গৃহায়ণ-চিন্তা

আপন গৃহ মানুষকে আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করা ছাড়াও উপার্জনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। ছবি: আশরাফুল আলম
আপন গৃহ মানুষকে আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করা ছাড়াও উপার্জনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। ছবি: আশরাফুল আলম

গৃহ মানুষের মৌলিক প্রয়োজন, অধিকারও বটে। বাংলাদেশের সংবিধান এই অধিকার অর্জনের নিশ্চয়তা দেয়। জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা ১৯৯৩, ২০০৮ ও পুনঃ অনুমোদিত নীতিমালা ২০১৬–তেও দেশের সব মানুষের জন্য মানসম্মত গৃহ বা আবাসন আয়োজনের সুপারিশ করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ ‘সবার জন্য আশ্রয়’ ও ‘কাউকে পেছনে ফেলে নয়’, এ ধরনের সংকল্পের কথা বলে।

আপন গৃহ মানুষকে আশ্রয়, নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা, স্বাস্থ্য ও স্বাচ্ছন্দ্য প্রদান করা ছাড়াও উপার্জনের সুযোগ তৈরি করে দেয়। গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারের জন্য একটি গৃহের মালিকানা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। গ্রামীণ ব্যাংকের গৃহায়ণ প্রকল্পটি এ রকম একটি ধারণা বাস্তবায়নের জন্য অত্যন্ত মর্যাদাবান স্থাপত্যে আগা খান পুরস্কার পেয়েছিল।

বাংলাদেশে গৃহায়ণ সমস্যা প্রকট। সংখ্যাগত দিক থেকে দেখা যায়, মানসম্মত গৃহের বিরাট ঘাটতি রয়ে গেছে। বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা বিশাল, ১৬৫ মিলিয়নের মতো এবং ক্রমবৃদ্ধিশীল। বছরে অন্তত ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ নতুন মানুষ মোট জনসংখ্যায় যুক্ত হচ্ছে। মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ধ্বংসও হচ্ছে। ফলে গৃহ–ঘাটতি মেটানো কঠিনতর হচ্ছে। গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১৬–তে প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫–পরবর্তী সময়ে দেশে প্রতিবছর অন্তত ১ মিলিয়ন নতুন গৃহ নির্মাণ প্রয়োজন ছিল। সংখ্যাটি অবশ্যই বিশাল, সে তুলনায় বাস্তবে সরবরাহ হচ্ছে কম।

সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতির সাম্প্রতিক অগ্রগতি অত্যন্ত প্রশংসনীয় এবং উন্নয়নের ধারাটি অব্যাহত রয়েছে, কিন্তু আবাসনের উপযোগী জমি ও গৃহ নির্মাণসামগ্রীর মূল্য আগের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে গৃহ-ঘাটতি বেড়েই চলেছে। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থায়নের সমস্যা অপর এক গুরত্বপূর্ণ কারণ। শহরাঞ্চলে ভবনাদি নির্মাণের অনুমোদনসংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাসমূহে দুর্নীতিও আবাসন খাতকে সমস্যা ভারাক্রান্ত করেছে।

সংখ্যাগত ঘাটতির পাশাপাশি গৃহের গুণগত মানের কথায় দেখা যায় গ্রামাঞ্চলের ৮০ ভাগ গৃহ কাঠামোগত দিক থেকে নিম্নমানের ও স্বল্প স্থায়িত্বের। এমনকি শহরাঞ্চলেও মাত্র ২২ ভাগ বাড়ি পাকা ও ২৩ ভাগ আধা পাকা, বাকি ৫৫ ভাগ কাঁচা ও ঝুপড়ি, অর্থাৎ অত্যন্ত নিম্নমানের কাঠামো। পাকা ও আধা পাকা গৃহও সব মানসম্মত নয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় ও মাঝারি শহরে সম্প্রতি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, তবে সেসবের কত ভাগ জাতীয় নির্মাণ কোড বা বিএনবিসির মাপকাঠিতে মানসম্মত, বলা শক্ত। নির্মাণকাঠামোর পাশাপাশি গৃহের প্রাসঙ্গিক পরিষেবাসমূহ, যথা পানি, পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, বর্জ্য অপসারণ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

মানসম্পন্ন গৃহ বা আবাসন অবশ্য শুধু একটি গৃহ ও এর সংশ্লিষ্ট সেবা–পরিষেবাসমূহকেই বোঝায় না, আবাসনের প্রতিবেশ বা পারিপার্শ্বিক পরিবেশকেও বোঝায়। যেখানে শিশু-কিশোরদের খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। স্বস্থ্যচর্চার সুযোগ থাকবে অন্য সবারও। এদিক থেকে বাংলাদেশে গ্রামীণ আবাসন তুলনামূলকভাবে অনেকটাই পরিবেশবান্ধব। ভৌত পরিবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ—দুভাবেই। দীর্ঘকালের বিবর্তনে এ দেশের একেকটি গ্রাম গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন বিত্ত বা অর্থনৈতিক অবস্থানের পরিবার একই গ্রাম জনপদে একসঙ্গে বসবাস করছে। সাম্প্রতিক কালে অবশ্য গ্রামের ভৌত চেহারায় পরিবর্তন ঘটেছে, পরিবারের প্রবাসী সদস্যদের রেমিট্যান্সের প্রত্যক্ষ প্রভাব চোখে পড়ে গ্রামের গৃহকাঠামোতে। অধুনা নির্মিত অনেক সেমি পাকা বা পাকা বাড়ির দেয়াল নানা উজ্জ্বল রঙে রাঙানো হয়েছে। পল্লী বিদ্যুৎ ও সৌরবিদ্যুৎ সেবা যুক্ত হয়েছে। টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়েছে। দেশের ভেতরে ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহর থেকে পাঠানো অর্থেও গ্রামের ঘরবাড়ির চেহারা বদলে যাচ্ছে। পাশাপাশি বাড়ির আঙিনায় ও আশপাশে নানা রকম ফলদ, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর প্রবণতাও বেড়েছে। গ্রামের অতিদরিদ্ররা অবশ্য অনেকেই গ্রাম ত্যাগ করে শহরে অভিবাসন করেছেন এবং শহরের বস্তিতে ঠিকানা খুঁজে নিয়েছেন। এ প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ দারিদ্র্যমাত্রা কমে নগরীয় দারিদ্র্যমাত্রা বেড়েছে।

অন্যদিকে গ্রামের সমাজকাঠামোতে পরিবর্তন হচ্ছে। যাঁরা ওপরের দিকে অবস্থান করতেন, ভূস্বামী, শি‌ক্ষিত বিত্তবান বা মধ্যবিত্ত, তাঁরাও অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে অভিবাসী অথবা আংশিকভাবে বিদেশমুখী, তাঁদের পৈতৃক বাড়িঘর প্রায় খালিই পড়ে থাকে। অনেকে বাড়ি সংস্কার করে আধুনিকায়ন করেন, হাইকমোডসহ টাইলসের বাথরুম বানান, মাঝেমধ্যে গ্রামে এসে বেড়িয়ে যান। জীবনাবসানে পারিবারিক কবরস্থানে পরম শা‌ন্তি লাভ করেন। অভিজাতদের কেউ কেউ বিদেশে মৃত্যুবরণ করলেও দেশের মাটিতে শেষ ঠিকানা নিশ্চিত করেন।

অতিসম্প্রতি আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি স্লোগান এগিয়ে নিচ্ছেন ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’ বা ‘গ্রাম হবে শহর’। অর্থাৎ নগরের সব সুযোগসুবিধা গ্রামেই পাওয়া যাবে। এই স্লোগানে অবশ্য গ্রামের ঘরবাড়ির চেহারা বা কাঠামো বদলের কথা বলা নেই, কিন্তু বাস্তবে তা–ও হয়তো ঘটবে। এ ক্ষেত্রে খুব ভেবেচিন্তে এগোতে হবে, যাতে গ্রামের নান্দনিক অবয়ব ও পরিবেশ–পরিস্থিতি নষ্ট না হয়। সংবিধানের ১৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে, গ্রাম-নগরবৈষম্য কমাতে হবে, ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগানের লক্ষ্য অনেকটা এ রকমই।

শহরে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা শহরে অবাধ বাজার অর্থনীতির সুবাদে স্বাধীনতা–উত্তর পাঁচ দশকে জনগণের আর্থসামাজিক অবস্থার বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ধনবৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে, এই বৈষম্যের চরম দৃশ্যমান প্রতিফলন ঘটেছে আবাসন খাতে।

দেশে একটি বিত্তবান শ্রেণি গড়ে উঠেছে। অনুপাতে তেমন বড় না হলেও তাদের মোট সংখ্যা নেহাত ছোট নয়। তাদের জন্য গড়ে উঠছে সুরক্ষিত, মনোরম আবাসিক এলাকা, ইদানীং কিছু আবার ‘গেটেড কমিউনিটি’র আদলে। এগুলো অধিকাংশই অবশ্য মূলত অ্যাপার্টমেন্ট ব্লক। নামীদামি স্থপতিদের নকশায় গড়ে উঠেছে এখানকার ঘরবাড়ি। এ ধরনের বাড়িতে সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন আমলের মন্ত্রী থেকে শুরু করে নানা পেশার কীর্তিমান মানুষ, সফল ব্যবসায়ী, অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল সম্পদের মালিকেরা থাকেন। রাষ্ট্রীয় তথা জনগণের অর্থে এসব বিত্তবানের অভিজাত আবাসিক এলাকায় নান্দনিক পার্ক, ওয়াকওয়ে, লেক ইত্যাদির সুব্যবস্থা করা হয়। অতিসম্প্রতি অবশ্য কিছু ‘সুপার-রিচ’ পরিবার দুর্গপ্রতিম প্রাসাদবাড়িও বানাচ্ছেন। বিত্তবান ও অতিবিত্তবানদের বাড়ি অবশ্যই পুরোপুরি (কেন্দ্রীয়ভাবেও) এয়ারকন্ডিশন্ড। বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সাফল্য তাঁদের চাহিদামাফিক সেবা দিচ্ছে।

উচ্চমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও মাঝারি উচ্চতার বা সুউচ্চ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে মাঝারি বা ছোট ফ্লোর স্পেসের অ্যাপার্টমেন্টে থাকছেন মালিক বা ভাড়াটে হিসেবে। তাঁরাও তাঁদের বাসার কিছু কিছু কামরায় এসি লাগাচ্ছেন। কেননা, বিল্ডিং–ঘনত্বের কারণে স্থপতিরা আর পরিবেশ বা আবহাওয়াবান্ধব বাড়ি বানাতে পারছেন না।

উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের জন্য আজকাল প্রাইভেট হাউজিং কোম্পানি বা রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো আবাসিক অ্যাপার্টমেন্ট ভবন বা গৃহ নির্মাণ করছে। রিহ্যাব তালিকাভুক্ত প্রায় ১ হাজার ২০০ কোম্পানির মধ্যে হাতে গোনা বেশ কিছু কোম্পানি আছে, যারা রাজধানীর আবাসনব্যবস্থায় প্রশংসনীয় অবদান রাখছে। চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় শহরেও রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলোর কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে। অধিকাংশ কোম্পানির সুনাম নেই, বরং দুর্নামই বেশি। অনেক কোম্পানি শুধু প্লট–বাণিজ্য করছে। এসব কোম্পানি বিশাল হাউজিং প্রকল্প করছে, রীতিমতো ‘নিউ টাউন’ বা নতুন শহর গড়ে তুলছে। এ কাজ করতে গিয়ে এদের অনেকে নানা অবৈধ পদ্ধতি ব্যবহার করে, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। নিচু জমি ও জলাভূমি ভরাট করে, খাসজমি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। বড় বড় ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি নগরাঞ্চলের ভূমি ব্যবস্থাপনায় বড় রকমের নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি সংস্থাগুলো কিছুতেই এদের সঙ্গে পেরে ওঠে না অথবা পারতে চায় না। এসব কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা সরকার বা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রবল প্রভাব রাখেন।

প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের উদ্যোগে গড়ে তোলা ‘ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি’ বেশ কয়েক দশক ধরে উচ্চবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্তদের জন্য নগরে মানসম্পন্ন অ্যাপার্টমেন্ট হাউজিং করছে। সেখানে ভৌত পরিবেশের মানের দিকেও নজর দেওয়া হয়। এগুলোও একধরনের ‘গেটেড কমিউনিটি,’ এলাকাবাসী ছাড়া অন্যদের প্রবেশাধিকার কিছুটা সীমিত, তবে প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে সিভিলিয়ানদের ফ্ল্যাটের মালিক বা ভাড়াটে হওয়ার সুযোগ থাকায় একধরনের মিশ্র সমাজ গড়ে উঠছে।

হাউজিং কোম্পানি, সরকারি সংস্থা এসবের পাশাপাশি নগরাঞ্চলে মধ্যবিত্তদের সমবায় সংগঠনের মাধ্যমে গৃহায়ণ উদ্যোগ রয়েছে। পেশাজীবীদের সমবায়গুলো এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ভূমিকা রাখছে।

শহরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। নিম্নমধ্যবিত্তরা এখনো শহরগুলোতে অনেকটা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি বানাচ্ছেন অথবা অন্যদের বানানো বাড়িতে ভাড়া থাকছেন। তাঁদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের বাড়ি নিজেরা বানাচ্ছেন বা বানানোর ব্যবস্থা করছেন, তাঁরা নিজস্ব পারিবারিক সঞ্চয়, আত্মীয়স্বজন ও কর্মস্থল থেকে নেওয়া ঋণ অথবা ব্যাংকঋণে অর্থায়নের ব্যবস্থা করেন।

ঢাকা বা চট্টগ্রামের মতো মহানগরে একেবারে নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বিশাল। মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি। এদের সঠিক সংখ্যা জানাটাও কঠিন কাজ। এই নগর-দরিদ্ররা মূলত নগরের অসংখ্য বস্তি এলাকায় আশ্রয় খুঁজে নেন। ঝুপড়ি, কাঁচা ঘর, টিনশেড, আধা পাকা, এমনকি পাকা ঘর। প্রতি বর্গফুটের হিসাবে অতি উচ্চ ভাড়ায় ঘর নিতে বাধ্য হন তাঁরা। মধ্যস্বত্বভোগী গোষ্ঠী সাধারণ দরিদ্র বস্তিবাসীদের নানাভাবে প্রবঞ্চনা করে। উল্লেখ্য, বস্তির একটি কাঁচা ঘর বা টিনশেড কামরা একটি নগর পরিবারের আশ্রয়, এই পরিবারের এক বা একাধিক সদস্য হয়তো নগর শ্রমবাহিনীর সদস্য, তারা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রক্ষাকারী।

জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালায় স্পষ্টভাবে লেখা আছে, নিম্নমধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন দরিদ্র নগরবাসীর জন্য গৃহায়ণে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে সরকার, সরকারের জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বা অন্যান্য সংস্থা। এ কাজ তাঁরা যে করেন না তা নয়, তবে যা করেন, তা প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। বস্তিবাসী দরিদ্রদের জন্য উল্লেখযোগ্য কর্মসূচিটি নেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে, ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে, যখন রাজধানীর প্রায় ৭৫ হাজার বস্তিবাসীকে ডেমরা, টঙ্গী ও মিরপুরে সরকারি জমিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছিল। বর্তমান সরকার বহুতল ভবনে ছোট মাপের ফ্ল্যাট বানিয়ে কয়েক হাজার বস্তিবাসীকে পুনর্বাসিত করার প্রকল্প নিয়েছে। চাহিদা তো অবশ্য এমন লাখ লাখ পরিবারের। ইদানীং সরকারি অধিদপ্তর অবশ্য বেশ উদ্যমের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের জন্য মানসম্পন্ন বহুতল ফ্ল্যাট–ভবনাদি বানাচ্ছে। এমনকি লাক্সারি ফ্ল্যাটও বানাচ্ছে। তা ছাড়া উন্নত ‘সাইট অ্যান্ড সার্ভিস’ মডেলের আবাসিক এলাকা, স্যাটেলাইট টাউন বা নিউ টাউনে পাকিস্তান আমলের ধারায় প্লট বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে। বারবার বলা হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে আর প্লট বরাদ্দ নয়, শুধু ফ্ল্যাট দেওয়া হবে, কিন্তু এমন ঘোষণার বাস্তব প্রতিফলন এখনো খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না, যাওয়া উচিত।

বাংলাদেশের সংবিধানে সবার জন্য বাসযোগ্য আশ্রয় দর্শন সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য ও মানুষে মানুষে বৈষম্য থাকবে না, এমন চিন্তাও তাতে স্থান পেয়েছে। জাতীয় গৃহায়ণ নীতিমালা ২০১৬–তেও দেশের সব শ্রেণি, গোত্র, গোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় আবাসনের দিকনির্দেশনা রয়েছে। সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখার কথাও বলা হয়েছে। গৃহায়ণ সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশী কর্তৃপক্ষ সংস্থা ও গোষ্ঠী, যথা সরকার, প্রাইভেট সেক্টর, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। প্রয়োজনীয় জমি, অর্থ, নির্মাণসামগ্রী, নির্মাণকৌশল, নির্মাণকুশলী ও শ্রমিক এবং সার্বিকভাবে গৃহায়ণ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। চূড়ান্ত বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দর্শন, লক্ষ্য ও কৌশল বাস্তবায়নে সরকারসহ সব স্টেকহোল্ডারের আন্তরিকতা, দক্ষতা ও নিষ্ঠা। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের গৃহবাসনা তো কবি অনেক আগেই ব্যক্ত করে গেছেন—‘ধন নয়, মান নয়, এতটুকু বাসা, করেছিনু আশা’।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, নগরবিদ, সাম্মানিক চেয়ারম্যান, নগর গবেষণা কেন্দ্র, ঢাকা