গুরুচিন্তা

কাল যেহেতু বয়ে চলে, তাই আজ যাকে বলছি একাল, কিছুদিন পর সেটাই হয়ে যাবে সেকাল। কাল যেমন বদলায়, তেমনি সময়ের সঙ্গে বদলায় অনেক রীতিনীতি, প্রেমপ্রীতি, শিল্পসংস্কৃতি, সম্প্রীতি; ক্ষেত্রবিশেষে স্মৃতিও হয়ে যায় বিস্মৃতি। যার কিছু আমাদের করে আনন্দিত, কিছু করে চিন্তিত। সবকিছু মিলিয়ে এসব চিন্তাকে গুরু–চিন্তাও বলা যেতে পারে। তবে কোরবানি এলে এই গুরু–চিন্তাটা হয়ে যায় গরু-চিন্তা। কোরবানি নিয়ে শোনা যায় এর বাণী, ওর বাণী। কারও আবার জোর বাণী। 

ঈদ এলেই টিভি কিংবা পত্রিকা থেকে অনেকেই ঈদের অনুভূতি জানতে চান, জানতে চান কেমন কাটবে ঈদ কিংবা কেমন ছিল ছেলেবেলার ঈদ? দীর্ঘ মিডিয়াজীবনে এটা আমার অভিজ্ঞতা।

তবে এখন ঈদের কথা চিন্তা করতে গেলেই গরু নিয়ে অনেক গুরু–চিন্তা মাথায় এসে ভর করে। আগে ভাইদের মধ্যে কেউ বাবার সঙ্গে গরুর হাটে যেতাম, আর কেউ বাড়িতে থাকতাম গরুকে বরণ করে নিতে। তারপর সবাই মিলে তাকে আদরযত্নে লালন-পালন করতাম। অবশেষে ঈদের দিন জবাই এবং সবাই মিলে কাটাকাটি। এরপর আত্মীয়স্বজন, গরিব-দুঃখীদের মধ্যে নিয়মানুযায়ী মাংস বণ্টন। তারপর মায়ের হাতে রান্না। শেষে সবাই মিলে মহানন্দে ভক্ষণ। এই পুরো প্রক্রিয়াটাই ছিল চিন্তামুক্ত ও আনন্দযুক্ত। অর্থাৎ গরু নিয়ে আগে কোনো সন্দেহ ছিল না, ছিল না কোনো চিন্তা। 

আর এখন তো হাটে না গেলেও চলে। অনলাইনেই গরু পাওয়া যায়। কেনার পর হোম ডেলিভারির ব্যবস্থাও আছে। গরু চেনা এবং চিনে কেনা, তারপর দড়ি-ছড়ি হাতে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করে ঘরে আনার আর দরকার হয় না। সাধারণত গরু গৃহে পালিত হলেও এখনকার কোরবানির হাটের সব গরু গৃহে পালিত হয় না—কিছু ফার্মে পালিত, কিছু দালাল পালিত, আর কিছু ব্যাপারী ও চোরাকারবারি পালিত। তবে কোনটি যে কার পালিত সেটা বোঝা যায় না—এটাও চিন্তার বিষয়। শুধু তাই নয়, এখন কোরবানির গরু নিয়ে আরও অনেক সামাজিক চিন্তা রয়েছে। প্রথম চিন্তা হলো, গরুটা একা দেবেন না ভাগে দেবেন। যদি ভাগে দেন, তাহলে চিন্তা, কার সঙ্গে দেবেন। এরপর আছে গরু চেনা ও কেনার ঝামেলা। কোন হাট থেকে কিনবেন? ঈদের কদিন আগে কিনবেন? কখন কোথায় সস্তা? কেনার পরে বাড়ি পর্যন্ত আনার চিন্তা। অভ্যাস না থাকার কারণে হঠাৎ রাখালের চরিত্রে আপনি সফল না-ও হতে পারেন। আনার পরে রাখার চিন্তা। শহরে তো আর মাঠ-ঘাট নেই যে সারা দিন রাখলাম, ঘাস খেল, রাতে নিয়ে এলাম। আবার বাড়ির বাইরে রাখলেও চিন্তা, কোন সময় চুরি হয়। যেখানেই রাখেন না কেন তাদের খাওয়া-দাওয়ার একটা সমস্যা আছে। 

সবকিছু সামাল দিয়ে ধরুন গরু কিনে কোরবানিও দিলেন। এবার চামড়া নিয়ে চিন্তা। চামড়া কী করবেন? ইচ্ছা আছে এতিমখানায় দেওয়ার কিন্তু এলাকার সন্ত্রাসীরা এসে প্রেশার দিলে ফ্রি-ও দিতে হতে পারে। 

ধরুন সব সারলেন, এবার মাংস কাটা। ভাগে দিলে সবাই মিলে কাটা যাবে কিন্তু একা দিলে কাটবে কে? ধরুন, কাটলেন। এরপর রান্না। অর্থাৎ কোরবানির গরু নিয়ে চিন্তার শেষ নেই। 

আগের দিনে কিন্তু মিডিয়াতেও এত গরু-ছাগল দেখা যেত না। এখন টিভি খুললেই গরুর ছবি। গরু নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। পত্রিকার পাতা ওল্টালে গরুর রঙিন ছবি। গলায় রঙিন মালা, কপালে লাল কাপড়ের টিকলি, কখনোবা তৈলাক্ত চামড়া। 

এরপর আছে গোস্বাস্থ্য চিন্তা। গরুকে আকর্ষণীয় এবং মোটাতাজা করার জন্য নানা ধরনের ওষুধ ও স্টেরয়েড দেওয়া হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রাকৃতিকভাবে গরু লালন-পালন না করে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে গরুকে মোটাতাজা করার চেষ্টা করেন। গরুর দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও দইয়ে পাওয়া যাচ্ছে সিসা, যা তৈরি করছে ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকি। চিকিৎসকদের মতে, এই স্টেরয়েড বা হরমোনসমৃদ্ধ মাংস খেলে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে ভোগার আশঙ্কা রয়েছে। অথচ আমাদের ছেলেবেলায় মায়ের হাতের এক গ্লাস দুধ ছিল কত নিরাপদ ও পুষ্টিকর। নিশ্চিন্তে পান করতাম সবাই। খেলাধুলা ও পড়াশোনার ফাঁকে ওই এক গ্লাস দুধ ছিল পরম স্বস্তি ও শক্তিকারক। আর এখন দুধ তো দূরের কথা গরুর মাংস নিয়েও গুরুতর চিন্তা, ভেজাল নেই তো? 

এখন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন জাত ও ব্র্যান্ডের গরু পাওয়া যায়—আমেরিকার ব্রাহামা, অস্ট্রেলিয়ার ফ্রিজিয়ান, টেক্সাসের ব্রেগাস, সিন্ধি, সাইওয়াল। 

আর দেশি গরু—চিটাগাং ক্যাটল, পাবনাইয়া, মীরকাদিম বা গয়ালসহ নানা জাতের গরু। দামও চড়া। আমাদের ছেলেবেলায় এত জাতের গরু ছিল না, গরুর মূল্যেও এত হাঁকডাক ছিল না। এখন প্রায় অর্ধকোটি পর্যন্তও গরুর দাম হাঁকা হয়। এই নামী গরুর দামি ক্রেতারাই আবার কাউকে পাঠান আস্ত গরু, কাউকে পাঠান রান। তারপর কোন দেওয়াতে কী লাভ হবে, মেলান সেই হিসাব। তখনই আবার ভাবতে লাগে ভয়, মনের পশুর কোরবানি কি এমনভাবে হয়? 

ঈদ মানে খুশি আর এই কোরবানির ঈদের খুশি ‘উৎসর্গ’ করতে পারার খুশি। বিলানোতেই সুখী হওয়ার নাম হলো কোরবানি, ঈদুল আজহার এই তো মর্ম, এই তো আসল বাণী। 

 হানিফ সংকেত: গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব।