ঢাকার একক কেন্দ্রিকতার সমস্যা

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৪৪ হাজার মানুষ বাস করে। ছবি: প্রথম আলো
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৪৪ হাজার মানুষ বাস করে। ছবি: প্রথম আলো

আয়তনের দিক থেকে ছোট্ট এই দেশে একদিকে যেমন ভূমির পরিমাণ কম, অন্যদিকে জনসংখ্যার পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। অথচ সেই অনুযায়ী সম্পদের অপ্রতুলতাও রয়েছে। দেশে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর (শতকরা ১ ভাগ) কৃষিজমি অকৃষি খাতে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। এতে খাদ্যনিরাপত্তা যেমন হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে, তেমনি দেশ জলাভূমি, বন ও তার জীববৈচিত্র্য হারাচ্ছে। সমগ্র দেশকে নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে ভৌত অবকাঠামো, ভূমি ব্যবহার, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে দেশের বিদ্যমান আঞ্চলিক অসমতা দূর করা ও টেকসই উন্নয়ন সম্ভব।

বাংলাদেশের নগরায়ণের পরিপ্রেক্ষিত

বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নে শহর ও নগরের ভূমিকা ক্রমশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নগর জনগোষ্ঠী ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ ভাগ এবং বর্তমানে সেই সংখ্যা ৩৫.৮ শতাংশের বেশি। এই ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৪০ সালে নগর ও গ্রামীণ জনসংখ্যা সমান হয়ে যাবে। দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন, ৩২৮টি পৌরসভা ও অন্যান্য ছোট–বড় নগরকেন্দ্র মিলে মোট নগর জনসংখ্যা পাঁচ কোটির বেশি। নগরগুলোর সম্মিলিত ভৌগোলিক আয়তন ১১ হাজার ২৫৮ বর্গকিলোমিটার (দেশের আয়তনের শতকরা মাত্র ৭.৬৬%) হলেও জাতীয় উৎপাদনে নগরের অবদান শতকরা ৬০ ভাগের বেশি।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বর্ধিত জনগোষ্ঠীর জন্য আবাসন, পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, যোগাযোগসুবিধা ইত্যাদি পরিষেবা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিকল্পিত নগরায়ণ না হলে এ চ্যালেঞ্জ সরকারের পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভবপর নয়। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জন করার জন্যই টেকসই নগরায়ণ প্রয়োজন। উৎপাদনশীলতার বিবেচনায় নগর হলো অপার সম্ভাবনার উৎস। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে নগরায়ণের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার উদ্দেশ্যে ‘জাতীয় নগর নীতিমালা’ প্রণয়ন করা হয়েছে, যা নগর জনগণকে সব পরিষেবা প্রদানে সক্ষম হবে।

ঢাকা শহর বলতে কী বোঝায়?

বাংলাদেশের সংবিধানের ৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর সীমানা আইন দ্বারা নির্ধারিত হইবে’। তাহলে রাজধানী বলতে কি ঢাকা জেলা নাকি ঢাকা শহর? যদি জেলা হয়, তবে এর একটি সীমানা আছে কিন্তু যদি শহর হয়, তবে সেই শহর কোনটি? ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তর নাকি দক্ষিণ? নাকি দুটির সম্মিলিত অংশ? নাকি ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা। কিন্তু ঢাকা মেগাসিটির বিস্তৃতি তো অনেক বেশি। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ‘ঢাকা শহর’ তো আরও বড়। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভৌগোলিক আয়তন প্রায় ২৭০ বর্গকিলোমিটার। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা বলতে সাধারণত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং এর আশপাশের সংলগ্ন কিছু এলাকা বোঝানো হয়ে থাকে, যার আয়তন প্রায় ৩৬০ বর্গকিলোমিটার।

রাজউকের সর্বশেষ ২০ বছরের (২০১৬-৩৫) পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য রিজিওনাল ডেভেলপমেন্ট প্ল্যানের (আরডিপি) পরিকল্পনা সীমানা ধরা হয়েছে চারটি সিটি করপোরেশন (ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ) ও চারটি পৌরসভা (সাভার, টঙ্গী, কালীগঞ্জ, তারাবো, সোনারগাঁ) এবং ৭০টি ইউনিয়ন পরিষদসহ ১ হাজার ৫৪২ বর্গকিলোমিটার।

