বাংলাদেশের জমির মালিকানা বেশ জটিল : মুজিবর রহমান হাওলাদার

ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার
ড. মুজিবর রহমান হাওলাদার
মুজিবর রহমান হাওলাদার বর্তমানে নদী কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইফতেখার মাহমুদ

প্রথম আলো: আমরা যদি দেশের সব মানুষের আবাসনের কথা ভাবি, সেটা কী সম্ভব?

মুজিবর রহমান হাওলাদার: বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে ভূমি নিয়ে বৈষম্য দূর করার একটি মনোভাব ছিল। এক রাষ্ট্রে কিছু মানুষের কাছে অনেক বেশি ভূমির মালিকানা থাকলে বেশির ভাগ মানুষ ভূমিহীন থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে স্বাধীনতার পরপর বঙ্গবন্ধু একজন নাগরিক সর্বোচ্চ কতটুকু জমির মালিক হতে পারবেন এর একটি সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন। ১৯৮৪ সালে ভূমি সংস্কার আইন জারি করা হয়। বাংলাদেশ ভূমি সংস্কার আইন নামে ওই আইন অবশ্য কখনোই পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন ১৯৫০ এর ৮৬ ধারা অনুযায়ী কারও যদি নদীভাঙনের কারণে জমি বিলীন হয়ে যাওয়ার ফলে ৩০ বছরের মধ্যে একই স্থানে পয়স্তিলবদ্ধ পুন: উদ্ভব (Reformation-in-situ)হলে তার মালিক উক্ত আইনের ৮৬(৫) উপধারার বিধান অনুযায়ী ৬০ বিঘার বেশি জমির মালিকানা লাভ করতে পারবে না। অর্থাৎ ৬০ বিঘার অতিরিক্ত জমি সরকারের মালিকানা ও ব্যবস্থাধীনে থাকবে।

প্রথম আলো : এসব আইন কি কার্যকর? প্রয়োগ হয়?

মুজিবর: মাঝেমধ্যে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তা তা প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। সরকার ভূমিহীনদের জন্য জমির বরাদ্দ দেওয়ার অনেকগুলো প্রকল্প করেছে। এই দিক থেকে বাংলাদেশ বেশ স্বতন্ত্র ভূমিকা রাখছে। পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশে ভূমিহীনদের জমি, বাড়িঘর ও জীবিকার ব্যবস্থা করা হয় না। বাংলাদেশে আমরা তা করছি। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা এখনো করা যায়নি। তবে সরকার গুচ্ছ্গ্রাম ও আশ্রয়ন প্রকল্পের অধীনে গত ৪-৫ বছরে ৫০ হাজার ভূমিহীন ও গৃহহীনকে আশ্রায়নের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে চলছে। সামগ্রিকভাবে দেশে বণ্টনযোগ্য কী পরিমাণে জমি আছে, আর তা ভূমিহীনদের মধ্যে কীভাবে বণ্টন করা যায়, তা নিয়ে কোনো সামগ্রিক জরিপ হয়নি। এটা হলে আমরা বলতে পারব সবার জন্য আবাসনের ব্যবস্থা কীভাবে করা যাবে।

প্রথম আলো : ভূমিহীনদের জন্য জমি বরাদ্দ এবং ভূমির ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোর কোনো উপায় আছে কি?

মুজিবর: আমি জাপানে বাংলাদেশ সরকারের ইকোনমিক মিনিস্টার হিসেবে কাজ করেছি। সেখানে আমি দেখেছি, বাবার জমিও সন্তান নিতে চায় না। কারণ, একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি জমির মালিক হতে হলে বিপুল পরিমাণে ট্যাক্স দিতে হয়। ওই কর দিয়ে জমির মালিক হলে অনেক ক্ষেত্রে উল্টো লোকসানে পড়তে হয়। বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে ধনীরা মারা গেলে তার সম্পত্তি জনস্বার্থে ব্যয়ের জন্য দেওয়া হয়। তাদের সন্তান বা উত্তরাধিকারীগণ ওই সম্পত্তি ভোগ করতে পারে না। আমাদের দেশেও জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বা সিলিং বেঁধে দেওয়ার আইনটি কার্যকর করতে হবে।

ইফতেখার : আগের আইনটি কি এখন কার্যকর করলেই সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করা যাবে?

মুজিবর: আগের যে আইন, তা হালনাগাদ করতে হবে। কেননা, সেখানে জমির মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা বলতে কৃষিজমির কথা বলা হয়েছে। গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা শহরের জমির দাম ও ধরন আলাদা। সেখানে একই পরিমাণে জমির মালিকানার সীমা রাখলে হবে না। আবার ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো বড় শহরগুলোতে বেশির ভাগ মানুষ ফ্ল্যাটে থাকে। সেখানে কে কতটি বািড় ও ফ্ল্যাট এবং কত সাইজের ফ্ল্যাটের/বাড়ীর মালিক হতে পারবে, তার একটি সীমারেখা রাখতে হবে। যেমন এখন শুনি অনেকে আটটি-দশটি ফ্ল্যাটের মালিক হচ্ছেন। এটা তো হতে পারে না। আবার এই শহরের বেশির ভাগ মানুষের নিজের কোনো ফ্ল্যাট নেই। তাঁরা অনেক ভাড়া দিয়ে অন্যের ফ্ল্যাটে থাকেন। বিপুল পরিমাণে মানুষ বস্তিতে থাকেন। অনেকে শহরের রাস্তায় থাকেন। ফলে সবার জন্য চিন্তা করে ভূমি সংস্কার আইনটি হালনাগাদ করতে হবে। নয়তো সবার জন্য আবাসন নিশ্চিত করা যাবে না।

প্রথম আলো : পার্বত্য এলাকা ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসতি ও ভূমির মালিকানা নিয়ে কী মনে হয়?

মুজিবর: বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামে ভূমির মালিকানা নিয়ে অনেক অমীমাংসিত সমস্যা রয়ে গেছে। সেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভূমির অধিকার ও মালিকানার ধরন অন্যদের চেয়ে আলাদা। পার্বত্য চুক্তি অনুযায়ী সেখানে একটি ভূমি জরিপ হওয়ার কথা ছিল। সেটা এখনো হয়নি বা করা যায়নি। আর সেখানে সমতল থেকে যাওয়া বাঙালিদের ভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো অনেক হাতবদল হয়েছে। অনেকে সেই জমি সমতলের অনুপস্থিত মালিকদের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তাঁরা ওই জমিতে রাবার ও ফলবাগান করেছেন। অনেকে ওই সব জমিতে বড় বড় অবকাঠামো গড়ে তুলেছেন। ফলে পার্বত্য অঞ্চলের ভূমির বিষয়টি বেশ জটিল অবস্থায় আছে। সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভূমির অধিকারের বিষয়টিও প্রায় একই অবস্থায় আছে। তাই আমাদের সবার আগে সেখানকার ভূমি জরিপের কাজে নজর দেয়া দরকার। এছাড়া এ অঞ্চলে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনও গঠিত হয়েছে, তবে এখনও কার্যকর কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ভূমির অধিকারের বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। ছবি: হাসান রাজা
নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ভূমির অধিকারের বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। ছবি: হাসান রাজা

প্রথম আলো : নদীভাঙন, চর এলাকা ও খাসজমির বণ্টনের বিষয়টি কী অবস্থায় আছে?

মুজিবর: নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের ভূমির অধিকারের বিষয়টি এখনো সুনির্দিষ্ট হয়নি। চর এলাকা মানে হচ্ছে নতুন জেগে ওঠা ভূমির কথা আমরা বলছি। কিন্তু এসব জমি তো আসলে নদী ও সাগরের অংশ। সেগুলোতে জেলা প্রশাসন থেকে ভূমিহীনদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। অনেকে বরাদ্দ ছাড়াই বসতি গড়ে তুলেছেন। কিন্তু এসব ভূমিকে টেকসই করতে সরকারের একটি নীতিমালা ছিল। তা হচ্ছে, এসব জমিতে আগে বনায়ন করতে হবে। ভূমি পরিণত হলে ও তা নদীর প্রভাবে কোনো বড় ধরনের বাধা সৃষ্টি না করলে তা ভূমিহীনদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে।

তবে এসব জমি বরাদ্দ দেওয়া নিয়ে নানা ধরনের অনিয়মও আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি, ভূমিহীনরা অন্যদের কাছে তাঁদের জমি বিক্রি করে দেন। আবার সরকারি নানা প্রতিষ্ঠান চর ও দ্বীপের জমি বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছে।

সম্প্রতি আমরা দেখছি বঙ্গোপসাগরের বেশ কয়েকটি দ্বীপ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার ব্যবস্থাপনায় দেয়া হয়েছে বা ইজারা নিয়ে নিয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি বিভিন্ন ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সেখানে ভবন এবং হোটেল-মোটেল নির্মাণ করেছে। তারা এগুলো করতে পারে না। কেননা, সেন্ট মার্টিনের ক্ষেত্রে আমি এর ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখেছি, মোগল আমলে এটি ছিল ভারত সম্রাটের মালিকানাধীন। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ওই ভূমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানায় যাওয়ার কথা। কোনো ব্যক্তি সেখানকার ভূমির মালিক হতে পারে না। সোনাদিয়া দ্বীপের ক্ষেত্রে দেখেছি সংরক্ষিত বনে শিল্প ও নানা অবকাঠামো নির্মাণের চেষ্টা চলছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও সেখানে এসব অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে তাঁর আপত্তি জানিয়েছেন। ফলে সব ভূমিতে বসতি বা শিল্পকারখানা হলে চলবে না। কিছু ভূমি পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য ছেড়ে দিয়ে রাখতে হবে।

প্রথম আলো: দেশের জলাভূমি এবং নদীর জমি ভরাট করে আবাসন ও অবকাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে সরকারের ভূমিকা কী হওয়া উচিত?

মুজিবর: কৃষিজমি, জলাভূমি ও নদীর জমির ভরাট করা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ এমনকি জলাধার আইন ২০০০ এও ভরাট বা দখল দন্ডনীয় অপরাধ। আমরা এসব দখলদারের একটি তালিকা তৈরি করেছি। সমাজের সব স্তরের মানুষই এসব দখলের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করে এসব করা হচ্ছে। সরকার এসব অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের কাজ শুরু করেছে। সামনের দিনে এসব উচ্ছেদ অভিযান আরও তীব্র ও দ্রুত হবে। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, জেলা প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি সংস্থাগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তা করছে। এ ক্ষেত্রে অনেক বাধা আসছে। কিন্তু আমরা এসব বাধা মানব না।

প্রথম আলো : দেশে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় জমির মালিকানা নিয়ে। এসব মামলার জট অনেক দীর্ঘ? এ ব্যাপারে কিছু কি করা যায় না?

মুজিবর: বাংলাদেশের জমির মালিকানার বিষয়টি বেশ জটিল। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশের জমির পরিমাণ চাহিদায় খুবই কম। বাবা সব সন্তানের মধ্যে জমি লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনখানে কার জমি হবে, অবস্থান নিয়ে জটিলতা থেকে যায়। জমির মালিকানার হা, স্বত্ব ও স্বার্থ, অধিকার অনেকবার বদল হয়। সব সময় সবার কাছে এসব মালিকানার প্রয়োজনীয় নথি থাকে না। ভূমির অনেকগুলো জরিপ সিএস, আরএস, বিএস ইত্যাদি হয়েছে, সেখানে একজনের জমি অন্যের নামে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুলক্রমে কিংবা নানাবিধ কারণে নিবন্ধিত হয়েছে। ফলে এসব জটিলতা নিয়ে অনেক মামলা ও জটিলতা রয়ে গেছে। তবে এসব জটিলতা যতটা না আইনের, তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও ব্যক্তি বা গোষ্টী স্বার্থের।

প্রথম আলো: জমি নিবন্ধনের অটোমেশন কী হলো?

মুজিবর: এটিও একটি জটিল প্রক্রিয়া। কারণ, বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমির মালিকানার প্রয়োজনীয় সব কাগজ সবার কাছে নেই। জমির সীমানা নির্ধারণ নিয়েও নানা জটিলতা আছে। ফলে অটোমেশনের কাজটি খুব সাবধানে ও সময় নিয়ে করতে হবে। যাতে একজনের জমি অন্যের নামে নিবন্ধিত না হয়ে যায়, তা খেয়াল রাখতে হবে। এটি শুরু করার পর শেষ করতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় লাগবে। তবে এটি অবশ্যই দ্রুত শুরু করতে হবে। প্রাথমিকভাবে পাইলট ভিত্তিতে কোথাও করা যেতে পারে। সাভারে এটি পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছিল। এর জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা করতে হবে।