চলিই বা কেন, থামিই বা কেন

অবিশ্বাস্য হারে, বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছবি: আশরাফুল আলম
অবিশ্বাস্য হারে, বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছবি: আশরাফুল আলম

প্রথমেই বলে নেওয়া আবশ্যক মনে করি যে এই নিবন্ধে আগাগোড়াই একধরনের হতাশার আবহ স্পষ্টতর বলে মনে হতে পারে। তার কারণ আছে। যে সংগীত নিজেই করুণ, তার অনুভব উল্লাসের নয়, নৈরাশ্যের; উচ্ছ্বাসের নয়, দুঃখের; আনন্দের নয়, বেদনার এবং শিল্পে, সাহিত্যে বা লেখায় সেই বেদনার সত্যকে যথার্থ ফুটিয়ে তোলাও কঠিন। সীমাবদ্ধ এই নিবন্ধের পরিসরে তার সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস তাই আংশিক ও অসমাপ্ত।

‘গৃহ’ কেবল প্রতীকী অর্থে একটিমাত্র ঘরের পরিপ্রে‌ক্ষিত রচনা করলেও আশা-আকাঙ্ক্ষা-আবেগের সেটি এক সমন্বিত গন্তব্য। গৃহ একজন মানুষের ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতা দেয়, স্বীকৃতি দেয়। রবীন্দ্রনাথের লেখায় আছে: ‘যাহার গৃহ নাই, আশ্রয় নাই, তাহার পদক্ষেপের মধ্যে আশা নাই, অর্থ নাই; তাহার পদক্ষেপের দক্ষিণ নাই, বাম নাই; তাহার চরণ যেন বলিতে থাকে, আমি চলিই বা কেন, থামিই বা কেন—তাহার পদক্ষেপে আমার শুষ্ক ধূলি যেন আরও শুকাইয়া যায়।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজপথের কথা)

কিন্তু মহানগরের বস্তিগুলোতে শতসহস্র ঘিঞ্জি গৃহের যে সমাবেশ, যে ছিন্নমূল মানুষের বসবাস, এই কি সেই গৃহ? এই গৃহসমষ্টি, যা পরিণত হয়েছে বস্তিতে, তা কখনোই সেই আশা–আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে না। মূলত এই নগর বস্তিগুলোতে অমানবিক জীবনযাপনের সম্ভবত সবকিছুই আছে। এখানে পানীয় জল নেই, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা নেই, নিয়মমতো বিদ্যুৎ বা গ্যাসের সরবরাহ নেই, এমনকি এসব বস্তিতে সহজে প্রবেশযোগ্য রাস্তাও নেই। যেকোনো দুর্ঘটনায় (যেমন অগ্নিকাণ্ড বা অসুস্থতার সময়) কোনো যানবাহন সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। অগ্নিশিখার করাল গ্রাস ঘণ্টার ব্যবধানে বস্তিকে ভস্মস্তূপে পরিণত করে।

তবু অবিশ্বাস্য হারে, বস্তি ও বস্তিবাসীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার মতো মেট্রোপলিটন মহানগরে। ১৯৭৫ সালে ঢাকা নগরীতে যেখানে ২.৭৫ লাখ বস্তিবাসী ছিল, ২০০৫ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৪ লাখে উপনীত হয় (বিস্তারিত পরে বলছি)। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিভিন্ন কারণে, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশগত বিপর্যয়, ভূমি বা বসতবাটি হারিয়ে শহরের দিকে ধাবিত হয় ছিন্নমূল মানুষেরা। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত এক দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৬৮ লাখ মানুষ (আরডব্লিউআই, আইইউবি; ৫ অক্টোবর ২০১৯, প্রথম আলো)। নাগরিক সুবিধার ছিটেফোঁটাও না পেয়ে প্রথমেই তারা বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য বিবেচনায় একটা কাজ জুটিয়ে নেয়। রিকশা বা ভ্যান টানা, মুটে–মজুর–কুলির কাজ, যা মূলত ইনফরমাল ধরনের; গৃহকর্মী হিসেবেও কাজ শুরু করেন অনেক নারী। লক্ষণীয় যে প্রাথমিকভাবে এই কাজের বিনিময়ে তাঁরা ক্ষুধা নিবারণের প্রয়াস পান। কিন্তু থাকার জায়গা? রাত্রিযাপন? স্বাভাবিকভাবেই তার সূত্রপাত ঘটে বস্তিতেই।

মহানগরগুলোতে মূলত দুই ধরনের বস্তি আছে। এক. ব্যক্তিমালিকানাধীন বস্তি এবং দুই. সরকারি সংস্থা কর্তৃক অব্যবহৃত এলাকায় গজিয়ে ওঠা বস্তি। ধরে নেওয়া হয়, দ্বিতীয় পর্যায়ের এই বস্তি বেআইনি, জবরদখলকারী। সব ধরনের উচ্ছেদ অভিযানে এঁরাই হয় প্রাথমিক শিকার।

কিন্তু প্রথম পর্যায়ের ব্যক্তিমালিকানাধীন বস্তি এক সুনিপুণ বাণিজ্যিক সফলতার প্রতীক হিসেবে বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। একটা প্রতীকী উদাহরণ দিচ্ছি: ১০ কাঠা বা ৭ হাজার ২০০ বর্গফুট পরিমাণের একটি জায়গায় ক্ষুদ্র আয়তনের (ধরা যাক ৮‌ x ৯‌ মাপের) প্রায় ১০০টি প্লটে ভাগ করে ফেলা যাবে। যেহেতু এখানে হাঁটা–চলাফেরার জন্য গলিপথ রাখতে হবে, তাতে কিছুসংখ্যক প্লট বাদ যাবে।

এই কারণে আনুমানিক ৩০টি প্লট হিসাব থেকে কমিয়ে দিলেও অবশিষ্ট ৭০টি প্লট থেকে যাবে। যদি নিদেনপক্ষে ঘরপ্রতি ২ হাজার টাকা করে ভাড়া পাওয়া যায় (এর চেয়ে কমে বস্তিতে একটা ঘরের ভাড়া আছে বলে আমার জানা নেই), তাহলে বস্তির মালিক মাসে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ভাড়া পাবেন। অন্তত এক লাখ টাকা তো পাবেনই। লক্ষণীয় যে তাঁকে পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস কোনো কিছুই সরবরাহ করতে হবে না, এমনকি ওই ঘরটিও নির্মাণ করে দিতে হবে না। বস্তিবাসী যিনি ওই ঘরে থাকবেন, তাঁকে নিজেকেই সেই ঘর তৈরি করে নিতে হবে। আরও আছে। বস্তির মালিককে কোনো প্রকার ট্যাক্স বা কর দিতে হবে না। কারণ, এসব তো ঝুপড়ি, অস্থায়ী।

অথচ ঢাকা মহানগর এলাকায় একই পরিমাপের একটি প্লটে নিদেনপক্ষে তিন হাজার বর্গফুটের একটি আধুনিক একতলা ইমারত/ আবাসিক ভবনের জন্য বাড়ির মালিক মাসে ভাড়া বাবদ ৫০ হাজারের (বা ক্ষেত্রবিশেষে কিছু কমবেশি) মতো পেতে পারেন। তবে তাঁকে সেবা সংস্থাসমূহের, যেমন বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস এবং অতিরিক্ত করসমূহ, যেমন আয়কর, মিউনিসিপ্যাল কর প্রভৃতি নিয়মিত পরিশোধ করতে হয়। যেহেতু ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী এটি একটি স্থায়ী স্থাপনা, সেহেতু যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন এই স্থাপনার সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। কাজেই দেখা যায় যে মহানগরে ব্যক্তিমালিকানাধীন বস্তিসমূহ গজিয়ে ওঠা এবং টিকে থাকা অধিকতর লাভজনক এবং সব ধরনের বিধিমালা, আইন, রুলস বা রেগুলেশনের আওতা থেকে তা বহির্ভূত বলে পরোক্ষভাবে আমরাই এই প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে চলেছি।

যাদের নিয়ে এই সমস্যার জটিল ইতিবৃত্ত, তাদের সমষ্টিগত জনসংখ্যা কত? অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য, ঢাকা মহানগরীতে বস্তির বিপুল জনগোষ্ঠীকে পরিসংখ্যানের দিক থেকে যেন অবলুপ্ত করে তোলার প্রবণতায় মেতে উঠেছে পরিসংখ্যান ব্যুরো। নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখকৃত ২০০৫ সালে ঢাকা মহানগরীতে ৩৪ লাখ বস্তিবাসীর উপস্থিতি, সম্মিলিতভাবে তিনটি জাতীয়/আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ ফলাফল এবং ওই তিন প্রতিষ্ঠানের একটি এনআইপিওআরটি, বাংলাদেশ সরকারের একটি অঙ্গসংগঠন। (অপর দুটি িসইউএস এবং ইউিনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক যৌথভাবে ইউএসএইড এর কারিগরি সহায়তা কার্যক্রমের সমন্বিত ফসল)।

রাজউক কর্তৃক অন্য একটি গবেষণালব্ধ তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রাক্কালে আমরা একটি স্বীকৃত সত্য পেয়েছি; তা হলো প্রতিবছর ঢাকা মহানগরীতে অন্ততপক্ষে ছয় লাখ নতুন জনগোষ্ঠী যুক্ত হচ্ছে।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, ফি বছর এই নবাগত জনগোষ্ঠী কোথায় আশ্রয় নিচ্ছে? স্বাভাবিকভাবেই বস্তিতে। এই নিষ্ঠুর তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যে অবধারিত সত্য নিরূপিত তা হলো, সেই ২০০৫ সালের ৩৪ লাখ বস্তিবাসীর সঙ্গে বিগত ১৪ বছরে অন্তত আরও ১৬ লাখ যুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ ধরে নেওয়া নিশ্চয়ই অযৌক্তিক নয় যে ঢাকা মহানগরীতে ৫০ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাস করে। এ এক ভয়াবহ সত্য!

কিন্তু হতাশাব্যঞ্জক হলেও এ কথা সত্য যে বিগত ২০১৫ সালে, বস্তিশুমারি নামে পরিসংখ্যান ব্যুরো এক অভাবনীয় তথ্য প্রকাশ করে। তা হলো ঢাকা বিভাগ এলাকায় বসবাসরত বস্তিবাসীর সংখ্যা ১০ লাখ ৬১ হাজার ৬৯৯) (The census of Slum Areas and Floating Population 2014. Bangladesh Burearu of Statistics). লক্ষণীয়, যে মহানগরীতে ১৪ বছর আগেই (২০০৫ সালে) ৩৪ লাখ মানুষ বস্তিতে বসবাসরত ছিল, কোন মন্ত্রবলে সেই মহানগরী অপেক্ষা সুবৃহৎ ঢাকা বিভাগীয় এলাকায় প্রায় ১০ বছর পর মাত্র সাড়ে ১০ লাখ বস্তিবাসীর স্থান হলো, আর বাকি প্রায় ২৪ লাখ উধাও/অবলুপ্ত হলো?

এমনিতেই বস্তিবাসীদের নিয়ে মাথা ঘামানোর দায় কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই বললেই চলে। রাজউক, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নবিষয়ক কোনো নীতিমালাতে ‘বস্তি উন্নয়ন’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত নয়। বস্তিবাসীদের সুষ্ঠু আবাসন একটি বহুমাত্রিক ও জটিলতর সমস্যা। জমির দুষ্প্রাপ্যতার সমস্যা, সামগ্রিক গৃহায়ণ প্রক্রিয়াজনিত সমস্যা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা। সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠান এককভাবে এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব নেবে কেন?

যেকোনো সমস্যার প্রেক্ষাপটে সমাধানের প্রশ্নটি এসে পড়ে। আগেই উল্লেখ করেছি, এই কাহিনি অনেক বিস্তৃত, ল্যাবরেটরিতে প্রস্তুতকৃত কোনো সমাধানের ক্যাপসুল এখানে নেই। তবে উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক শহরেই নিয়মিত আবাসন একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা এবং সেই সব দেশে, প্রতিবেশী দেশেও, সমস্যা সমাধানের জন্য গৃহীত হয়েছে বিস্ময়কর বিভিন্নমুখী উদ্যোগ, চলছে নানা রকম পরীক্ষা–নিরীক্ষা। দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশে বস্তিবাসী আবাসনের কার্যকর কোনো দৃষ্টান্ত নেই। ৮০-৯০–এর দশকের মাঝামাঝি ঢাকা মহানগরীর ‘বাস্তুহারা প্রকল্প’ একটি নতুন ভাবাদর্শের জন্ম দিয়েছিলে, যা ইংল্যান্ডে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল। এই গবেষণার ফলাফল লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং গবেষকদের পাঠ্য বলে বিবেচিত হয়। সেই প্রকল্পেরও করুণ পরিণতি ঘটেছে। মনে রাখতে হবে, শুধু ডেভেলপারকেন্দ্রিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করে নিম্নবিত্তদের জন্য সামান্যসংখ্যক বাসস্থানের জোগান দেওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু তা সামগ্রিক সমস্যার হিসাবে নগণ্যতম, যেখানে কেবল ঢাকা মহানগরীতেই প্রতিবছর ১ লাখ ২০ হাজার বাসগৃহ প্রয়োজন, সেখানে ডেভেলপার কর্তৃক সরবরাহ করা হয় প্রায় পঁচিশ হাজার, তা–ও মূলত উচ্চবিত্তের জন্য। আর সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র আরও ভয়াবহ।

২০১০ সালে গৃহায়ণের ঘাটতি ছিল ৪.৬ (সাড়ে চার) মিলিয়ন ইউনিট। সেই ঘাট‌তি পূরণ করতে হলে কত মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন এবং তা যে ক্রমশ স্বপ্নেরও অতীতে পরিণত হচ্ছে, তার হদিস কেই–বা রাখে?

ড. মো. শহীদুল আমিন অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।