জামদানি: শুধুই বাংলাদেশের

জামদানি শাড়িতে তিশা
জামদানি শাড়িতে তিশা

আমরা যাঁরা জামদানি নিয়ে কাজ করি, বেশ কিছুদিন ধরেই কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি। প্রশ্নগুলো অনেকটা এ রকম—‘ইন্ডিয়া নাকি জামদানির পেটেন্ট (স্বত্ব) দাবি করেছে’, ‘আমাদের নাকি চড়া দামে (কর) জামদানি কিনতে হবে’, ‘জামদানি নাকি আর বাংলাদেশের থাকবে না’। এই প্রশ্নগুলো আসছে কারণ কিছুদিন আগে ভারত কালনা জামদানি এবং উপাধা জামদানি নামে দুটি শাড়ির নিবন্ধন চেয়ে আবেদন করেছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ২৩টি চুক্তির একটি বাণিজ্যসম্পর্কিত মেধাস্বত্ব চুক্তি (ট্রিপস)। এই চুক্তির ২৭.৩(খ) ধারায় পেটেন্ট করার বৈধ অধিকার রাখা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব প্রাকৃতিক, মানুষের তৈরি, কৃষিজাত পণ্য দীর্ঘকাল ধরে উৎপাদিত হয়ে আসছে, তার ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের মালিকানা প্রতিষ্ঠার জন্য ভৌগোলিক নিদর্শক আইন করে নিবন্ধন করার বিধান রাখা হয়েছে। ভারত সরকার ১৯৯৯ সালেই আইনটি করে ফেলে। বাংলাদেশে ২০০৯ সালে আইনের খসড়া করা হলেও আইনটি পাস হয়নি। তবে ভারতের এই উদ্যোগের কারণে সংসদে গত ৬ নভেম্বর ২০১৩ সালে আইনটি পাস হয়। বর্তমানে ন্যাশনাল ক্রাফট কাউন্সিল অব বাংলাদেশ, ব্র্যাক, সিপিডির সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছে জামদানি বিষয়ে গবেষণাপত্র। আর এই গবেষণাপত্রটি তৈরি হয়ে গেলেই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জামদানির পেটেন্ট চেয়ে আবেদন করা হবে। আমরা ‘জামদানি’ নামেই নিবন্ধন করিয়ে স্বত্ব দাবি করব। জানিয়ে রাখা ভালো, বাংলাদেশের প্রতিবাদের কারণে বর্তমানে ভারতের কালনা ও উপাধা জামদানির নিবন্ধন স্থগিত রয়েছে।
জামদানি একান্তই আমাদের। বাংলাদেশের। জামদানির ইতিহাস বহুদিনের। ঢাকা শহরের আশপাশের নিজস্ব কাঁচামালে তৈরি এবং ঢাকার তাঁতশিল্পীদের মৌলিক শিল্পবোধ ও ধ্যান-ধারণায় সৃষ্টি। জামদানির ইতিহাস বলতে গেলে খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে মসলিনের নাম। ঢাকার কাছে কাপাসিয়াসংলগ্ন অঞ্চলে পাওয়া যেত কার্পাস তুলা। সেই তুলা হাতে কেটে সুতা তৈরি হতো। আর মসলিনের জন্য যে সুতা ব্যবহার হতো তা ২৫০-৩৫০ কাউন্টের। এই সুতায় বোনা মসলিন কখনো গায়ে চড়েনি সাধারণ মানুষের। রাজা-বাদশা, জমিদারেরাই ব্যবহার করতেন। বিদেশি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের তাঁদের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো এই ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাক। মসলিন কাপড়ে যে পদ্ধতিতে বুননের মাধ্যমে নকশা হয়, তা-ই হলো জামদানি। মনে রাখতে হবে, একসময়ের মসলিন আর এখনকার জামদানি, সব সময় উচ্চবিত্তের জন্য। তবে হ্যাঁ, জামদানি শাড়ি ব্যবহার করতে বিত্তের সঙ্গে চিত্ত থাকাও জরুরি।
বহু আগেই জামদানি শাড়ির জনপ্রিয়তা দেশ ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বিদেশেও। বাঙালি মেয়ে বিদেশে যাওয়ার সময় তার স্যুটকেসে একটা হলেও জামদানি শাড়ি রাখবেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী তো সব সময়ই আর নারী মন্ত্রীরা বিদেশে গেলেই জামদানি পরেন। সর্বোপরি জামদানি বাংলাদেশের একটা ব্র্যান্ড। ফ্যাশন মহলে বাংলাদেশের পরিচিতি মসলিন জামদানির দেশ হিসেবেই। তাই বাংলাদেশের মেয়েদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, যখনই বিদেশে যাবেন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে একটা হলেও জামদানি শাড়ি নিয়ে যান। এই জামদানিটিই তাক লাগিয়ে দিতে পারে অন্যদের।
বিয়ের শাড়ি মানেই বেনারসি বা জর্জেটে পুঁতি-চুমকির কাজ। কিন্তু এসব থেকে বেরিয়ে এসে একটা জামদানি পরে দেখুন বিয়েতে। তিন-চার মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করে বিয়ের শাড়িটা তৈরি করাতে পারেন; তাতে প্রকাশ পাবে আভিজাত্যের। জামদানি মানে তো কেবল ছয় গজের শাড়িই নয়, বরং এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও ঐতিহ্য।

সাদিয়া ইসলাম মৌ পরেছেন অনন্য বুনটের জামদানি শাড়ি
সাদিয়া ইসলাম মৌ পরেছেন অনন্য বুনটের জামদানি শাড়ি


জামদানির বুনন একে করে তুলেছে অনন্য। এই বুনন যেমন পৃথিবীর আর কোনো দেশের তাঁতিদের পক্ষে বোনা সম্ভব নয়, তেমনি অন্য কোনো জায়গাতেও করা সম্ভব নয়। অনেকেই চেষ্টা করেছে। এমনকি বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলেও জামদানি বুননের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সম্ভব হয়নি। এ শাড়ির তাঁতিরা সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নেই। আদিকাল থেকেই ঢাকার কাছে রূপগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁ উপজেলার কিছু অঞ্চলে এ গুণী তাঁতিদের বংশানুক্রমে বসবাস। এই শাড়ি কেবল একজন তাঁতি বুনে যাবেন তা নয়। বরং শাড়ি প্রস্তুত হওয়ার প্রতিটি পর্যায়ে চাই পারিবারিক সহযোগিতা। একসময় হাতে সুতা কাটা, সেই সুতায় রং দেওয়া, নাটাইয়ে সুতা পেঁচানো, তারপর সেটা মাকু করা—এই ধাপগুলো বাড়িতেই হতো। বাড়ির বউ-ঝিরাই এসব করত। সুতা কাটা, রং দেওয়ার ঝামেলা না থাকলেও এখনো বাড়ির মেয়েদের জামদানি তৈরিতে অনেক দায়িত্বই পালন করতে হয়। তাঁতে টানায় যে সুতা বসানো হয়, সেই কাজের নাম হাজানি বা সাজানি। এটা মেয়েরাই করে থাকে। টানামাটির গর্তে যে খটাখট তাঁত চালানো হয় তাতে ওস্তাদের পাশে যে শাগরেদ সে তো নিজের ছেলে কিংবা জ্ঞাতি থেকেই আসত। তাই সানার টানে মাকু চালিয়ে যখন জামদানি শাড়ির নকশা ফুটতে শুরু করে, তা শেষ পর্যায়ে গিয়ে আর শাড়ি থাকে না, বরং হয়ে ওঠে তাঁতশিল্পের শিল্পিত ক্যানভাস। আর এই শাড়ির মাঝেই গাঁথা হতে থাকে তাঁতিদের জীবনে ছোটখাটো দুঃখ-ব্যথা। নকশায় মিল থাকলেও জামদানি শাড়ি আসলে একেকটি মাস্টার পিস। শাড়ি তৈরির সময় (তাঁতে থাকতেই) মাড় দিতেও চাই পারিবারিক সহযোগিতা। তা ছাড়া শীতলক্ষ্যার পানি থেকে উঠে আসা বাষ্প সুতার প্রস্তুতি ও কাপড় বোনার জন্য খুবই জরুরি। এর দ্বারা এ সত্যই প্রমাণিত হয়, পরিবেশ আর প্রকৃতির প্রভাবই ‘প্রধান’ হয়ে কাজ করে লোকশিল্প সৃষ্টির মূলে।
জামদানি শাড়ির মূল আকর্ষণ এর নকশা বা মোটিফে। জ্যামিতিক ডিজাইনের নকশা দেখলেই বোঝা যায় যে এটা জামদানি শাড়ির। এ নকশা সাধারণত কাগজে এঁকে নেওয়া হয় না। জামদানির শিল্পীরা নকশা আঁকেন সরাসরি তাঁতে বসানো সুতোয় শাড়ির বুননে বুননে। আবার কখনো কখনো তাঁরা ফরমায়েশি কাজও করেন। তখন হয়তো তাঁরা ডিজাইনারের নির্দেশনা মেনে শাড়ির রং নির্ধারণ করেন। কিন্তু নকশা তো সেই আদি প্যাটার্ন বজায় রেখেই হবে। তাঁরা এমনি পারদর্শী যে মন থেকেই চিন্তা করে ভিন্ন ভিন্ন নকশা আঁকেন। প্রচলিত বেশ কিছু পাড়ের নকশার মধ্যে সবচেয়ে বহুল ব্যবহূত পাড় হচ্ছে করলা পাড়। এ ছাড়া ময়ূর প্যাঁচ, কলমিলতা, পুঁইলতা, কচুলতা, গোলাপচর, কাটিহার, কলকা পাড়, কাঠপাড়, আঙুরলতা ইত্যাদি। শাড়ির জমিনে গোলাপফুল, জুঁইফুল, পদ্মফুল, তেছরী, কলার ফানা, আদার ফানা, সাবুদানা, মালা ইত্যাদি নকশা বোনা হয়। এ নকশা তোলার পদ্ধতিটিও বেশ মজার। শিল্পীদের মুখস্থ করা কিছু বুলি রয়েছে। এসব বুলি ওস্তাদ শাগরেদকে বলতে থাকে আর শাগরেদ তা থেকেই বুঝতে পারে যে ওস্তাদ কোন নকশাটি তুলতে যাচ্ছেন।
নিজস্ব বুলিতে এই ছড়া নকশা তৈরির ফর্মুলাবিশেষ। নকশার পুরো কাজটি হাতে করতে হয় বলে সময় বেশি লাগে। পুরো জমিনে নকশা করা একটি মোটামুটি মানের শাড়ি তৈরি করতে ন্যূনতম সময় লাগে চার সপ্তাহ বা এক মাস। তবে হাটে যেসব শাড়ি বিক্রি হয় তা এক সপ্তাহেই একটা করে ফেলা সম্ভব। সুতা বা রঙের জন্য দামে যে পার্থক্য হয়ে থাকে, তার চেয়ে অনেক বেশি তারতম্য হয় কাজের পার্থক্যের জন্য। জামদানি শাড়ির দাম নির্ভর করে শাড়ির গাঁথুনি এবং সুতার কাউন্টের ওপর। যত বেশি কাউন্টের সুতা, শাড়ির দামও তত বেশি। সেই সঙ্গে নকশা তোলার সুতার কাউন্টও হতে হবে কম এবং নকশাও হতে হবে ছোট ছোট।

