রোদের অসুখ

তুমি প্রথম কবে, কাকে চুমু খেয়েছিলে?

আচমকা এই প্রশ্ন শুনে লেখক তাকিয়ে থাকে রুবিয়ার দিকে। প্রশ্নটা এই মানুষটার কাছ থেকে শুনলাম! তাকিয়ে দেখা মানুষটার মুখের হাসির ধরন বলে দেয়, হ্যাঁ, তারই করা। তারপরও বিশ্বাস হয় না, রুবিয়া এই প্রশ্ন তাকে করেছে! ভাবা যায় না, দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত স্বামীকে কোনো স্ত্রী এমন প্রশ্ন করতে পারে।

খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না, কী বলা উচিত।

না, এখনই তোমাকে বলতে হবে না। বলবে কুড়ি তারিখে।

কথা আর না বাড়তে দিয়ে উঠে যায়। যায় চা বানাতে। বারান্দায় বসে দুজনের চা খাওয়ার সময় এটা।

এ দুইয়ের বিয়ের কুড়ি বছর পূর্ণ হবে কুড়ি তারিখে। দিন দশেক পর। কুড়ি কুড়ি কুড়ি। অতি বিশেষ দিন। 

অলস দুপুরে তালাত মাহমুদ এল লেখকের বাড়িতে। হাতে লম্বা আকৃতির টিফিন ক্যারিয়ার। গুঁড়ো মাছ থেকে পাঙাশ পর্যন্ত ছয় প্রকারের মাছ রান্না করে পাঠিয়েছে লতা, প্রকাশকের স্ত্রী। খুব ভালো রাঁধুনি সে। মাঝে মাঝেই এ রকম মাছ রান্না করে দুজনে বা কখনো এই রকম একাই হাজির হয়ে যায় তালাত।

রুবিয়া জানে, খাওয়া নিয়ে খুব হইহই নেই, কিন্তু রান্নায় বৈচিত্র্য রেজার খুব পছন্দ।

তালাত এসেছিল একটা সারপ্রাইজ দেবে মনে করে। ভেবেছিল রোদের অসুখ বইটা কুড়ি তারিখে বের করে ফেলবে। তবে তাকে সাফ বলে দিতে হলো, কুড়ি তারিখ তারা ঢাকায়ই থাকছে না। অনেক আগে থেকেই এটা প্ল্যান করে রাখা।

রোদের অসুখ প্রকাশের তারিখ পিছিয়ে গেল। রুবিয়ার প্রশ্ন, সেটা উনিশ তারিখে করা যেত না?

না, আমরা কক্সবাজার চলে যাচ্ছি উনিশে। 

ঢাকা ছেড়ে অন্য কোথায় যাওয়া যেতে পারে, দুজনে মিলেই ঠিক করতে বসেছিল এটা। রুবিয়ার প্রথম সিদ্ধান্ত, অবশ্যই দেশের বাইরে নয়। পাঁচটা জায়গার কথা ভেবে রুবিয়া আটকে দিয়েছিল কক্সবাজার। সমুদ্র খুব প্রিয় তার।

তুমি অন্য কোথাও চাও কি না বলো?

না, ইচ্ছা শুধু দুজনে মিলে কোথাও চলে যাব, দুজনে দুটো দিন কাটাব যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে। পরিচিত কেউ থাকবে না আশপাশে, ব্যস। 

সিলেট থেকে পিউ আর আদিব ফোন করেছিল, ‘তোমরা আমাদের এখানে চলে এসো।’ পিউয়ের ছেলেমানুষির কথা তো মা–বাবার জানা। কত কী প্ল্যান করে রেখেছে দাঁড়ি-কমা ছাড়া বলে যেতে থাকল। রুবিয়া বুঝিয়ে বলেছে, কুড়ি তারিখটা আমরা আমরা নিজেরাই কাটাতে চাই। ঢাকাতে থাকছি না। কক্সবাজারে যাচ্ছি। টিকিট করা হয়ে গেছে, তোর বাবা হোটেলও বুক করে ফেলেছে। উনিশ তারিখ সকালেই উড়ব। 

লেখক তাপস রেজার মাথায় ঘুরছে, কবে, কাকে প্রথম চুমু খেয়েছি—জানতে চেয়েছে রুবিয়া। এত বছরের বিবাহিত জীবন। দুজনের মুখস্থ দুজনকে। এমন একটা প্রশ্ন দীর্ঘকাল ঘরসংসার করার পর আচমকা স্ত্রীর মনে উদয় হবে, হতে পারে কোনো দিন—কখনো তা ভাবতেই পারেনি। প্রশ্নটা আচমকা উদয় হয়েছে নাকি এত বছর ধরে মনের ভেতর অবিরাম সে প্রশ্নের জ্বালাতন ছিল?

রেজা আর রুবিয়ার বয়সের পার্থক্য রয়েছে—তা বিশেষভাবে বলা, ভাববার মতো নয়। তাদের বিয়েটা পারিবারিক উদ্যোগে হয়েছিল। দুজনের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণায় পার্থক্য ছিল। স্বাভাবিক পার্থক্য। তা নিয়ে কখনোই সম্পর্কে সামান্য টানাপোড়েনও তৈরি হয়নি।

সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আগ্রহ নেই রুবিয়ার। প্রথম প্রথম সেটা নিয়ে অস্বস্তি হতো। আস্তে আস্তে সয়ে গিয়েছিল। লেখকের বউয়ের সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ থাকতেই হবে বা থাকলে ভালো—এমন ধারণা যদি কারও থাকে, সে তাদের মনগড়া ধারণা। তাপস রেজার নামের আগে যে ‘খ্যাতিমান লেখক’ বলা হয়ে থাকে, সে খ্যাতি দখিনের বাতাসে উড়ে আসেনি। জোর দিয়েই বলতে পারে রেজা, লেখকের স্ত্রীর যদি সাহিত্য নিয়ে বিশেষ আগ্রহ, কৌতূহল না থাকে, মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। প্রমাণ দুজনের ঝলমলানো সংসার।

দুজন দুই ভুবনের, দুজন মিলে যে ভুবন তারা রচনা করেছে, সেখানে অপূর্ণতার অনুভব কখনোই ঠাঁই খুঁজে পায়নি। 

সংসারে অপূর্ণতার ঠাঁই মেলেনি, এমন অনুভব থেকে হু৩ট করেই রুবিয়ার মধ্যে জাগে প্রশ্নটা, দীর্ঘকাল তাহলে কি তাদের ভুল জানাজানির মধ্যে বসবাস ছিল?

ফোন বেজে ওঠে। তালাত ফোন করেছে।

রেজা ভাই, কুড়ি তারিখের লোভ সংবরণ করতে বাধ্য হয়েছি, কিন্তু বইটা শেষ করে রাখতে চাইছিলাম। বলেছিলেন, নামটা রোদের অসুখ রাখবেন কি না ভাবছেন।

ওই নামই থাকবে। রোদ তো ভালোবাসাই। আর ভালোবাসা শুধু সুখময় নয়, হয় না। তারপর এদিক-সেদিক কথা গড়িয়ে শেষ হয়ে যায়। 

রুবিয়া এল। হাতে ট্রে। তাতে দুটো বাটিতে আম ফালি করে কেটে এনেছে। দুটো কাঁটা চামচ লেজ উঁচু করে দাঁড়িয়ে দুই বাটিতে। ট্রেটা নামিয়ে রাখে চা-টেবিলে। ফালির আকৃতি দেখে বোঝা যায় আমগুলো বেশি বড় ছিল না, কিন্তু চমৎকার সুগন্ধ।

চা একটু পরে খেয়ো। আমগুলো তিন দিন আগে কিনে এনেছিলাম। এখন দেখছি কয়েকটা পেকে নরমও হয়ে গেছে। খুব সুন্দর ঘ্রাণ।

হ্যাঁ, তুমি এসে দাঁড়ানোমাত্র পেয়েছি।

কে ফোন করেছিল?