ঢাকা শহর ও একক কেন্দ্রিকতা

প্রতিবছর এই শহরে নতুন করে যোগ হয় ৬ লাখের বেশি মানুষ। ঢাকা শহর পরিণত হয়েছে বিশ্বের নবম জনবহুল মেগাসিটিতে। শুধু দেশের রাজধানী হওয়ার কারণে নয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, চিকিৎসা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সব বিবেচনায় এই শহর তৈরি হয়েছে দেশের একক কেন্দ্র হিসেবে। সমগ্র দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে অব্যাহতভাবে কেন্দ্রমুখী উন্নয়নদর্শন একটি বিরাট সমস্যা, যা ঢাকামুখী গ্রামীণ মানুষের স্রোতকে অব্যাহত রেখেছে। শহরে এত মানুষকে ধারণ করার জন্য প্রয়োজনীয় আবাসন, পরিবহনব্যবস্থা, সামাজিক ও নাগরিক পরিষেবা ইত্যাদি চাহিদামাফিক তৈরি হয়নি। ১৯৫৯ সাল থেকে এই শহরের জন্য মাস্টারপ্ল্যান থাকার পরও দুর্বল নগর পরিচালনের কারণে শহরের উন্নতি হয়েছে অপরিকল্পিতভাবে। শুধু নব্য উদার অর্থনীতির স্থূল বাজারদর্শন দিয়ে নগরের উন্নয়ন করা হলে সেটা ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়ণ’ হবে না। শহরকে গড়ে তুলতে হবে সবার জন্য মানবিক ও বাসযোগ্যরূপে। ভূমি ব্যবহার, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সব বিষয় নিয়ে মানবিক শহর তৈরির সমন্বিত ‘ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা’ করতে হবে।

ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা ও বাস্তবতা

বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন শহরের ওপর জরিপ থেকে দেখা যাচ্ছে যে বসবাসযোগ্যতার সূচকে ঢাকার অবস্থান একেবারে তলানির দিকে। একটি ভালো ও সার্থক শহর হতে গেলে যেসব নিয়ামক একটি শহরে থাকে, তার অনেক কিছুই অনুপস্থিত অথবা অপ্রতুল আছে আমাদের এ শহরে। তবে যে বিষয়গুলোর অভাব প্রকটভাবে সবার ওপর আসবে, তার মধ্যে আছে পরিবহনব্যবস্থার দুরবস্থা, পানিনিষ্কাশনের দুর্দশা, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তদের মানসম্মত আবাসনের অভাব, সবুজ ও উন্মুক্ত স্থানের অভাব, মানসম্পন্ন অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অপ্রতুল নাগরিক পরিষেবা ইত্যাদি।

ঢাকার জনঘনত্ব

ইউএন হ্যাবিট্যাটের ২০১৭ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে সাড়ে ৪৪ হাজার মানুষ বাস করে। পৃথিবীর সব মেগাসিটির মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ ঘনত্বের শহর। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারতের মুম্বাই, যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৩১ হাজার ৭০০ জন।

ভালো পরিবহনব্যবস্থার অভাব

ঢাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যানবাহন ও পরিকল্পিত পরিবহন অবকাঠামোর অভাব রয়েছে। আমাদের পরিকল্পনাগুলো পদচারী ও গণপরিবহনব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রণীত হলেও বাস্তবে ঢাকার পরিবহনব্যবস্থা গণমুখী হয়ে গড়ে ওঠেনি। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে পরিবহনব্যবস্থা চলছে। ঢাকা শহরের জন্য সংশোধিত পরিবহনকৌশল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) প্রণীত হয়েছে। তার আলোকে গণপরিবহনব্যবস্থাকে অত্যন্ত জরুরি ও অত্যাবশ্যক জ্ঞান করে দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। আধুনিক নগর–পরিকল্পনার ধারণাকে সমুন্নত রেখে গণপরিবহনব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং ব্যক্তিগত গাড়ির নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। একটি কার্যকর, বিশ্বস্ত ও আরামদায়ক গণপরিবহনব্যবস্থাই পারে ব্যক্তিগত গাড়ির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে।

এটা একটি শুভ লক্ষণ যে বর্তমানে পরিবহনকৌশল পরিকল্পনা (২০১৬-৩৫) অনুযায়ী কিছু কিছু কাজ শুরু হয়েছে। তবে মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনার প্রস্তাবিত অগ্রাধিকার তালিকা ভেঙে ওভারপাস/ফ্লাইওভার তৈরি করে পরিবহন সমস্যা দূর করা যাবে না। পৃথিবীর অনেক দেশ এই সব ফ্লাইওভার ভেঙে মানুষের চাহিদামাফিক উপযুক্ত পরিবহনব্যবস্থা চালু করেছে।

শুধু সড়ক নির্ভর পরিবহনব্যবস্থা দিয়ে এত বড় মেগাসিটিকে সচল রাখা যাবে না। সড়কের পাশাপাশি রেল ও নদীপথে পরিবহনকে উন্নয়নে জোর দিতে হবে।

খাসজমি দখল ও জলাবদ্ধতা

বর্তমানে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এ শহরের জন্য নানা সময় ড্রেনেজ স্টাডি ও মহাপরিকল্পনা তৈরি হলেও যথাসময়ে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ ছাড়া রাজউকের ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা ও ড্যাপ অনুযায়ী শহরের ভূমি ব্যবহার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে না পারার কারণে ঢাকা শহরের আশপাশের জলাভূমি, নিম্নভূমি, খাল, নদী বেদখলের শিকার হয়েছে এবং বর্ষা মৌসুমে পানি ধারণের স্থান কমে গেছে।

সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন

আবাসনের গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ একে মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ শহরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মানসম্পন্ন আবাসন নেই। নগর নীতিমালা কিংবা আবাসন নীতিমালায় কিছু দিকনির্দেশনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন খুব সামান্যই দেখা যায়। দেশে গৃহীত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিমালাতেও ‘সকলের জন্য আবাসন’ নীতিকে গ্রহণ করেছে।‘জাতীয় আবাসন নীতিমালা ২০১৭’-তেও সবার জন্য আবসনের কথা বলা হয়েছে। যদিও বাস্তবে সেই লক্ষ্য অর্জনে যথাযথ উদ্যোগের পরিমাণ অত্যন্ত সামান্য। শুধু রাজধানী ঢাকাতেই শতকরা ৩৫ ভাগ মানুষ বাস করে নিম্নবিত্ত বস্তি ও অনানুষ্ঠানিক বসতিতে। বর্তমানে ঢাকা শহরের আবাসন সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের অবদান মাত্র ৭ ভাগ। বাকি ৯৩ ভাগ আবাসন তৈরি হয় ব্যক্তি উদ্যোগে, যার একটা অংশ আসে রিয়েল এস্টেট উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে। রাজউকের অনেক আবাসিক এলাকায় ২০ বছর ধরে উন্নয়নপ্রক্রিয়া চললেও বাস্তবে আবাসন মার্কেটে অবদান রাখতে পারেনি। তাই আবাসনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত প্লট ব্যবসা থেকে বের হয়ে ব্লক ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করা। সেটা বিক্রয় ও রেন্টাল—দুই পদ্ধতিতে হতে পারে। তবে ভূমির মূল্য নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আবাসনের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা গেলে জনগণ উপকৃত হবে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের জন্য গৃহঋণ সহজ করা গেলে আবাসন খাতে একটা বিরাট পরিবর্তন আসবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নগর উন্নয়ন

নগরের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও নগর–পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না। গণপরিসর ও নাগরিক সুবিধাগুলো ডিজাইন ও প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নারীদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনা করা হলে সেটা নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়ো সবার জন্য ভালো শহর হতে পারে।

আগামী দিনের ঢাকা

বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্যম আয়ের দেশের দিকে এগোচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ঢাকার সমস্যা সমাধান যেমন জরুরি, তেমনি ঢাকা ছাড়া অন্যান্য বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহরকে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে উন্নয়ন জরুরি। এসব নগরে কর্মক্ষেত্রের সুযোগ সৃষ্টি, মানসম্পন্ন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া গেলে ঢাকার ওপর চাপ কমে আসবে। আমাদের প্রতিটি নগরীকে বিবেচনায় এনে তাদের মধ্যে অসমতা দূর করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। ঢাকা থেকে প্রশাসনিক, অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন কাজকে বিকেন্দ্রীকরণ করা অত্যন্ত জরুরি। ঢাকাকেন্দ্রিক অনেক কাজ রয়েছে, সেসব কাজের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করে তা ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া যায়। কেবল ঢাকা নয়, সারা দেশ নিয়ে কাজ করতে হবে।

ভবিষ্যৎ ঢাকার সাফল্য অনেকাংশে নির্ভর করবে এ শহরের সহজ যোগাযোগের দূরত্বে থাকা নগরকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে কতটা সফল ও কার্যকর যোগাযোগের মাধ্যম সৃষ্টি করা যায়। সমন্বিত আঞ্চলিক পরিকল্পনা করে এসব নগরকেন্দ্রের সঙ্গে সড়ক ও রেলের মাধ্যমে ঢাকাকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এতে নগরগুলো পরস্পরের কাছ থেকে উপকৃত হবে এবং মাঝের প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা যাবে।

গত এক দশকের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও মেগাপ্রকল্প

এক দশকে ধরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের জোর প্রচেষ্টা লক্ষ করা গেছে। দেশব্যাপী সরকারের ‘ভিশন ২০২১’, ‘ভিশন ২০৪১’ ও শতবর্ষের ‘ডেল্টা প্ল্যান’–এর কাজ হতে দেখা গেছে। সরকার এমন সব মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করেছে, যা সারা দেশের উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে। বর্তমানে সারা দেশে অনেকগুলো মেগাপ্রকল্প, মাঝারি ও ছোট প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলমান। গত ১০ বছরে দেশের জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিও পেয়েছে।

দেশে এত বড় বড় মেগাপ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে কথাগুলো বারবার এসেছে সেগুলো হলো দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে প্রকল্প গ্রহণ, মাত্রাতিরিক্ত প্রকল্প ব্যয়, প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা ইত্যাদি। দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে অবকাঠামোগত এসব প্রকল্প সম্পূর্ণ করা গেলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।

আমার গ্রাম আমার শহর

সরকারের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহার ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি গ্রামে নগরসুবিধা সম্প্রসারণের কাজ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শুরু হয়েছে। তবে এই কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গ্রামের প্রতিবেশ ও পরিবেশ, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে।

একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল

বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার কাজের মধ্যে রয়েছে সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ১০০টি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল উন্নয়ন। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে পরিকল্পিত আবাসন, যোগাযোগ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য নাগরিক পরিষেবা নিশ্চিত করা গেলে সেসব স্থানে পরিকল্পিত নগরায়ণ সম্ভব হবে।

উপসংহার

ঢাকা শহরের একক কেন্দ্রিকতা কমাতে সমগ্র দেশের সার্বিক সুষম উন্নয়নে ঢাকাসহ সব নগরের জন্য ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, পরিবহন পরিকল্পনা, ড্রেনেজ পরিকল্পনাসহ অন্যান্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা খুব জরুরি। সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না গেলে আমাদের সমস্যার আবর্তেই ঘুরপাক খেতে হবে। যেকোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সামাজিক সাম্য, সামাজিক ন্যায়বিচার, আর্থসামাজিক অবস্থা, পরিবেশ, আর্থিক সামর্থ্য ইত্যাদি বিবেচনায় এনে সঠিকভাবে শহরের অন্তর্ভুক্তিমূলক জনবান্ধব পরিকল্পনা তৈরি হবে। তবে সবকিছুর ওপরে আছে একটি ভালো নগর পরিচালন পদ্ধতি। সুশাসন নিশ্চিত না করে ভালো শহর গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

আকতার মাহমুদ নগর পরিকল্পনাবিদ; অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সহসভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)।