গ্রামের মধুর ঈদ

মোশাররফ করিম। ছবি: কবির হোসেন
মোশাররফ করিম। ছবি: কবির হোসেন

করোনাকালে ঈদ বরাবরের মতো স্বাভাবিক নিয়মে হওয়ার মতো নয়। স্মৃতিই এবারের ঈদের বড় সম্বল। আমার ঈদস্মৃতির খাতা খুললে চোখের সামনে কত কিছুই যে ভেসে ওঠে! দেখতে পাই, শামীম নামে ছোট্ট একটি ছেলে তার বাবা কে এম আবদুল করিমের সঙ্গে ঈদের নামাজ পড়তে যাচ্ছে। তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক। এই শামীম আমিই। মা–বাবার দেওয়া ডাকনাম। সবাই আমাকে মোশাররফ করিম নামে চিনলেও পরিবারের কাছে আমি শামীমই রয়ে গেছি।

 আমার শৈশবের ঈদের স্মৃতির বড় অংশই গ্রামকে ঘিরে। সেই দিনগুলোর কথা মনে হলে প্রথমেই মনে পড়ে ভোরবেলা সূর্য ওঠার আগে ঈদের গোসলের কথা। সেই অবগাহনটাই আমার কাছে এখনো বিশেষ হয়ে আছে। আমাদের পিঙ্গলাকাঠি গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে আড়িয়াল খাঁ নদী। ওই নদীতে ঈদ-গোসলের স্মৃতি এখনো আমার কাছে সোনা-রুপামাখা। বহুদিন চেয়েছি সেই আবহটা আবার ফিরে পেতে। কী যে মায়া আর আনন্দঘেরা ছিল গ্রামীণ নদীর সেই গোসলে! ঈদের দিন নদীতে নেমে সাবান মেখে গোসল করতাম। গোসল শেষ হতে না হতে সূর্যের আলো গায়ে এসে পড়ত। চারপাশে নীরবতা ভেঙে একে একে গোসলের জন্য নদীতে সবাই ভিড় জমাত। সবাই গায়ে সাবান মাখছে, কলরব করছে—সে এক দৃশ্য বটে।

 ঈদের দিনটাতে একটা ছোট লাটিম আর ঘুড়ি নিয়েই অনেক আনন্দে কেটে যেত আমার। ইচ্ছামতো ঘুরতাম-ফিরতাম। ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে মিলে আনন্দ করতাম। তখন অতি অল্পতেই অসাধারণ আনন্দ। এর বড় একটা কারণ হয়তো ছেলেবেলায় মনটা থাকে প্রশস্ত নদীর মতো। সেখানে জায়গা অনেক বেশি। ছোট একেকটা ঘটনায় প্রাণখোলা আনন্দ।

 পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত আমি গ্রামের স্কুলে পড়েছি। ঈদের মৌসুমে নতুন জামাকাপড় নিয়ে বেশ একটা আমেজে থাকতাম। বছরে শুধু এক ঈদেই কাপড় পেতাম। তবে ঈদে আমাদের রেডিমেড পোশাক কেনা হতো না, দরজি দিয়ে পোশাক বানানো হতো। সেই পোশাক বানানো নিয়েই ছিল দারুণ উত্তেজনা। রোজার মাঝামাঝি থেকেই অপেক্ষা করতাম, কবে নতুন থান কাপড় কেনা হবে, কখন মাপ দেব এবং কখনই-বা ওই কাপড় পাঠানো হবে দরজির কাছে? অপেক্ষা আর ফুরোয় না। কোনো কারণে কাপড় বানাতে দুয়েক দিন দেরি হলে তা নিয়েও মা–বাবার কাছে থাকত রাজ্যের প্রশ্ন। কেন দেরি হচ্ছে? কবে শেষ হবে? কিন্তু ঈদের পোশাক হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব প্রশ্ন, সব উৎকণ্ঠা ভেসে যেত আনন্দের জোয়ারে।

 খুবই দুরন্ত ছিলাম বলে ছেলেবেলায় আমাকে বেশ শাসনের মধ্যে রাখা হতো। পড়াশোনার যে বাঁধা নিয়মকানুন, তার নড়চড় করা যাবে না, সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সাংঘাতিক কঠিন। তাই সারা বছর চলত ঈদের অপেক্ষা। সে সময়ে শাসন অনেকটা কমে যেত। ভাই-বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, নদীর পাড়ে বসে গান গাওয়া, ইচ্ছামতো ছোটাছুটি করা, হইহুল্লোড়ে মেতে ওঠা—যা খুশি করা যেত তাই-ই। বাড়িতে একটু দেরি করে ফিরলেও কোনো চোখ রাঙানি নেই। ঈদের সময় মনে হতো, জেল থেকে ছাড়া পেয়েছি। কয়েকটা দিনের অবাধ স্বাধীনতা খুবই প্রাণভরে উপভোগ করতাম।

