ঠিকানাহীন মানুষের আপনজন

চট্টগ্রাম নগরের এম এম আলী সড়কের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কার্যালয়ে প্রতি শুক্রবার দেওয়া হয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা।  প্রথম আলো
চট্টগ্রাম নগরের এম এম আলী সড়কের আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কার্যালয়ে প্রতি শুক্রবার দেওয়া হয় বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা। প্রথম আলো

ধর্ষণের পর এক নারীকে শ্বাসরোধে হত্যা করেছিল কে বা কারা। রাস্তায় পড়ে ছিল লাশটি। স্থানীয় লোকজন লাশের নাম-ঠিকানা-পরিচয় না পেয়ে পুলিশকে খবর দেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পুলিশও ওই নারীর কোনো স্বজনকে বের করতে পারেনি। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৭ অক্টোবর নগরের বন্দর থানার কলসী দিঘির পাড় এলাকায়।

পুলিশ লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। মর্গে স্বজনেরা আসবেন—এ ধারণা ছিল পুলিশের। কিন্তু না, কেউ আসেননি। জীবনে লাঞ্ছনা–নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যে নারীটি, মৃত্যুতেও যেন অবসান হলো না তাঁর দুর্ভাগ্যের। লাশটি মর্গের হিমঘরে রাখা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৩৫ বছর বয়সী ওই নারীর লাশের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। যদি কেউ চিনতে পারেন! এভাবে এক দিন–দুদিন পার হয়। লাশ পড়ে থাকে হিমঘরে। কেউ নিতে আসে না। অবশেষে এগিয়ে এল আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। তারা হিমঘর থেকে লাশটি নিয়ে যায়। ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী গোসল ও কাফন পরানো হয়। অনুষ্ঠিত হয় জানাজাও। পরে নগরের চৈতন্য গলি কবরস্থানে শেষ ঠাঁই হয় ওই বেওয়ারিশ নারীর।

যার কেউ নেই, তার জন্য আছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। শুধু ওই নারীর লাশ নয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে ২৪৪টি বেওয়ারিশ লাশ ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসারে সৎকার করা হয়। ২০১১ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৯ বছরে ২ হাজার ৭৪৮টি বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় আঞ্জুমানের উদ্যোগে।

সংগঠনটির গোড়াপত্তন হয়েছিল কলকাতায় ১৯০৫ সালে। চট্টগ্রামে এর কার্যক্রম শুরু ১৯৭৯ সাল থেকে। ৪০ বছর ধরে অসহায় চট্টগ্রামবাসীর জীবনে-মরণে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে এই সংগঠন। অনেকেই মনে করেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম কোনো ব্যক্তির নামে একটি সেবা সংস্থা। আসলে আঞ্জুমান অর্থ সংগঠন, মুফিদুল হচ্ছে জনসেবা আর ইসলাম অর্থ শান্তি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের অর্থ দাঁড়ায় ইসলামি জনসেবামূলক সংস্থা।

 নগরের কর্ণফুলী ইছানগর বাজারে এক বছরের বেশি সময় ধরে মানসিক প্রতিবন্ধী এক ব্যক্তি ঘোরাফেরা করতেন। গত ৪ সেপ্টেম্বর রাস্তায় মরে পড়ে ছিলেন। তাঁর কোনো স্বজন না থাকায় স্থানীয় লোকজন পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামকে হস্তান্তর করে। তারা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী লাশটি দাফন করে। নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। কোথায় তাঁর বাড়ি, কিছুই বলতে পারতেন না। শুধু নিজের নাম বলতে পারতেন। মৃত্যুর পর আঞ্জুমানের কল্যাণে তাঁরও শেষ ঠিকানা হয় নগরের চৈতন্য গলি কবরস্থানে।

>৪০ বছর ধরে চট্টগ্রামে কার্যক্রম চলছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের। বেওয়ারিশ লাশ দাফনের পাশাপাশি রয়েছে এতিমখানা। প্রতি শুক্রবার দেওয়া হয় চিকিৎসাসেবা।

চট্টগ্রাম নগরের মেহেদীবাগে অবস্থিত এর কার্যালয়ে চারটি কেবিনেটবিশিষ্ট স্থির ফ্রিজ শবাগারে দীর্ঘদিন মরদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। ভ্রাম্যমাণ (ফ্রিজার) মরচুয়ারিতে মরদেহ সংরক্ষণ ও পরিবহন সেবা দেওয়া হয়। নামমাত্র খরচে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত অ্যাম্বুলেন্সে রোগী ও মরদেহ পরিবহন সেবা দেওয়া হয়। বর্তমানে তাদের ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে।

লাশ দাফন, সংরক্ষণের পাশাপাশি এতিম অসহায় শিশুদের শিক্ষা ও থাকার ব্যবস্থা করেছে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। নগরের মধ্য হালিশহর এলাকায় দোতলা একটি নিজস্ব ভবনে আনোয়ারা জাকারিয়া এতিমখানায় ৫০ জন এতিম শিশুর থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ৯ বছর বয়সে বাঁশখালী থেকে এই এতিমখানায় এসেছিল দরিদ্র পরিবারের সন্তান কায়সার হামিদ। নগরের একটি কলেজ থেকে এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে। কায়সার হামিদ প্রথম আলোকে বলেন, এতিমখানায় এসে তিনি নতুন জীবন পেয়েছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন পড়ালেখা। আনোয়ারার মো. ইরফান, বাঁশখালীর মো. তৌহিদ আট বছর বয়সে এই এতিমখানায় এসে এখন দুজনই অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে। তারা বেশ খুশি। 

এতিমখানাটির তত্ত্বাবধায়ক মো. আজগর হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছর থেকে শুরু করে ১৭-১৮ বছর বয়সী ৫০ জন এতিম শিশু রয়েছে এখানে। সবাই পড়াশোনা করছে। তাদের বিনা মূলে৵ সবকিছু দেওয়া হয়। নগরের চৈতন্য গলি এলাকায় গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূলে৵ কোরআন ও নামাজ শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি নগরের রউফাবাদ সরকারি বালিকা এতিমখানায় একজন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক সেলিম নাছের প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে প্রতি শুক্রবার বিনা মূলে৵ চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান করা হয়। এ ছাড়া গরিব ও মেধাবীদের শিক্ষাবৃত্তি, মাদকসেবীদের পুনর্বাসনসহ নানা সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

ভারতের গুজরাট রাজ্যের সুরাটের শেঠ ইব্রাহীম মোহাম্মদ ডুপ্লে ১৯০৫ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন এ প্রতিষ্ঠানটি। ইসলামি এই জনকল্যাণ সংস্থা মূলত পিছিয়ে পড়া মুসলিম ছেলেমেয়েদের শিক্ষা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে এগিয়ে নেওয়ার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে বেওয়ারিশ লাশ দাফন শুরু করার পরই প্রতিষ্ঠানটি ব্যাপক পরিচিতি পায়।

আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম চট্টগ্রামের সভাপতি নগর পুলিশ কমিশনার মো. মাহাবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম সাধারণ মানুষের দানের অর্থে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রামে ২৪ তলা নিজস্ব ভবন নির্মাণসহ কার্যক্রম আরও বাড়ানোর কাজ শুরু হয়েছে। সমাজের বিত্তবানদের আরও এগিয়ে আসা উচিত। যাতে অসহায় মানুষের পাশে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়াতে পারে।