আগুন যখন নেভেনি, তখন আশাও নেভেনি

>সচিত্র সন্ধানী, ২৮ আগস্ট ১৯৮২
হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২–১৯৮৩)
হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২–১৯৮৩)

একটা বড় টেবিলের দুই পাশে বসেছিলাম আমরা দুজন। কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং আমি কথা বলছিলাম সেকাল আর একালের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। জীবনের নানা অলিগলিতে রাজপথের উন্মুক্ত প্রশস্ততায় ৫০ বছর ধরে হেঁটে আসা এই কবিকে সচিত্র সন্ধানীর পক্ষ থেকে তাঁর ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানালাম। তাঁর সুস্বাস্থ্যের জন্য জানালাম আমাদের শুভকামনা।

মালেকা বেগম: হাসান হাফিজুর রহমান বলতেই আমরা সেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত দিনগুলোতে ফিরে যাইএকুশের সংকলন আপনাকে আমাদের কাছে এমনভাবে পরিচিত করেছে, যা আপনার আর সব ভূমিকা, কাজকে নিষ্প্রভ করে দিয়েছেএর কারণ কী?

হাসান হাফিজুর রহমান: একুশের সংকলনটি আমি একহাতে করেছি, সেটা সত্য। সুলতানের ছাপাখানায় ছাপিয়েছিলাম। সেই সময়টায় আমাদের কথা ভেবে দেখো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি পঞ্চাশ সালে। ভাষা আন্দোলনের তখন উত্তাল অবস্থা। সেই সময় রাজনীতি যাঁরা করতেন, তাঁরা সংগঠন–আন্দোলনের যে রূপ দিতেন, আমি সেসব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে আমাকেও রক্তাক্ত করেছিলাম। তাই এই সংকলন বের করার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ের কাছ থেকে টাকা এনে এই সংকলন শুধু নয়, এর আগে পঞ্চাশ সালে দাঙ্গাবিরোধী ৫টি গল্পের সংকলনও বের করেছিলাম।

একুশের সংকলন কতটুকু আমাকে পরিচিত করেছে জানি না, আমার সেটা লক্ষ্যও ছিল না। একুশের তাৎপর্য এবং কবি–সাহিত্যিকের ভূমিকা যদি তুলে ধরে থাকতে পারে এই সংকলন, তবেই সার্থক আমার পরিশ্রম, এটাই আমার পরিতৃপ্তি।

আমার সারা জীবনে এমন কিছু করিনি, প্রকাশ্যে এমন কিছু পালন করিনি, এমন কোনো সাহিত্য রচনা করিনি, যা আমাকে সবার কাছে পরিচিত রাখবে। একুশের সংকলনও পরিচিত করেছে আমাদের কবি–সাহিত্যিককে, ভাষা আন্দোলনকে, শুধু আমাকে কেন হবে?

মা. বে.: পেছন ফিরে তাকালে সাতচল্লিশ থেকে এই পর্যন্ত সময়ে তিনটা স্তরভাগ চোখে পড়ে—ভাষা আন্দোলনের পর্ব থেকে আটান্ন সাল পর্যন্ত, উনষাট থেকে একাত্তর পর্যন্ত, বাহাত্তর থেকে বিরাশি পর্যন্তএই সময় ধরে আপনি কেন খুব একটা চোখে পড়ছেন না, উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় কেন উদ্ভাসিত হলেন না?

হা. হা. র.: সেটা আমার স্বভাব। আমার চরিত্রের মধ্যে এমন কিছু দ্বিধা আছে, যা আমাকে প্রকাশ্য ভূমিকা পালনে বিরত রাখে। বিগত সময়ের যে তিনটি স্তরের কথা বলছ, তা আমার জীবনেও তিন ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে বৈকি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও পার্টির সাংস্কৃতিক সেলের মধ্যে থেকে কাজ করেছি। প্রগতিশীল সংঘ করা, সাহিত্যধারাকে প্রগতিশীল খাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য সাংগঠনিক কিছু কাজ প্রথম থেকেই করার চেষ্টা করেছি। প্রগতি লেখক সংঘ বেআইনি ঘোষিত হলে শ্রদ্ধেয় নাসিরউদ্দীন আহমেদের সওগাতকে কেন্দ্র করে ‘সাহিত্য সংসদ’ গড়ে তোলা হলো। ১৫০–২০০ জনের সাহিত্য সভা সে সময় প্রায়ই হতো। প্রথমে ফজলে লোহানী ও মোস্তফা নুরুল ইসলাম ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। এরপর ক্রমান্বয়ে ফয়েজ আহমেদ, আতোয়ার রহমান সম্পাদক ছিলেন। আমি সম্পাদক হয়েছিলাম ১৯৫৮ সালে। সাংগঠনিক কাজ, সভা চালানো, সেমিনার করা—এই সবের মধ্যে এতটা জড়িয়ে থাকতাম যে এর বাইরে নিশ্চিন্তে সাহিত্যসাধনা করার মতো আকাঙ্ক্ষাও হতো না, সুযোগও হতো না। হয়তো এর বেশি কিছু সম্ভবও ছিল না। এটুকুই আমার পরিচয়, যেটুকু তোমরা দেখেছ। এর বেশি আমার কোনো পরিচয় নেই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পূর্বে আণবিক অস্ত্রবিরোধী এক সভা করেছিলাম সাহিত্য সংঘ থেকে। সেসব দিন ছিল দুর্দান্ত উত্তেজনায় ভরা। কাজী মোতাহার হোসেন, নাসিরউদ্দীন আহমেদ, আমিনুল হক, আ ন ম বজলুর রশীদ—আরও সব প্রবীণ ও নবীন কবি–সাহিত্যিকের সে কী জমজমাট সাহিত্যের আসর বসত সে সময়! এই সময়েই সমকাল–এর আবির্ভাব। দীর্ঘদিন সম্পাদনায় কাজ করেছি।সমকাল চালানোর সময় বুঝেছি, যেকোনো কাজেই সাংগঠনিক পরিশ্রম ও যোগ্যতা ছাড়া সাফল্য সম্ভব নয়।

এরপর সামরিক শাসন জারি হলে রাজনৈতিক আঘাত এল। থমকে গেলাম অনেকেই। সে সময় দ্বিধাদ্বন্দ্ব কম হয়নি। পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডে যোগ দিয়ে নিন্দাও কুড়িয়েছিলাম। তবে যখন ১৯৬৮ সালে দেশের হাওয়া বইতে থাকল উত্তালভাবে, তখন আমরাও করেছিলাম ‘মহাকবি স্মরণসভা’। মাইকেল, গালিব, ইকবাল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছিল। মাতৃভাষা দিবস পালন করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, আমি এবং অনেকেই ‘খোলা চিঠি’ লিখেছিলাম।

উনসত্তর-সত্তরের সেই সংকটের সময় আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিলাম দৈনিক বাংলার সাংবাদিক। শামসুর রাহমান এবং আমি তখন কোপের মুখে থেকেও জাতীয় আন্দোলনের স্বার্থকে বড় করে তুলেছিলাম। সে জন্য বহু ধাক্কা সামলিয়েও আমরা নিশ্চিন্তে ছিলাম, ভূমিকা আমাদের ঠিক আছে।

স্বাধীনতা সংগ্রাম হলো। বহু ত্যাগ–তিতিক্ষার পর অর্জিত স্বাধীনতা। স্বাধীনতার পর দৈনিক বাংলার সম্পাদক হলাম। সাপ্তাহিক বিচিত্রার পরিকল্পনা নিলাম। বের হলো বিচিত্রা। আবার সংকট এল। আমার স্বাধীনতার সত্তা, কী করব না করব, এই সিদ্ধান্তে যখন সরকারি চাপ এল, তখন পত্রিকা ছেড়ে দিতে হলো। বিদেশে গিয়েছিলাম সরকারি দায়িত্ব নিয়ে, দেশে ফিরেছি দীর্ঘদিন। এখন কাজ করছি ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’ প্রকল্প সম্পাদনার।

তুমি বলছিলে কেন এই তিন স্তরে উজ্জ্বল হয়ে উঠলাম না? আমার চারিত্রিক ধারাতেই তো দেখলে, শুধু সম্পাদনা, সংগঠন—এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসি।

মা. বে.: আপনারা একসময় যা করেছেন, তা নিয়ে আজও আমরা গর্ববোধ করিকিন্তু বলুন তো, এখন কেন তেমন কোনো সংগঠন নেই, সাহিত্য নেই, নেই তেমন কালচারাল মুভমেন্ট?

হা. হা. র.: আসলে আমরা যখন কাজ করেছি, তখন কালচারাল মুভমেন্টটা পরীক্ষিত ছিল না। নতুন আদর্শের সঙ্গে আমরা যুক্ত হচ্ছিলাম। মানুষের পরিবর্তন আনার চেষ্টায়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তি চেয়েছিলাম আমরা। আমরা শাণিত হয়েছিলাম নতুন আদর্শগত ধ্যান-ধারণায়।...আজকেও কিছু হচ্ছে না, তা বলব না। তরুণদের কবিতা, গল্প অনেক সময়ই আমার কাছে ভালো লাগে। তবে যেটা বলছ যে কেন ঠিক আগের মতো হচ্ছে না, সেটার কারণ মনে হয় রাজনৈতিক ব্যর্থতা। রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেলাম, কিন্তু সমাজ গঠনে আমরা ব্যর্থ হলাম। বাক্‌স্বাধীনতার ওপর আঘাত এল বারবার। তবু যেভাবে দেশ গড়ার প্রেরণা পেয়েছিলাম সবাই, সেটা ১৯৭৫ সালে এসে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর ফলে ব্যাহত হলো। আঘাত পেলাম আমরা। আমি নিজে ভয়ানক ধাক্কা খেয়েছি। দেশ ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত একটা রূপ নিচ্ছিল, কিন্তু এরপর সবকিছু আঘাতে বিধ্বস্ত হলো।

এই সময়ে যা দেখেছি, তাতে মনে হচ্ছে আমরা মহৎ কোনো আদর্শ থেকে বিচ্যুত বলেই কিছু করতে পারছি না। হাত গুটিয়ে বসে থাকা মানুষ আমরা। সবাই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি। অর্থাৎ, আমরা চুপ করে থাকার পক্ষপাতি হয়ে যাচ্ছি। কেননা, কোনো প্ল্যাটফর্ম আমরা পাচ্ছি না। আগে আমাদের পক্ষে বহু লোক ছিল বলে বুঝতে পারতাম, পায়ের নিচে মাটি আছে বলে উপলব্ধি হতো। কিন্তু এখন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ফাঁকা একটা অসারত্ব সৃষ্টি হয়েছে, কারণ সংস্কৃতিকর্মীদের মধ্যে হতাশা এসেছে, কী লক্ষ্যে তাদের কাজ পরিচালিত হবে, সেটা তারা বুঝতে পারছে না। আমাদের মূল্যবোধ নষ্ট হচ্ছে। অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক ব্যর্থতা এবং সামাজিক জীবনের অবক্ষয়—এ সবকিছুই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পর্যন্ত একটা শূন্যতা ও অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে। তবু আমি বিশ্বাস করি, এসবই সাময়িক। সামাজিক দায়িত্ব পালনের মতো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড করার জন্য অনেকেরই অন্তরাত্মা সক্রিয় হয়ে উঠছে। পথ পাচ্ছে না, পথ দেখানোর দ্বিতীয় সাথি পাচ্ছে না, আগুন যখন নেভেনি, তখন আশাও নেভেনি।