সেই ছোট্ট শামীম, এখন সবাই যাঁকে চেনেন মোশাররফ করিম নামে। ছবি: লেখকের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে
সেই ছোট্ট শামীম, এখন সবাই যাঁকে চেনেন মোশাররফ করিম নামে। ছবি: লেখকের পারিবারিক অ্যালবাম থেকে

চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই, দুরন্ত এক বালক ঈদের প্রহরে পাখির মতো ডানা ঝাপটে গ্রামের আনাচকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে যেন তখন বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর অপু। নদীর পাড়ে ঘাসের ওপর শুয়ে কত যে সময় কাটিয়ে দিয়েছি। আকাশ তখন আরও অনেক বেশি নীল। নদীর ওপর দিয়ে দল বেঁধে ছুটে চলা পাখির কিচিরমিচির। কানে আসত তাদের ঘরে ফেরার শব্দ। নদীর ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার শব্দ ভরিয়ে দিত মন। ঈদের সময়টাতে পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া এই লোভনীয় স্বাধীনতাটুকু এখনো ভীষণ মিস করি।

ছেলেবেলায় আমি শহরেও ঈদ করেছি। শহুরে ঈদ অনেক বেশি শৃঙ্খলায় ঘেরা। শহরের ঈদে নামাজ পড়ে মহল্লায় আড্ডা দেওয়া, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া—এই ব্যাপারগুলোর মধ্যে গ্রামের সঙ্গে অনেক তফাৎ। গ্রামের ঈদ অনেক প্রাণখোলা আর অনন্ত স্বাধীনতায় ভরা। এ জন্যই শৈশবের ঈদ, গ্রামের ঈদ অনেক বেশি তাড়িত করে আমাকে।

ছেলেবেলায় আরেকটা বিষয় দারুণ আনন্দিত করত আমাকে, ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি করা। তবে সমবয়সী বা ছোটদের চেয়ে বড়দের সঙ্গে কোলাকুলি করেই বেশি আনন্দ পেতাম। ঈদ ছাড়া অন্য কোনো সময়ে আমার চেয়ে বড় ও লম্বা কারও সঙ্গে কোলাকুলি করার সুযোগ হতো না। বড়দের সঙ্গে কোলাকুলি করে নিজেকেও খানিকটা বড় ভাবার আনন্দ পেতাম।

 ঈদের কথা লিখতে লিখতে বাবার কথাও মনে পড়ছে। আমি ছিলাম খুব বাবা ন্যাওটা। দেখা যেত, ঈদের দিনে বাবা কোথাও চা খেতে যাবেন, সঙ্গে নিয়ে যেতেন আমাকে। তাঁর হাত ধরে মহানন্দে ছুটতাম আমিও। ঈদ ছাড়াও অনেক সময়ই বাবার সঙ্গে চা খেতে বা বাজারে যাওয়া হতো। মনের কোণে সেই সব স্মৃতি ভিড় করলে অন্তরে একটা বেদনার সুরও গুঞ্জন তোলে। আবার যদি বাবার হাত ধরে চা খাওয়া যেত!

 ঈদ আসে ঈদ যায়। ছেলেবেলার ঈদে নিজের মতো করে কাটানো সেই দিনগুলো খুবই মিস করি। ঈদে এখনো গ্রামে যেতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু চাঁদরাতেও শুটিং থাকে। যাওয়া সম্ভব হয় না। গত ৭-৮ বছরে বরিশালের পিঙ্গলাকাঠিতে আমার গ্রামের বাড়িতে যেতে পারিনি আমি। কেরাম নাটকটি আমার জীবন পাল্টে দিয়েছে। সেটি অসম্ভব দর্শকপ্রিয়তা পাওয়ার পর আমার ব্যক্তিগত সময় হারিয়ে গেছে। মানুষের অপরিসীম ভালোবাসা আমি পেয়েছি। এখন শুটিংয়ের ব্যস্ততায় চাঁদরাতেও গভীর রাতে বাসায় ফিরতে হয়। ফলে ঈদের সময় সকালবেলা নামাজ পড়ে এসে আবার ঘুমোই। ঘুমটাকেই মনে হয় শ্রেষ্ঠ বিনোদন। এবারে করোনার সময়টা অন্য রকম। ঈদ কেমন কাটাব, জানি না। এবার হয়তো প্রথমবারের মতো বাসাতেই ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে।