বাঙালির ধান-সংস্কৃতি

এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো
এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো

মানচিত্রে বাংলাদেশকে যতটুকুই দেখা যাক না কেন, ধান উত্পাদক দেশ হিসেবে বিশ্বে আমাদের পরিচিত সুদূর অতীতকাল থেকেই। ধানই আমাদের পরিচয়। আমাদের ভেতো বাঙালি তকমা এমনি জোটেনি, আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশের জিডিপির শতকরা ১১ ভাগ আসে ধান থেকে। এ দেশের শতকরা ৬৭ ভাগ লোকের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে ধানকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় যেটুকু ক্যালরি ও প্রোটিন যুক্ত হয়, যথাক্রমে এর ৭৭ এবং ৬৫ ভাগ আসে ধান বা চাল থেকে। একজন বাংলাদেশির সারা বছরে প্রয়োজন হয় ১৪৬ কিলোগ্রাম চালের। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তাই ধানকে কেন্দ্র করেই বেড়ে উঠেছে।

এ দেশে একসময় যে ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল, এ কালের অনেকেই সেই সুবাসিত ধানের খবর আর জানেন না।

বাঁশফুল, তিলকাফুলি, ঝিঙ্গাশাইল, রঘুশাইল, বাদশাভোগ, ভাসামানিক, কার্তিকশাইল, রান্ধনীপাগল, দাদখানি, কটকতারা, বালাম চালের ভাতের তুলনাহীন রসানুভূতি শুধু প্রবীণদের স্মৃতিতেই আছে। নানা গুণে ভরা দেশজ ধানের অধিকাংশ বৈচিত্র্য আমাদের দেশ থেকে চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এরপরও বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, দেশের কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকজন ব্যক্তির প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়ে আসছে সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার ধরনের দেশজ ধান। হারিয়ে যাওয়া স্থানীয় জাতের বিপুলসংখ্যক ধানের তুলনায় তালিকাটি নগণ্য, তবু এখনো যা বাঁচিয়ে রাখা গেছে, তার মধ্যেই রয়েছে বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অনেক ধরনের ধান। এসব দেশজ ধানের গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রয়োজনে বৈজ্ঞানিক উপায়ে উচ্চফলনশীল (উফশী) জাতের ধানে বদল করা যায়। গবেষণার জন্য এ এক অনন্য সংগ্রহ। বিজ্ঞানীরা একে বলেন রাইস জেনেটিক রিসোর্সেস। অধিকাংশ দেশজ ধানই আর নেই বলে ধান গবেষকেরা ‘রিসোর্স’ পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছেন না।

অনেক দেশজ ধানের আছে খরা, লবণাক্ততা ও রোগবালাই প্রতিরোধক্ষমতা। কটকতারা ধান ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধক। হাশিকলমি ধানে টুংরা রোগ কম হয়। কাসালত বা খাসালত নামক দেশজ ধানে রয়েছে ফসফরাস–সহিষ্ণু জিন। জটা বাঁশফুল চাল সহজপাচ্য। দীর্ঘ রোগভোগের পর সেরে ওঠা রোগী কিংবা বৃদ্ধকে এ চালের ভাত পরিবেশন করা হতো। আসামে বোরা নামের স্থানীয় জাতের ধানের চালের ভাত খাওয়ানো হতো জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীকে।

এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো
এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো

হলদিজারণ, বউআদরি, তিলকাফুলি, জামাইআদরি, বাদশাভোগ, বাঁশফুল, কাটারিভোগ, বাসমতী, তুলসীমালা, রান্ধনীপাগল, কাজলমালা, কালামানিক, রানিপছন্দ আর জগসিড়ি চাল সরু, সুগন্ধ ও উত্কৃষ্ট স্বাদের। এসবের হতো ভাত। চিনিগুঁড়া, কালিজিরা, গোবিন্দভোগ, শাইনলা, উকনীমধু, মালশিরা, মুক্তাহার, চিনিকানাই, কাঞ্চনমুখী, ইন্দ্রশাইল, জবসিড়ি, সাপাহার চালের ছিল ম–ম সুগন্ধ। চালগুলো ছিল অতি সরু। রান্না করা হতো পায়েস, ক্ষীর, পোলাও। ডাঙ্গাশাইল, খারমৌ, পানাই, পাজাম, চাংগাই, জশুয়া, বোতা, চালন, গৈজা, গিরি, বাজাইল, কাটাদিয়া ধানে হতো পিঠা। কনকচুর, বাবুইঝাকি, নয়নমণি, খারাজামরি, ঘিগজ, লালহীরা, মুঠা, হাঁসফুলবরণ, আতলৈ, হিদি, লালকুমারী, দলামোটা, মুড়িকোচা ও তিলকাজর ধান ছিল মুড়ির জন্য। খইয়ের জন্য ছিল কাসিয়া, নেদরাবিন্নি, কাইসাবিন্নি, রাঙাবিন্নি, খচিয়াবিন্নি, পোড়াবিন্নি, হুলবিন্নি, লালবিন্নি, সাদাবিন্নি, সাদাবকরি, শনি, খৈইয়ামুকড়ি। মোটাশাইল, শালিকশাইল, রতিশাইল, কারিণশাইল, কার্তিকশাইল, সিন্দুকশাইল, সাদাশাইল, কাটারিভোগ, কামিনীশাইল ধান থেকে তৈরি হতো উন্নত মানের চিড়া। আগালি ধানের চাল দুধেভাতে অত্যন্ত সুস্বাদু। এ যেন চালের অপূর্ব বর্ণবিন্যাস। সরসইরা, মাটিয়াগরল নামের আঠালো মিষ্টি স্বাদে বোনা আমন হতো বিল ও নিম্ন জলাভূমিতে। তালিকাটি অসংখ্য হারিয়ে যাওয়া ধানের সংখ্যার তুলনায় অতি নগণ্য।

