কৈশোর-যৌবনকালে মানুষমাত্রই কবি থাকে

>সচিত্র সন্ধানী, ০৮–০৮–১৯৮২
শওকত ওসমান (১৯১৭–১৯৯৮)
শওকত ওসমান (১৯১৭–১৯৯৮)

সৈয়দ কামরুল হাসান:সমকালীন অবস্থাকে আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন? আপনার বর্ণিত প্রেক্ষিতে একজন লেখকের দায়িত্ব কী হওয়া উচিত?
শওকত ওসমান: আমরা বর্তমানে সামাজিক অবস্থায় যেখানে দাঁড়িয়েছি, তাকে কোনো স্থিরবিন্দু বলা চলে না। তরল পারদের মতো সমগ্র সামাজিক অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, বলা কঠিন। এর কারণ, বাঙালি মুসলমানের আইডেনটিটি-সমস্যা, স্বাজাত্যের সমস্যা আজও মেটেনি। তারা একবার পাকিস্তানি হয়ে বেআব্রু হয়েছে, দিয়েছে ইজ্জত। পরবর্তীকালে তারা সাড়ে তিন বছরের জন্য বাঙালি হয়েছিল বটে, এখন সেখানেও আর নেই। সুতরাং এই যে দোলাচল, এমন প্রেক্ষিতে মনের আবেগও ঠিকমতো দানা বাঁধতে পারে না। অস্থিরমতি বালকের যে দশা ঘটে, আমাদেরও প্রায় সেই পর্যায়। একজন লেখকের দায়িত্ব বাঙালি মুসলমানের আবেগের রাজ্যে তার স্থায়ী ল্যান্ডস্কেপকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। একজন লেখকের ওপর সামাজিক দায়িত্বও ষোলো আনা বর্তায়—এমন বলা চলে না ঠিক, কিন্তু বর্তমানে আমরা যেখানে আছি, কোনো সিরিয়াস লেখক সে দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তার কারণ, সমাজ সংহতির জন্য স্বাজাত্যের প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি অস্তিত্বের দিক থেকেও ব্যাপারটি প্রায়োরিটি হয়ে দাঁড়ায়, যেহেতু অস্তিত্বের সংকট এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত। বাইরের কোনো আঘাত এলে গোটা দেশের স্বাধীনতাই বিপন্ন হবে। কারণ, সামাজিকভাবে অসংলগ্ন কোনো দেশ প্রগতি তো দূরের বিষয়, টিকেই থাকতে অপারগ। অবশ্য একজন লেখক বা কবি প্রধানত তাঁর নিজের কারুশিল্প নিয়েই ব্যাপৃত থাকবেন, কিন্তু তাঁর মানসিক প্রেক্ষিতে যদি দেশের নানারূপ চাঞ্চল্য–স্পন্দন আঁচড় না কাটে—তাহলে কোনো দিন শিল্পের দায়িত্ব পরিপূর্ণ সম্পন্ন করতে পারেন না।

সৈ. কা. হা.: দেশ বিভাগের পর আমাদের কথাসাহিত্যে কি নতুন কোনো ধারা গড়ে উঠেছে?

আপনাদের পরবর্তী সময়ে যাঁরা লিখছেন, তাঁদের সঙ্গে আপনাদের মৌলিক তফাতটি কোথায়?

. ও.: প্রথমত, আমাদের উত্তরসূরিদের সবাইকে পড়ার সুযোগ আমার হয়নি। দু–চারজনের প্রতিভাদীপ্ত কিছু রচনার সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে মাত্র। তা মৌলিক কিছু মনে হয়নি। কারণ রাজনৈতিকভাবে এই ভূখণ্ড আলাদা হলেও তার মূলে কোনো বেগবান সাংস্কৃতিক ধারার যোগ ছিল না। নিতান্ত রাজনৈতিক ফায়দা ওঠানোর জন্যই একটা কৃত্রিম আইডেনটিটি বা স্বাজাত্য খাড়া করা হয়। এই মুনাফিকি, ভণ্ডামি তো কোনো সাংস্কৃতিক বিকাশে সাহায্য করে না। কারণ বিশুদ্ধ চেতনার প্রবাহে জীবনের চারদিকে যদি সরস কোনো আবহাওয়া গড়ে তুলতে পারে, তারই যোগফল একটি দেশের সংস্কৃতি।

