সৌম্য ও সচেতন এক নীতিপ্রণেতা : সি এস করিম

সি এস করিম। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
সি এস করিম। প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

চৌধুরী সাজ্জাদুল করিম, বৈজ্ঞানিক, নীতিপ্রণেতা, সচেতন নাগরিক। জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৮ সালে চট্টগ্রামে। ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণি লাভ করেন। স্বাধীনতা–উত্তর প্রজন্মের অনেকের মতোই তিনিও পড়াশোনার জন্য যান তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে। ১৯৮৭ সালে মস্কোর শক্তি প্রকৌশল ইনস্টিটিউট থেকে পারমাণবিক প্রকৌশলে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।

শিক্ষাজীবন শেষ করে যোগ দেন বাংলাদেশ আণবিক শক্তি কমিশনে। প্রায় তিন দশক এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। ২০০৬ সালে অবসর নেন চেয়ারম্যানের পদ থেকে। এই সুদীর্ঘ কর্মজীবনে জাতীয় শক্তি নীতি প্রণয়ন ও রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইসহ জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছেন। লিখেছেন বহু বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। নিয়োজিত হয়েছেন বহু উচ্চমানের আন্তর্জাতিক কাজে।

ড. সি এস করিমের জীবনের উজ্জ্বলতম অধ্যায় সম্ভবত তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন (মেয়াদকাল ২০০৭-০৮)। বিশ্ব অর্থনীতি ও জাতীয় অর্থনীতির একটি চ্যালেঞ্জিং সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষি উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় ঘূর্ণিঝড়, সিডর ও বন্যা–পরবর্তী পরিস্থিতির। এ দুর্যোগ তিনি সামাল দিয়েছেন যোগ্যতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে। এই দ্বৈত দুর্যোগে বিপুল পরিমাণ ধান, কৃষিজমি ও গবাদিপশুর ক্ষতি হয়। সে সময় বিশ্ববাজারে চালের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমদানির ক্ষেত্রেও দেখা দেয় জটিলতা। এই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রম করেন। কৃষকদের হাতে সময়মতো বীজ ও সার পৌঁছানো নিশ্চিত করেন। প্রায় ৬৪টি জেলায় তিনি সশরীর উপস্থিত হয়েছেন, আলোচনা করেছেন স্থানীয় মানুষ ও প্রশাসনের সঙ্গে। তাঁর এই দূরদর্শী ও নীতিনিষ্ঠ আন্তরিক প্রচেষ্টায় ২০০৮ সালে চাল ও আলুর বাম্পার ফলন হয়। তা বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি প্রশমিত করতে বিশেষ অবদান রাখে।

তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্য সরকারের কাছ থেকে এক হাজার কোটি টাকার জলবায়ু তহবিল সংগ্রহ করে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তাঁর সময়কালেই তৈরি হয় বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড অ্যাকশন প্ল্যান। এই সময়কালেই তিনি সামাল দিয়েছেন অ্যাভিয়েন ফ্লুয়ের প্রাদুর্ভাব। মৎস্য উৎপাদন ও গবাদিপশু পালনে দিয়েছেন উদ্ভাবনী নীতির সমর্থন। এ ছাড়া প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সুন্দরবনকে রক্ষা করেছিলেন ক্ষয়ের হাত থেকে।

একজন জনসম্পৃক্ত ও দক্ষ পেশাজীবী যখন নীতিনির্ধারণের সুযোগ পান, তখন স্বল্প সময়েই যে কর্মসম্পাদনে স্বকীয়তার ছাপ রাখা যায়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ ড. সি এস করিম।

ড. সি এস করিমের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল। কিছুটা পেশাগত পর্যায়ে, কিছুটা সামাজিক পরিমণ্ডলে, বিশেষ করে একজন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের শিক্ষার্থী হিসেবে। তিনি প্রচলিত অর্থে অবসরজীবনেও ছিলেন পেশাগত ও সামাজিকভাবে সক্রিয়। তাঁর সৌম্য উপস্থিতি ও স্মিত হাসি আজও মনে পড়ে।

বাংলাদেশের বর্তমান গড় আয়ু পূরণ না করেই তিনি মাত্র ৬৭ বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে গেছেন। প্রথম আলোকে ড. সি এস করিমের অবদানকে বিনম্রভাবে স্মরণ করার সুযোগ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য েসন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি)সম্মানিত ফেলো