দেশে এখন কত ধরনের দেশি ধান আছে, তার একটি তালিকা হয়েছিল বাংলাদেশ রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে, ১৯৮২ সালে। দেখা গেছে, সে সময়ে বাংলাদেশে ১২ হাজার ৪৮৭ ধরনের ধানের চাষাবাদ করা হতো। বিজ্ঞানীরা এখন সরেজমিনে মাত্র দেড় হাজার ধরনের ধানের সন্ধান পাচ্ছেন। অথচ সেই দুই কোরিয়া মিলিয়ে ধান ছিল দুই হাজার রকমের। ১৯০৬ সালে তাইওয়ানে ছিল ৬৭৯ ধরনের ধান। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে বিজ্ঞানী জেপি হেক্টর ভারতীয় ধানের রকম নির্ণয় করে যে তালিকা করেছিলেন, তাতে এ উপমহাদেশে ২০ হাজার রকম ধানের আবাদের খবর পাওয়া যায়।

পৃথিবীর প্রতিটি জাতিরই আছে নিজের উত্পাদিত শস্য এবং শস্যকেন্দ্রিক চর্চা। বাঙালির প্রধান ফসল ধানকে কেন্দ্র করেও রচিত হয়েছে গল্প, প্রবাদ, ধাঁধা, ছড়া, কাব্য, সংগীত। গড়ে উঠেছে ধান নিয়ে লোকসাহিত্যের অসাধারণ এক ভান্ডার। হাজার বছর ধরে মানুষের মুখে মুখে এসব ছড়িয়েছে। বাংলার লোকসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতি নদ-নদীকে বাদ দিয়ে যেমন কল্পনা করা যায় না, তেমনি ধান বাদ দিয়েও নয়।

মধ্যযুগে ধান, চাল ও চালজাত খাদ্যসম্ভার নিয়ে অসাধারণ কাব্য রচনা করেছেন আলাওল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, শ্রীকৃষ্ণকিঙ্কর, রামেশ্বর ও রামাইপণ্ডিত। পরবর্তী সময়ে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্​দীন ও আল মাহমুদ।

এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো
এ দেশে একসময় ১৮ হাজার ধানের জাত ছিল। ছবি: প্রথম আলো

পদ্মাবতী কাব্যে আলাওল বাদশাহি ভোজে বিচিত্র রাজভোগ্য চালের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘চঢ়ে জো চাউর বরণি ন জাহিঁ।/ বরণ বরণ সব সুগঁধ- বগাহী/ রায়ভোগ ঔ কাজর রাণী।/ ঝিনরা রূদরা দাউদখানী বাসমতী কজরী রতনারী।/ মধুকর ঢেলা ঝিণাসারী/ ঘিউ কাঁদৌ ঔ কুঁবর বিলাসু।/ রামরাস আরৈ অতিবাসু।’

দক্ষিণ রাঢ়ভূমির বিখ্যাত কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘রন্ধন’ অংশে পাওয়া যায় দেশজ ধানের এক বিশাল ভান্ডারের খোঁজ। কয়েকটি চরণ:

দাদুসাহি বাঁশফুল ছিলাট করুচি।

কেলেজিরা পদ্মরাজ দুদসার লুচি।। 

কাঁটারাঙ্গি কোঁচাই কপিলাভোগ রান্ধে।

ধুলে বাঁশগজাল ইন্দ্রের মন বান্ধে।।

রান্ধিয়া পায়রারস রান্ধে বাঁশমতি।

কদমা কুসুমশালি মনোহর অতি।।

ভারতচন্দ্রের কবিতায় হারিয়ে যাওয়া ৫০টি দেশি ধানের নাম পাওয়া যায়। এর মধ্যে অতি মনোহর দাদুসাহি, বাঁশফুল, কেলেজিরা (কালিজিরা), পদ্মরাজ, দুদসার, কাটারাঙ্গি, কোচাই, কপিলাভোগ, বাঁশগজাল, পায়রারস, বাঁশমতি, কদমা ও কুসুমশালি ধানও রয়েছে।

অফুরন্ত ধানের সম্ভারে বাঙালি সমৃদ্ধ। এ দেশের সমৃদ্ধ খাদ্যভান্ডার যুগ যুগ ধরে অকৃপণভাবে আমাদের দিয়ে এসেছে খাদ্যনিরাপত্তা। বাংলার চিরায়ত প্রবাদ–প্রবচন ও সাহিত্যে সে কথারই প্রতিধ্বনি। ভারতচন্দ্রের সেই চিরায়ত বাণী সব বাঙালিরই আশীর্বাণী, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে’।

মাহবুব সিদ্দিকী লেখক ও গবেষক