শওকত ওসমান। ছবি: নাসির আলী মামুন
শওকত ওসমান। ছবি: নাসির আলী মামুন

সৈ. কা. হা.: পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য সম্পর্কে আপনার অভিমত ব্যক্ত করুন
. ও.: পশ্চিমবঙ্গের সব সাহিত্য পড়া আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। যা পড়েছি, তাতে মোটামুটি কয়েকটি প্রবন্ধ স্পষ্ট আমার চোখে পড়েছে। সেখানে এখন একটি বামপন্থী সরকার বর্তমান এবং বলাবাহুল্য, তা বেশ শক্তিশালী। কিন্তু সংস্কৃতিজগতে এর প্রক্ষেপ বড় দুর্বল। তার বিশেষ কারণ, বামপন্থী শিবিরে তেমন শক্তিশালী কোনো প্রতিনিধি এখনো দেখা যায়নি। অন্য শিবিরে বেশ কিছু জনপ্রিয় লেখক রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে একদা সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকলেও কালপরিক্রমায় পথের দিশা ঠিক রাখতে পারেননি। ফলে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রবর্তিত মানবতাবাদী ঐতিহ্যটি (হিউম্যানিস্ট ট্র্যাডিশন) বড়ই ক্ষীণধারা। অর্থাৎ বলা যায়, যাঁদের সমাজবোধ আছে, নান্দনিক ক্ষেত্রে তাঁরা তেমন তেজি নন, আর নান্দনিক ক্ষেত্রে যাঁরা বীরপুরুষ, তাঁরা আবার সামাজিক দায়িত্ববোধ সম্পর্কে অচেতন, দায়িত্বহীন বলা চলে।

মাছে আর গাছে তুলনা করা চলে। যেমন, গাছ অনড়, খাড়া থাকে; আর মাছ জলে দৌড়ায়। একটা পার্থক্য দেখানো গেল। তাৎপর্যও হয়তো আছে। কিন্তু, তা নিয়ে কি গলদঘর্ম হওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে? ভুলে যাওয়া উচিত নয়, অবিভক্ত বঙ্গের সাহিত্যধারাটি বহু পুরাতন।

সৈ. কা. হা.: জনপ্রিয়তা ও মহৎ সৃষ্টি কি পরস্পরের পরিপন্থী? আপনার ধারণায় এর সমীকরণ কী?
. ও.: যা সত্যিই মহৎ, এ পর্যন্ত দেখা গেছে—এমন অবদানে দুটি হাত থাকে। এবং বিশাল। এর এক হাত আকাশ স্পর্শ করে, অন্য হাত মাটি—এই আলিঙ্গনে পণ্ডিত, আধা পণ্ডিত সাধারণ মানুষ, কাল, মহাকাল—সবই বাঁধা হয়ে যায়। যেমন রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, বাইবেল, সার্ভেন্তেসের ডন কুইক্সোট, সুইফটের গালিভারস ট্রাভেল, বুনিয়ানের পিলগ্রিমস প্রোগ্রেস এবং এ–জাতীয় আরও নাম করা যায়।

তবু বর্তমান যুগে শ্রেণির তারতম্য থাকার ফলে অধিকাংশ মানুষই সংস্কৃতির কোনো আস্বাদ পায় না (যেমন খাদ্য থেকেও তারা বঞ্চিত)। যদি পৃথিবীর সামাজিক ব্যবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে এবং ইতিমধ্যে অন্য অনেক সভ্যতার মতো আণবিক বোমায় মানুষ ধ্বংস হয়ে না যায়, তখন বিরাট আরেক সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জোয়ার পৃথিবীকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। তখন আরও অনেক গ্রন্থ মহৎ সাহিত্যের মতোই দুই হাত দিয়ে মানুষকে আলিঙ্গন দেবে। শিক্ষার অভাবে বর্তমানে বহু মানুষই যেমন খাদ্য থেকে বঞ্চিত, তেমনি সাংস্কৃতিক আস্বাদনও তারা পায়নি।

ব্রিটিশ দাসত্ব আমার একটি উপকার করেছে মাত্র। আমি শেক্‌সপিয়ারকে আদি ভাষায় পড়তে পাই, তা বাধ্য হয়ে কিছু লেখাপড়া শিখেছিলাম বলেই।

সৈ. কা. হা.: কোন তাগিদ থেকে কথাসাহিত্যকে বেছে নিয়েছেন? মাধ্যম হিসেবে কবিতা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?

