মধ্যবিত্তের ফ্যাশন যাত্রার অগ্রদূত

তত দিনে সাপ্তাহিক বিচিত্রা আমার ঘর আর আঙিনা—দুই–ই হয়ে উঠেছে। আর তা হয়েছে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাজগতের কিংবদন্তি সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর, যিনি শাচৌ নামেই পরিচিত ছিলেন, প্রণোদনায়। আমি বলছি সত্তর দশকের শেষ দিকের কথা। তখন বাংলাদেশে বিরলসংখ্যক নারী সাংবাদিক কাজ করতেন। যাঁরা করতেন, তাঁদের মুখ্যভাগই বসতেন ডেস্কে। শাহাদাত ভাই আমার জন্য বেছে নিয়েছিলেন ভিন্ন এলাকা—আমাদের নাগরিক জীবনযাপন, আনন্দ ও আহার, রুচি ও রাগ, পোশাক ও প্রয়োজন, শিল্প ও সংবেদন এবং নারী। মূলত যে মধ্যবিত্ত আমাদের দেশের মন ও মানসিকতা নিশ্চিত করবে, তাদের কেন্দ্র করে আমার ভাবনা ও চেতনাকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ দিলেন। 

ফ্যাশন সাংবাদিকতায় শাহাদত ভাইয়ের অবদানের কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সাপ্তাহিক বিচিত্রাই ছিল অন্যতম সামাজিক মুখপত্র। ভীষণ আধুনিক, সমাজ থেকে অনেক এগিয়ে থাকা ধ্যানধারণার এই মানুষটি গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। এর পেছনে ছিল তাঁর মুক্তিযুদ্ধ করে দেশে ফিরে আসা বিজয়ীর প্রতিশ্রুতি—দেশ গঠনের প্রয়াস। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উত্তরণ তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

মনে পড়ে, একদিন সম্পাদকীয় মিটিং চলছে। আমরা বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প, বিসিক, রাজশাহীর সিল্কের বিপন্ন অবস্থা নিয়ে কথা বলছি। এমন অবস্থা যে তাঁত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, তাঁতিরা বাধ্য হয়ে দেশি শাড়ির বদলে ভারতীয় ছাপা শাড়ি ঘাড়ে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করছেন। এমতাবস্থায় আমাদের কিছু করতেই হবে। আমি বললাম, আমরা ‘বিচিত্রা ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা’ করতে পারি। এ জন্য আমাদের টিম কিন্তু তৈরি। তিনিই আমাদের মাইলস্টোন। তাঁর দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশের ফ্যাশন সাংবাদিকতায় আমাদের স্বীকৃতি।

শাহাদত চৌধুরী, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল
শাহাদত চৌধুরী, প্রতিকৃতি: মাসুক হেলাল

বস্তুত এক দিনে তা হয়নি। এ জন্য সময় লেগেছে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ সাল ছিল সেই গড়ার সময়। ভিত তৈরির সময়। বয়নশিল্পী, কারুশিল্পী, উদ্যোক্তাদের গড়ে তোলার, আত্মবিশ্বাসী করে তোলার সময়। মেজর ডেভেলপমেন্ট হয়েছে তখনই। অন্যদিকে ভোক্তাদের দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহী করে তোলারও বটে। তারপর আমাদের আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ১৯৮৬ সালেই আমরা শুরু করি সারা দেশ নিয়ে ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতা। ঈদের আগে ঈদের গা থেকে গাম্ভীর্য খুলে ফেলে তাতে মনমাতানো উপকরণ জুড়ে দিলাম আমরাই। কোথায় পাবেন দেশের কাপড়, কী করে নিজে বানাবেন, কোন নির্মাতা আপনাকে আসল খাদি দেবে, কী খাবার রান্না করবেন, ঈদের ছুটিতে কোথায় বেড়াতে যাবেন, কাকে কী উপহার দেবেন, এমনকি ঈদকে কেন্দ্র করে নতুন কোন বইটি নিউমার্কেট থেকে তুলে নেবেন, তা নিয়েও প্রতিবেদন করেছে আমাদের টিম। নিয়মিতভাবে সাপ্তাহিক সন্ধান–এর সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছিল ঈদ ফ্যাশন ও ঈদের বাজারসংখ্যা।

কেবল ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় সব দায় শেষ হয়ে যায় না, বরং এই ইন্ডাস্ট্রি গড়ার জন্য প্রয়োজন ছিল অন্য সব অনুষঙ্গের সংযোজন। মডেলিং এর একটি। আর এই চাহিদা থেকেই শাচৌ শুরু করেন ‘আনন্দবিচিত্রা ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতা’। ১৯৮৮ সালে এই উদ্যোগ আলোর মুখ দেখে। আজকের অনেক বিখ্যাত মুখ ওই প্রতিযোগিতারই ফল। কার নাম ফেলে কারটা বলি। সাপ্তাহিক বিচিত্রা দিয়েই পত্রপত্রিকায় শুরু হয় পেশাদার মডেলিংয়ের যাত্রা। পোশাকের ধারাবাহিকতায় আসে গয়না, জুতা, স্কার্ফ, উত্তরীয়।

বিচিত্রার কাটতি দেখে তত দিনে বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও দৈনিকও তখন অনুরূপ বিভাগ, বস্ত্রশিল্প ও বয়ন নিয়ে চমৎকার সব আয়োজন করতে শুরু করেছে।

আমাদের এ যুগান্তকারী আন্দোলনের যোটক ছিলেন একঝাঁক তরুণ-তরুণী। আরিফ রহমান শিবলী, জসিম মল্লিক, করভি মিজান, এমদাদ হক, ফারিয়া হোসেন, সাবেরী মোস্তফা, লিয়াকত খোকন, মাসুক হেলাল, মুনাওয়ার হোসাইন পিয়াল, ইস্তাম্বুল হক, ইফফাত আজিমসহ আরও অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ আমার সরাসরি ছাত্র, কেউ তাঁদের বন্ধু, কেউ আমাদের পারিবারিক বন্ধুদের সন্তান। কিন্তু অসম্ভব তাঁদের উদ্যম। আর আমার সঙ্গে জুটে গেলেন শাহাদত ভাইয়ের স্ত্রী ও আমার বন্ধু সেলিনা চৌধুরী। আমরা দুজন শাচৌর মুখে নামোচ্চারণমাত্র রাস্তার পাশের দোকান থেকে শুরু করে আড়ংয়ের পোশাক মজুতকক্ষে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি। আমাদের বিচিত্রা সহকর্মী ও বন্ধুদের সন্তানরাই এ দেশের বাংলাদেশি পোশাক বিজ্ঞাপনের প্রথম শিশু-কিশোর মডেল। সে বিপাশা ও নাতাশা হায়াত, শমী কায়সার থেকে শুরু করে ঈশিতা, সজীব, শাসা, এষাও। ছবি তুলছেন শাচৌ নিজে, শামসুল ইসলাম আলমাজী, রফিকুর রহমান রেকু। মাজী বা রেকুর অন্য অ্যাসাইনমেন্ট থাকলে যাতে আমি ঠেকায় না পড়ি, তার জন্য গুরুই আমাকে ফটোগ্রাফিতেও দিয়েছিলেন হাতেখড়ি। নিপুণের নির্মাতা ভ্রাতৃপ্রতিম আশরাফুর রহমান ফারুক তার গাড়িভরা পোশাক ও মডেল নিয়ে হাজির হয়েছে বিচিত্রা ফ্যাশন হাব আমার ধানমন্ডির ভাড়া বাড়িতে। 

একটি দোকানে কাপড় পছন্দ করছেন নারীরা। ছবি: আবদুস সালাম
একটি দোকানে কাপড় পছন্দ করছেন নারীরা। ছবি: আবদুস সালাম

আমি বাংলাদেশি পোশাক নিয়ে এলাম বন্ধু নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর প্রযোজনায় আমার টিভি শো ‘জীবন যেমনে’ও, যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দেশি পোশাকের লাইভ ক্যাটওয়াক, প্রতিযোগিতা এবং তাৎক্ষণিক বিচার ও পুরস্কার প্রদান। রামপুরা স্টুডিওর ছিল না ক্যাটওয়াক নির্মাণের কোনো অভিজ্ঞতা। শাচৌ তা এঁকে আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। তাঁর কারণেই আমাদের ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতার টিমে যোগ দিয়েছেন রফিকুন নবী, শহিদুল্লাহ খান বাদল, নায়লা খান, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, আবুল বারক আলভী, বিবি রাসেল। বিচিত্রার কারণে মডেল হয়েছেন ববিতা, চম্পা, শান্তা চৌধুরী, সাবা তানি, ফাহমিদা ও সামিনা চৌধুরী, মিনু বিল্লাহ, কায়সার হামিদ, টুটুল, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়সহ অনেকে।

বাংলাদেশের মানুষকে বাংলাদেশি লাইফস্টাইলের প্রতি ঘাড় ঘুরিয়ে দিতে পেরেছিলাম শাহাদত চৌধুরীর কারণেই।

এখানে একটা কথা অবশ্যই বলতে হবে। পৃথিবীর সব দেশেই ফ্যাশন উচ্চবিত্তের করায়ত্ত হলেও বাংলাদেশে তা মধ্যবিত্তের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া গেছে বিচিত্রা ও শাচৌর কারণে। বিনয়ের সঙ্গে বলি, সে পথযাত্রায় আমিও ছিলাম এক সহযাত্রী। এ আমার এক বিরাট গর্ব।


শামীম আজাদ কবি ও কথাসাহিত্যিক