চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা

৭ মার্চের ভাষণের একটি মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত
৭ মার্চের ভাষণের একটি মুহূর্ত। ছবি: সংগৃহীত

৭ মার্চ আর্ট কলেজে বসেই দেখেছি, সকাল থেকেই রেসকোর্স ময়দানে দলে দলে লোক জড়ো হচ্ছে। এ রকম জনস্রোত, যেন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছে রেসকোর্সে। একেকটা ভিন্ন ভিন্ন ঢেউ আসছে আর মিশে যাচ্ছে অন্যান্য ঢেউয়ের সঙ্গে। কোন ঢেউ আগের, কোনটা পরের, তা বোঝার আর উপায় থাকছে না—যেন একটাই সত্তা। কারও হাতে লাঠি, ফেস্টুন, লগি। বিভিন্ন চেহারা-শ্রেণি-চরিত্রের মানুষ। কেউ হেঁটে আসছে, কেউ রিকশায়, কেউ নিজস্ব যানবাহনে। কিন্তু ওই জায়গায় এসেই সবাই মিলছে, যেটা তাদের গন্তব্য। অচেনা মানুষ, ভিন্ন পরিচয়ের মানুষ যে মুহূর্তে এখানে এসেছে, সেই মুহূর্তে হয়ে যাচ্ছে বিশাল জনস্রোতের অংশ। সে এক অদ্ভুত রকম মিলে যাওয়া, যা ভেবে আজও শিহরিত হই।

আমরা আর্ট কলেজের দিক থেকেই রেসকোর্স ময়দানে ঢুকলাম। দুপুর হতে না হতেই ময়দানে তিল ধারণের জায়গা নেই। আমি জানি, মা সামনের সারিতে বসে আছেন। বোন সাঈদাও গিয়েছিল। যখন সময় হলো, বঙ্গবন্ধু এলেন। সিঁড়ি দিয়ে যখন তিনি মঞ্চে উঠছেন, তখন জনতার হর্ষধ্বনি, উল্লাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, মহাসাগরের পাড়ে দাঁড়ালে যে ভীষণ আলোড়ন অথচ সুসংবদ্ধ ধারাবাহিকতা দেখা যায়, জনতার এই হর্ষধ্বনি, এই উল্লাসও যেন তারই মতো। মনে হয়েছে, এ হলো একেবারে অদম্য একটা শক্তির পরিচয়। এই শক্তিকে কেউ ‘দাবায়া’ রাখতে পারে না। এই মুক্তিকামী মানুষকে কখনো দাবিয়ে রাখা যায় না। মানুষের এই ভিড় দেখে মনে হয়েছে, সমুদ্র কি এর চেয়ে বিশাল, এর চেয়ে উত্তাল, এর চেয়ে গভীর হয়?

বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠলেন, ভাষণ দিলেন। মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে রইল। প্রথম দিকে তিনি বর্ণনা করলেন ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস। শেষে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ কথাটি এমনভাবে বলে নেমে গেলেন, মনে হলো, এর চেয়ে বড় এবং চূড়ান্ত কোনো দিকনির্দেশনা আর কিছুই থাকতে পারে না। কেন যেন আমার মনে হয়েছে, তিনি নেমে যাচ্ছেন, তাঁকে ঘিরে ধরছে জনস্রোত; কিন্তু এই ঘোষণাই আমাদের মনে রণিত হতে থাকল, এই ঘোষণাই আমাদের টেনে নিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের দিকে।

সুলতানা কামাল: মানবাধিকারকর্মী