দেশেই বিশ্বমানের ইংরেজি শিক্ষা

>

নিলুফার মঞ্জুর
নিলুফার মঞ্জুর

গুণে ও মানে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার কদর দিন দিন বেড়ে​ চলেছে। সাড়ে চার দশক ধরে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে এই মাধ্যমে লেখাপড়ার অবস্থা নিয়ে বলছিলেন সানবিমস স্কুলের অধ্যক্ষ নিলুফার মঞ্জুর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শরিফুজ্জামান

প্রথম আলো: একটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেমেয়েরা বাংলা শেখে না, শিখতে চায় না বা শেখানো হয় না।

নিলুফার মঞ্জুর: ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ইংরেজি শেখাতেই হবে। কিন্তু বাংলা ভাষা না শিখে কিংবা বাঙালিত্ব হারিয়ে নয়। সবার আগে মাতৃভাষা বাংলা, এ বিষয়ে আপস নেই। বাংলা শিখে বাঙালি হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। আর এখন তো শিশুদের তিনটি ভাষা শেখানোর কথা বলা হয়। ছোটবেলায় ভাষা শেখাটা সহজ। সেখানে আমাদের দেশে বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি শেখাটা কঠিন কোনো ব্যাপার বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো নীতিমালা মানে না বা মানতে চায় না। কেন?

নিলুফার: দেখুন, কেউ কেউ হয়তো মানে না। কিন্তু অনেকেই আবার মানে। এটা তো সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রেই কমবেশি আছে। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর একটা নীতিমালা আছে। সবাইকে তা মেনে চলতে হবে—এটাই মূল কথা। এখন যদি কেউ না মানে, সেটি দেখার জন্য কর্তৃপক্ষ তো আছে। তারা দেখুক এবং বলুক কারা মানছে না, কেন মানছে না। আসলে সুষ্ঠু নজরদারির প্রয়োজনও আছে। কিন্তু সেটি সব সময় হয় না। এ কারণে সবাইকে ঢালাওভাবে দায়ী করাটা মনে হয় ঠিক নয়।

আমরা নীতিমালা ও নজরদারি—দুটোই চাই। আর যদি কেউ না মানে, তাহলে তাকে চিহ্নিত করতে হবে এবং নীতিমালা প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তবে বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে বলব, পরিস্থিতির কিন্তু অনেকখানি অগ্রগতি হয়েছে। সরকার ও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নীতিমালার বিষয়ে বেশ কাছাকাছি অবস্থানে এসেছে। আমরা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা শোনার ও বলার সুযোগ পেয়ে আশান্বিত হচ্ছি।

প্রথম আলো: ইংরেজি মাধ্যম স্কুল সম্পর্কে বড় অভিযোগ হচ্ছে, হুটহাট বেতন বাড়ানো। এ নিয়ে অভিভাবকদের ক্ষোভ লেগেই থাকে।

নিলুফার: একেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে একেক নিয়ম আছে। ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলগুলোর তিন-চারটি ফোরাম আছে। এসব ফোরামের সদস্যরা কিন্তু সাধারণ নিয়মকানুন মেনে চলেন। যেমন বাংলাদেশ প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলস ফোরামের সদস্যরা বছরে ১০ শতাংশের বেশি বেতন বাড়াতে পারেন না। মাসিক ফি ছাড়া অন্য খাতে টাকা নেন না। কারও কারও বিরুদ্ধে ঘোষণা ছাড়া বা অস্বাভাবিক বেতন বাড়ানোর অভিযোগ যে নেই, তা বলব না। তবে এটাও সত্য যে ভালো সেবা পেতে হলে নিবেদিতপ্রাণ, দক্ষ, সৎ কর্মী দল গঠন করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন সমমনা ব্যক্তিত্ব ও আকর্ষণীয় পরিবেশ। এখানে অভিভাবকের আস্থা ও বিশ্বাসের ব্যাপার আছে। অভিভাবক ও স্কুল যদি পরস্পরের অংশীদার হয়, তাহলে প্রয়োজনে বেতন বাড়ালেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

প্রথম আলো: একসময় উচ্চবিত্তের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যমে প​ড়ত, এখন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও পড়ছে। ইংরেজি শিক্ষায় ঝোঁক বাড়ার কারণ কী?

নিলুফার: এর সহজ জবাব হচ্ছে, চাহিদা আছে বলেই ইংরেজি শিক্ষার প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের জন্য আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা আবশ্যক। গতিময় বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের জ্ঞান, প্রযুক্তি ও কর্মদক্ষতা অর্জন করতে হবে। সে জন্য আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই। বাংলাদেশে বসে এখন আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা পাওয়া যায়। ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজ ও এডেক্সেল—এই দুটি বোর্ডের অধীনে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোর পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশে ইংরেজি মাধ্যমের সব পরীক্ষা ও ফলাফল ব্রিটিশ কাউন্সিল নিয়ন্ত্রণ করে। ইংরেজি মাধ্যমের পাঠ্যসূচি যুক্তরাজ্যের বাস্তবতায় তৈরি। এখানকার পড়াশোনার পুরোটাই হয় ইংরেজি ভাষায়। তবে এখানে উল্লেখ্য, আমাদের স্কুলে বাংলা ও বাংলাদেশ স্টাডিজ বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে পড়ানো হয়।

প্রথম আলো: ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাটা সেবা না ব্যবসা?

নিলুফার: এটা অবশ্যই সেবা (সার্ভিস)। এখানে অনেকেই স্রেফ সেবা দিতে এসেছেন। কিন্তু সেই সেবাটা মানসম্মত হতে হবে। এই মান নিশ্চিত করতে গেলে কেউ কেউ বাণিজ্যের প্রসঙ্গ তোলেন। আবার কেউ কেউ বাণিজ্য যে করেন না, সেটি বলব না। কিন্তু যাঁরা একনিষ্ঠভাবে ও একাগ্রতার সঙ্গে সেবাকেই মূল লক্ষ্য বলে মনে করেন, তাঁদের ভূমিকার মূল্যায়ন করা প্রয়োজন নয় কি?

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার জন্য সরকার কোনো অনুদান বা সহায়তা দেয় না। নিজের আয়ে জমি কেনা, ভবন নির্মাণ, বেতনসহ সব খরচ বহন করতে হয়। তবে সমালোচনা অনেকটাই কমেছে, এই শিক্ষার প্রতি অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়েছে। সব আলোচনা-সমালোচনার মধ্যেও দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন ও শিক্ষার বিকাশে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে।

প্রথম আলো: সাড়ে চার দশক আগে ইংরেজি মাধ্যম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কেন? অন্য কিছুও তো করতে পারতেন।

নিলুফার: হ্যাঁ, অন্য কিছু করতে পারতাম। কিন্তু এত ভালোবাসা ও সম্মান পেতাম কি না, সন্দেহ। নিখাদ ভালোবাসা পাই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে। এখন তো আমার স্কুলে দ্বিতীয় প্রজন্ম আসছে। প্রথম দিকে যারা আমার ছাত্র ছিল, তাদের ছেলেমেয়েরা এখন আসছে। কিন্তু বাবা–মায়েদের সঙ্গে তাদের সন্তানদের একটি বড় পার্থক্য খুঁজে পাই। এখনকার প্রজন্ম আগের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও প্রয়োজন অনেক বদলে গেছে। গত সাড়ে চার দশকে আমার দায়িত্ব অনেকটাই বেড়েছে। একজন পরিচালকের লক্ষ্য ও আদর্শ হবে স্পষ্ট। প্রয়োজনবোধে তাকে সাহসী হতে হবে, বদলাতে হবে এবং বদলে দিতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

নিলুফার: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।