তালাত। বেচারা হতাশ হয়েছে। খুব আনন্দ-আশা নিয়ে এসেছিল। ওরা ভাবে, আমার সঙ্গে, আমাদের সঙ্গে অন্য রকম সম্পর্ক। প্রকাশক-লেখক সে সম্পর্ক তো রয়েছেই। ফোন করে রোদের অসুখ নামটা নিয়ে কথা হলো। ওটাই থাকবে নাকি বদলে দিতে চাই। ওটাই রেখে দিতে বললাম।

বোধ হয় বলতে ভুলে গেছ, ওর বউয়ের ফোন নম্বর চেয়েছিলাম।

সরি, ভুলেই তো গেছি। দাঁড়াও এখনই চেয়ে নিচ্ছি।

না না, অত অস্থির হওয়ার দরকার নেই। পরে চেয়ে নিয়ো। ছিল আমার কাছে, কথাও হয়েছে বার কয়েক, কিন্তু নম্বরটা সেভ করতে ভুলে গেছি। মেয়েটার রান্নার হাত দারুণ। একবার চিংড়ি মাছ আর কচুরমুখি রান্না করে পাঠিয়েছিল, মনে আছে?

‘হুম’ বলে আমে ডুবে যায় রেজা। সে ডোবা একধরনের লুকিয়ে যাওয়া। ভয়ে লুকানো। ভয় রুবিয়াকে। যদি সে বুঝে ফেলে। তার ভীষণ এক প্রশ্নে লেখক মহাশয় বেজায় পেরেশান হয়ে আছে। 

পালিয়ে বেড়াতে থাকলে পেরেশানি থেকে মুক্তি মিলবে না। কুড়ি তারিখ আসতে আরও পাঁচ দিন বাকি। সেদিন আম খেতে গিয়ে একবারও রুবিয়ার দিকে তাকাতে পারেনি রেজা। তাকাতে সাহস হয়নি। কে ফোন করেছিল, প্রশ্নে অযথা যে লম্বা ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করেছিল, তা বড়ই অস্বাভাবিক ছিল। উত্তর জানবার অতি আগ্রহে কে ফোন করেছিল, প্রশ্ন করেনি রুবিয়া। দাম্পত্যে এ রকম অজস্র এমনি এমনি প্রশ্ন থাকে, অভ্যাসজনিত।

এলোমেলো অদরকারি ভাবনা মনের মধ্যে জটলা পাকাচ্ছে। তাতে বেড়ে চলেছে অস্বস্তি। তবে যে মানুষটা এক প্রশ্নে এলোমেলো বাঁধিয়ে দিয়েছে, তার ভেতরে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তা-ও দেখতে হচ্ছে লুকিয়ে। নিকটে থাকাকালে সতর্ক থাকতে হয়, চোখে যেন চোখ না পড়ে যায়। পড়ার ভয়। রেজার মনে হতে থাকে, এক প্রশ্ন জীয়নকাঠি হয়ে যেন দশটা প্রশ্নের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। 

রুবিয়া কি জানতে চায়, বিয়ের আগে কেউ পছন্দের ছিল কি না, তার লেখক স্বামী কাউকে ভালোবাসত কি না? কতগুলো সম্পর্ক ছিল, কোনটা কী ধরনের সম্পর্ক? এত দিন পরে এই সব জানবার ইচ্ছা কেন? স্বামী হিসেবে হয়তো বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে, কিন্তু দীর্ঘ দাম্পত্যজীবনে সজ্ঞানে অসততা করেছে বলে তো রেজার মনে পড়ে না। মনে করবার চেষ্টা করে সে, গত কয়েক মাসে এমন কিছু আচরণ কি করেছে যাতে স্বামী মানুষটাকে অপরিচিতের মতো মনে হতে পারে, লুকানো আর এক জীবন রয়েছে—সন্দেহ জাগিয়ে দিতে পারে?

বিয়ের রাতের একটা ঘটনা মনে পড়ে যায় রেজার। রুবিয়া নতুন বউদের মতো মুখের সামনে আধা হাত ঘোমটা টেনে বসে ছিল না। কত গল্প বানাতে পারে লেখক মহাশয় কিন্তু সেই রাতে বলার জন্য কিছুই খুঁজে পাচ্ছিল না। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মুনিমের গল্পটা। মনে পড়তেই এক পশলা হেসে নেয় তাপস রেজা।

এ রকম বিয়ের রাতে আমার এক বন্ধু মুনিম গল্প করার মতো কিছু না পেয়ে নতুন বউকে তার পুরোনো প্রেমের গল্প শুনিয়েছিল। হা হা হা সাতাশ বছর হতে চলল, সেই রাত থেকে সত্য বলার ফল ভোগ করে চলেছে বেচারা মুনিম।

সে রাতে কথা শুরুর গল্প হিসেবে মুনিমের গল্পটা চমৎকারই ছিল। রেজা-রুবিয়া দুজন দুজনের কাছে সহজ হতে পেরেছিল।

সেই প্রথম রাত থেকে রুবিয়া কি তার স্বামীর প্রেমের গল্প শোনার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় ছিল! এমনটা ভাববার মতো সামান্য ঘটনা কখনো ঘটেনি, নিশ্চিত করে বলতে পারে রেজা। রুবিয়া রক্তমাংসের মানুষ, তার স্ত্রী না হয়ে যদি গল্পের কোনো চরিত্র হতো, হয়তো ভাবা যেত, বাসর রাত, বন্ধুর কাণ্ড নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়েছে, কিন্তু শত গল্পের রাতে বিশেষ একটা গল্প শোনার বাসনা রয়েই গিয়েছিল নতুন বউটার মনে।

মনে সাহস জড়ো করে রেজা। কুড়ি বছরের সুখরক্ষায়, তারিখের জন্য অপেক্ষা করা চলবে না। যদি নিজের কোনো গল্প না থাকে, মনজুড়ে যাতনাকে লেজ নাড়তে দেওয়া কেন? 

বারান্দায় চাঁদের আলো লুটোপুটি খায়, চাঁদ থাকে গাছপাতাদের আড়ালে। অদেখার একটা আলাদা টান রয়েছে। প্রমাণ মিলে যায়। ঠিক একই সময়ে অদেখাকে নিয়ে ভাবছিল তারা দুজনে। রুবিয়া বলল, ‘বারান্দায় পাই চাঁদের আলো, তার আলো দেখি, তাকে দেখতে পাই না—এটা আমার খুব ভালো লাগে।’ রেজার দিকে তাকায়, ‘তোমার?’

আমারও।

তারপর দুজন মানুষ, স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ের তারা। কথাহীন থাকে। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ। বাতাস আলোমাখা পাতাদের নিয়ে খেলে। সমস্ত চরাচরে যেন ওই একটাই শব্দ, ডানা মেলে উড়তে থাকে। সেই অনন্তের ঘোরের মধ্য থেকে অসীম এক মানবকণ্ঠের প্রতিধ্বনি হয়—

লেখক, তোমার মনে এখন যে কথা, আমার মনেও উড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সেই কথা।

রেজা ভাসতে ভাসতে তাকায় রুবিয়ার দিকে। মন থেকে মন্দ অনুভব, অস্বস্তি একদল ঘুড়ির মতো এক সাথে সুতো কাটাকাটি করে কোন সুদূরে উধাও হয়ে যায়। 

ছাপাখানায় ঝড়ের গতিতে ছাপা হচ্ছে রোদের অসুখ। সেই শব্দ টপকে লেখক তাপস রেজা স্ত্রীর উদ্দেশে দৃঢ় স্বরে বলে, ‘এমন কেউ ছিল না, রুবিয়া।’

রুবিয়া যেন অনেক দূর থেকে তাকিয়ে রয়েছে। দূরের রুবিয়ার মুখে কাছের মানুষের হাসি।

কুড়ি তারিখেই বলবে।

আমার কোনো গল্প নেই।

বলবে, কুড়ি তারিখে

সত্যিই কোনো গল্প নেই, রুবিয়া।

তা কুড়ি তারিখে বলার জন্য কি বিশেষ নয়? আর শোনো, কুড়ি তারিখে আমাকেও তুমি প্রশ্নটা কোরো, প্রথম কবে কাকে চুমু খেয়েছিলে?