লোকশিল্পের ভেতর থেকে

গ্রামীণ হাতপাখা
গ্রামীণ হাতপাখা

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় জয়নুল আবেদিন ছিলেন কলকাতায়। ক্ষুধার তাড়নায় দলে দলে গ্রামের মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে খাদ্যের অন্বেষণে কলকাতায় ভিড় করছে। কলকাতার রাজপথে প্রতিবাদহীন এই সরল গ্রামবাসী মৃত্যুবরণ করছে। জয়নুল আবেদিন দেখতে পেয়েছেন তাঁর শৈশব-কৈশোরের সখা ও প্রতিবেশীদের এই অসহায় মৃত্যুবরণ। কালো কালিতে কলকাতার ফুটপাতে মৃত প্রতিবেশীদের ছবি এঁকেছেন গভীর মমতায় বলিষ্ঠ তুলির টানে। ১৯৪৩ সালের এই দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা জয়নুল আবেদিনকে একজন শক্তিমান চিত্রকর হিসেবে খ্যাতি এনে দেয় উপমহাদেশে।

তাঁরই নেতৃত্বে প্রথম ১৯৪৮ সালে এই স্কুলের যাত্রা শুরু হয়। আমাদের সম্মুখে তখন প্রশ্ন ছিল, কোথা থেকে শুরু করব আমরা। আমাদের ঐতিহ্য কী? যদিও আর্ট স্কুলে আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির অনুসরণ ব্রিটিশ স্কুলের ধারায়, যেটা কলকাতা আর্ট স্কুলে চালু ছিল। তা সত্ত্বেও জয়নুল আবেদিনের গ্রামবাংলার প্রতি ভালোবাসা তাঁকে লোকশিল্পের প্রতি আগ্রহী করে তোলে। আমরা দেখেছি তাঁর বৈঠকখানায় দুই আলমারি বোঝাই পুতুল, লক্ষ্মীর সরা, শখের হাঁড়ির বিরাট সংগ্রহ। সেই সঙ্গে নকশিকাঁথার একটি অপূর্ব সংগ্রহ। আমাদের তিনি এসব লোকশিল্পের নিদর্শনগুলো দেখাতেন। কীভাবে এগুলো তৈরি হয়েছে বলতেন। কিশোরগঞ্জের হাতে টেপা পুতুলের প্রতি তাঁর ছিল তীব্র আকর্ষণ। পূজা-পার্বণের সঙ্গে ছেলে-ভোলানোর জন্য এসব পুতুল তৈরি হতো। যত কম সময়ে যত বেশি পুতুল তৈরি করা যায়, ততই লাভ। যার জন্য পুতুলের গড়ন হতো অত্যন্ত সরল। কুমোরকে বাধ্য করত সরলীকরণের জন্য।

জয়নুল আবেদিন
জয়নুল আবেদিন

লোকশিল্প দিয়েই বাংলাদেশের চিত্রকলার উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন। তাঁর স্বপ্ন ছিল একটা লোকশিল্প গ্রাম তৈরির। সোনারগাঁয়ের লোকশিল্প জাদুঘর তাঁরই স্বপ্নের ফসল। স্বপ্নটা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কারুশিল্পী ও লোকশিল্পীদের কয়েক ঘর তুলে এনে সোনারগাঁয়ে স্থাপন করবেন। তাঁরা এখানে তাঁদের সামগ্রী তৈরি করবেন। এখান থেকেই বাজারজাত করা হবে। আধুনিক শিল্পীরা তাঁদের কাজের প্রস্তুত প্রণালি দেখবেন, অনুপ্রাণিত হবেন—পরস্পরের ভাববিনিময়ের মাধ্যমে একটি নতুন শিল্পধারা গড়ে উঠবে।

পোর্টফলিও হাতে মাঝেমধ্যে আমাদের নিয়ে ছবি আঁকতে যেতেন জয়নুল আবেদিন। তাঁর প্রিয় স্পট ছিল বুড়িগঙ্গা নদী ও নৌকা। সারা দিন নৌকা ভাড়া করে এদিক-ওদিক ঘুরতেন। মনমতো বিষয় পেলে ছবি আঁকা শুরু করতেন। আমরা প্যালেটে রং গুলে দিতাম। একদিনের ঘটনা বলি। সারা দিন নৌকা নিয়ে ঘুরছেন, ছবি আর আঁকছেন না। জিজ্ঞাসা করতেই জবাব দিলেন, ‘মিয়া, নৌকার দুলুনিটা আগে অনুভব করি। তারপর না ছবি আঁকা।’

ঐতিহ্যের সবকিছুই স্পর্শ করেছেন জয়নুল আবেদিন। সে স্পর্শ দিয়ে আমাদের স্পর্শ করেছেন। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অস্তিত্ব আমাদের জানা ছিল। জানা ছিল না তাঁর প্রাণের অস্তিত্ব, যে অস্তিত্বের দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর রূপ। সে রূপের সন্ধান জয়নুল আবেদিন আমাদের দিয়েছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা জয়নুল আবেদিনকে আমাদের গুরু হিসেবে পেয়েছিলাম। জন্মভূমি বাংলাদেশের আসল রূপের সন্ধান তাঁর সান্নিধ্যে না এলে হয়তো কোনো দিনই পেতাম না।

‘ঐতিহ্যের স্পর্শ’, প্রথম আলো, ১৪ এপ্রিল ২০১১