. ও.: কৈশোর–যৌবনকালে মানুষমাত্রই কবি থাকে। কারণ, এই সন্ধিক্ষণে দুনিয়ার তাবৎ স্বপ্ন জড়ো হয়। আমি কবিতা নিয়েই সাহিত্যের মকশো শুরু করেছিলাম। পরে গদ্যের দিকে ঝুঁকে যাই। এর প্রধান কারণ, অনুন্নত দেশে সামাজিক সমস্যা প্রায় রৌদ্রের মতোই এত স্পষ্ট এবং রক্ত ঝলসানো যে, বড় ক্যানভাস ছাড়া তার মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। অবশ্য কবিতায় যে হয় না, আমি তা–ও বলব না। কিন্তু আমার কাছে গদ্যই অনেক বেশি সুগম্য মনে হলো।

কবিতা লেখা কিন্তু আমি ছাড়িনি। তাৎক্ষণিক কফির মতো কবিতা পরিবেশন আমার কাছে এখনো সহজাত হয়ে আছে। কোনো বিশেষ উপলক্ষে, যথা কাউকে বই দিতে, কিংবা কোনো জিনিসপত্র উপহার দিতে আমি অল্প চিন্তার পর কবিতা লিখে দিই। যেমন তুমি জার্নালিস্ট, তুমি নিশ্চয়ই আগ্রহী হবে একটা নমুনা পাওয়ার জন্য। আমি এক তরুণ সাংবাদিককে লিখে দিয়েছিলাম—এ যুগে খবর ঘটে না, হয় নির্মাণ/ প্রয়োজন শুধু ফোরম্যান আর ফরমান।

ঠিক এই ধারায় কখনো কারও নামের সঙ্গে রসিকতা, কারও বইতে ইঙ্গিত করে কিছু লিখে দেওয়া আমার কাছে জল-হাওয়ার মতোই সদাসচল ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমার হয়তো জানা আছে, শহীদ কাদরীর এক কবিতার বই আছে—কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। আমি তাঁকে কদিন আগে আমার এক গল্পের বই উপহার দিতে লিখলাম—

‘কান্না মানা। স্তব্ধ অশ্রু, কণ্ঠস্বর, কোথাও ক্রন্দন নেই অতঃপর।

অর্থাৎ তার বইটির দিকে ইঙ্গিতই এই পঙ্‌ক্তিগুলোর উৎস।

সৈ. কা. হা.: একজন লেখক হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

. ও.: অনেক দিন তো ব্যাট চালিয়ে এসেছি। বর্তমান স্কোর ৬৬ নট আউট। এখন এই বিস্তারিত ইনিংস এত অল্পে শেষ করা রীতিমতো কঠিন। পরে তোমার সঙ্গে আরেকটা ম্যাচের ব্যবস্থা হবে।

সৈ. কা. হা.: আমাদের তরুণদের প্রতি আপনার কী বলার রয়েছে?

. ও.: গাছের ডালপালা কোনো দিন মূলে আসে না। নিজের বিকাশের তাগিদে তা সূর্যের আলো হাতড়ে বেড়ায়। সাহিত্যের শাখা–প্রশাখাদের ক্ষেত্রে তা কিন্তু খাটে না। তাদের চোখ আকাশের দিকেই থাক; তবে মূলের দিকে মাঝেমধ্যে যেন আড়চোখে চেয়ে নেয়—একজন পূর্বসুরির এই অনুরোধ যেন তরুণেরা রক্ষা করেন। কারণ তারা প্রতিপদের চাঁদ আর পূর্বসূরিরা কৃষ্ণপক্ষমুখী, ক্ষীয়মাণ—তাঁরা যখন বর্তমান।