোজা—এ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। কলকাতায় এলে আমার জন্য নিযুক্ত করা হলো টিচার।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের সঙ্গে স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। ছবি: সংগৃহীত

আমার তখন ভরযৌবনকাল। তিনিও চল্লিশের ঘরে পৌঁছাননি। কিন্তু আমাদের দাম্পত্য জীবনে আজকালকার মতো এত রঙিন ফানুস ছিল না। ছিল যা, তা অত্যন্ত সাবলীল মধুর সম্পর্ক, কারও মর্যাদা নষ্ট করার কোনো প্রবণতা ছিল না, ছিল কর্তব্যপূর্ণ অনেক দায়িত্ব পালনের তাগিদ।

সংসার সম্পর্কে বরাবরই উদাসীন এই মানুষটা বাইরের পাঁচটা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। সাহিত্যের আসর, সমাজসংস্কারের কাজ, নারীসমাজকে উৎসাহিত করা, সওগাত পত্রিকা প্রকাশ—এসব কিছুর মধ্যে যে মানুষটা তাঁর কাছে ধরা দিয়েছেন, তিনি অপূর্ব ব্যক্তিত্বের ছটায় সৌহার্দ্য আর পত্নীপ্রেমের দাক্ষিণ্যে উদ্ভাসিত।

আমার সব কাহিনিই কিন্তু অতীত হয়ে যায়নি। বর্তমানের কথা কিছু শোনো। মানুষ তো আর খুব বেশি বদলায় না। ওঁর স্বভাব আগের মতোই আছে। বাজার করার শখ বরাবরের। ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসেন। সে সময় রোববারে বাজার করতেন। সুফিয়া আসতেন, আমরা দুজনে রাঁধতাম, মেয়েরা সিনেমা দেখতে যেত, বেড়াত। এখনো সেই শখ আছে। এই তো সেদিন বাজারে গিয়ে ভিড়ে রিকশাচাপা খেয়ে বাড়ি ফিরলেন, অসুস্থ হয়ে পড়লেন।

তিনি খান কম, কিন্তু নানা ধরনের খাবার দিতে হবে টেবিলে। ইলিশ মাছ ভাজা হয়েছে বলে করলা ভাজি হয়নি দেখে খুঁতখুঁত করেছেন। রুই মাছের মাথা রান্না এমন হতে হবে যে চারদিক ভাঙবে কিন্তু মাঝখানটা থাকবে, ঝোল রান্না হতে হবে। ফলি মাছ, চিতল মাছের কোফতা খেতে ভালোবাসেন। তবে বয়স হয়েছে, এখন হজমের গোলমাল হয় বলে খেতে চান না। তিনি রাগী খুব তা নয়, তবে রাগটা একটু বেশি ছিল। যখন যেটা চাইতেন, না পেলে রাগ করতেন। নানা হিজিবিজি চিন্তা মাথায় নিয়ে খেতে আসতেন, টেবিলটা একনজর দেখে পছন্দ না হলে চলে যেতেন না খেয়ে! লোক পাঠিয়ে, মাফ চেয়ে তবে রক্ষা ছিল। এখন ততটা আর নেই। তবে আমি বরাবরই এ বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তে অটল যে স্বামীর বিরাগের কারণ যেন না হই।

স্বামী-স্ত্রীর মিলন আল্লাহর ইচ্ছাতেই হয়। ঘরের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতান্তর হলেই মনে হয় দুনিয়াই নেই, এটা বুঝেই চুপচাপ সব মেনে নিয়েছি। প্রথম প্রথম বুঝেশুনে, তাঁর মনমেজাজ ভালো দেখে, তবে কথা বলেছি। এখন আর তেমন নয়, সাহস করে সব কথা বলেই ফেলি।

আসলে রাগটাই তো আর সব নয়। ফাতেমা ছাড়া তিনি যে জগৎ অন্ধকার দেখেন, সে বিষয়ে তো কোনো সন্দেহ নেই। কাজ সেরে বাসায় এসেই দিনের সবকিছু নিয়ে গল্প করা চাই স্ত্রীর সঙ্গে। এখন পর্যন্ত বুড়ো কর্তা সওগাত পত্রিকার দেখাশোনা করেন, দুপুর ১২টায় অফিসে যান, বিকেল চার-পাঁচটায় চলে আসেন। রাত দুই-তিনটা পর্যন্ত পড়াশোনা করেন, কাজ করেন, তারপর ঘুমোতে যান। স্ত্রীর কাছে যাবতীয় বিষয়ে তাঁর গল্প করার সময়ও এক ফাঁকে হয়ে যায়।

আমাদের যুগে স্বামীকে নাম ধরে ডাকা শোভন ছিল না আজকালকার মতো। তখন তো শুধু ‘কর্তা’ বলতাম। ‘নূরীর বাবা’ বলতাম। আমি নামাজ, রোজা, ধর্মীয় নানা সংস্কার নিয়ে বেশি মানামানি করতাম, (তিনি নামাজ, রোজাকে স্বাভাবিকভাবে মানতেন) সে জন্য আমাকে প্রথম জীবনে মুনশি অথবা মৌলভি সাহেব বলে ডাকতেন। পরে ‘নূরীর মা’ বলতেন, আর এখন তো বলেন স্রেফ ‘বুড়ি’। তোমরা হয়তো এর মধ্যে কোনো রোমান্স খুঁজে পাবে না, কিন্তু আমাদের কাছে ডাকটা বড় নয়, এর মধ্যে ভালোবাসার হৃদয়টাই বড়।

সে যুগে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে সমাজ-প্রগতির আন্দোলনে যেভাবে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, পত্রিকার মারফত নারীসমাজের অগ্রগতির জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে গেছেন, তা দেখে আমার বিস্ময় লাগত। সচিত্র মহিলা সওগাত সংখ্যা বের করার সময় তিনি ভেবেছেন লেখিকাদের ছবি ছাপাবেন। সেই যুগে এটা খুবই বিপ্লবী চিন্তা। কেউ কারও স্ত্রী বা বোনের ছবি দিতে সাহস না করায় তিনি তাঁর নিজের স্ত্রী, মেয়ের ছবি ছাপালেন। পরে অন্যরাও সাহস পেলেন। এই ছিলেন নাসিরউদ্দীন সাহেব।

মেয়েদের পড়ালেখা, সাহিত্য-সাধনা—এসব বিষয়ে তাঁর ছিল অদম্য উৎসাহ। কিন্তু ধর্মান্ধ লোকেরা মেয়েদের লেখাপড়ার বিরোধিতা করতেন। গুন্ডাদের লেলিয়ে দিতেন প্রগতিবাদী লোকদের বিরুদ্ধে। তিনিও তো কত শত্রুর আক্রমণের মোকাবিলা করেই নারীশিক্ষার প্রচারের জন্য চেষ্টা করে গেছেন। ফজিলতুন্নেসার বিলেতে পড়তে যাওয়া নিয়ে কত বিতর্ক-বিরোধিতা! তিনি তাকে প্লেনে উঠিয়ে তবে শান্তি পেলেন। সে সময় বেগম রোকেয়ার প্রচেষ্টাকে তাঁরা সমর্থন দিয়েছেন, সহযোগিতা করেছেন। বেগম রোকেয়া আর তিনি তো মাত্র ছয়-সাত বছরের ছোট-বড়। এ বছর তিনি ৯৪ বছরে পা দিলেন, আর প্রয়াত বেগম রোকেয়ার ১০০ বছর পূর্ণ হলো। মেয়েদের প্রগতির কাজ তিনি করে বেড়াতেন আর আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম কোন দিন কোন বিপদ ঘটে যায়। কত দিন শত্রুদের হাতে নাজেহাল হয়েছেন, লাঠির বাড়ি খেয়েছেন সভা-সমিতিতে।

এই যে আজকাল তোমরা মেয়েরা মনের আনন্দে কাজ করে বেড়াচ্ছ, নারী প্রগতির আন্দোলন গড়ে তুলছ বিনা বাধায়, এটা সম্ভব হয়েছে তোমাদের চাচার মতো আরও অনেকের চেষ্টার ফলে। তাঁরা পথের কাঁটা দূর করে তোমাদের জন্য পথ কুসুমাস্তীর্ণ না হলেও কাঁটাহীন করে গেছেন, তা নিশ্চয়ই মানবে?