.
.

অনেকেই অভিযোগ করেন জামদানি শাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। ভালো দামে একটা শাড়ি কিনে দেখুন। কখনোই নষ্ট হবে না। আর যখন তুলে রাখবেন, বেশিদিন না পরা অবস্থায় রাখা যাবে না।
প্রতি সপ্তাহে শুক্রবার শীতলক্ষ্যার পাড়ে ভোররাত থেকে জামদানির যে হাট বসে তাও কিন্তু দেখার মতো। লাল, নীল, হলুদ সবুজ, গোলাপি, আসমানি কোন রংটা নেই সে হাটে! জামদানি এমন একটি শিল্প, যেখানে যান্ত্রিক কর্মকাণ্ড একেবারেই বিকল। জামদানির পুঁজি হচ্ছে অভিজ্ঞ ও দক্ষ শিল্পীর মেধা, মৌলিকতা, নিষ্ঠা, ধৈর্য, শ্রম। দিনে দিনে জামদানি তাঁতিদের বংশধরেরা তুলনামূলকভাবে কম শ্রমে অধিক উপার্জনের পেশায় আকৃষ্ট হচ্ছে। মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের কারণে আঁকড়ে থাকলেও যারা নতুন কাজ করছে তারা আপসে অনাগ্রহী। কিন্তু আমাদের এই ভীষণ নিজের ঐতিহ্যকে আমাদেরই লালন করতে হবে। ভালো দামে জামদানি কিনে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ভালো জামদানি আর তাঁতিদের।
মনিরা এমদাদ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির