আমাদের বিশ্ব ঐতিহ্য

সোমপুর মহাবিহার, কালের পরিক্রমায় এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার
সোমপুর মহাবিহার, কালের পরিক্রমায় এর নাম হয়েছে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার

ইউনেসকো ঘোষিত সারা বিশ্বের ৭৫০টি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার এবং ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট বাংলাদেশের দুটি গৌরবময় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

সোমপুর মহাবিহার
আজ থেকে প্রায় এক হাজার ২০০ বছর আগে সম্রাট ধর্মপাল কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল সোমপুর মহাবিহার। তিব্বতীয় সূত্রে জানা যায়, সোমপুর ছাড়াও জগদ্বিখ্যাত নালন্দা, ওদন্তপুর, বিক্রমশীল ও জগদ্দল মহাবিহার পরিচালিত হতো পাল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো এসব বৌদ্ধবিহারে দেশ-বিদেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থী বৌদ্ধধর্ম ও দর্শন ছাড়াও চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষিপ্রযুক্তি, গণিত প্রভৃতি চর্চা করতেন। কিন্তু ১২ শতক থেকে নানা কারণে সোমপুর মহাবিহারের যশ ও খ্যাতি কমতে শুরু করে এবং আস্তে আস্তে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যায় প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর ইউনিয়নের সমতল ভূমিতে একটি ঢিবিতে পরিণত হয় জগদ্বিখ্যাত সোমপুর (চাঁদের শহর) মহাবিহার (উচ্চমার্গের মঠ)।
সমতল ভূমিতে প্রায় ৮০ ফুট উঁচু ঢিবি স্থানীয় লোকজনের কাছে পাহাড় সমতুল্য মনে হতো, তাই তাঁদের কাছে এর আধুনিক নাম হয় পাহাড়পুর। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাহাড়পুরে আবিষ্কৃত হয় উপমহাদেশের একক সর্ববৃহৎ বৌদ্ধবিহার। ২৭৪ মি.–২৭৪ মি. বর্গাকৃতি পরিকল্পনায় চারটি বাহুতে ১৭৭টি ভিক্ষুকোঠা নির্মিত হয়েছিল সোমপুর মহাবিহারে। অধিকাংশ ভিক্ষুকোঠার মেঝেতে নিরেট মঞ্চ, মূর্তিধারক ফোকর ও কুলুঙ্গি ছিল। ভিক্ষুকোঠাগুলোর সামনে লম্বা টানা বারান্দাও ছিল। মাঝখানে ছিল অসাধারণ এক মন্দির। ক্রুশাকৃতির মন্দির ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র ও শিল্পশাস্ত্রে সর্বতোভদ্র মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরের তলপত্তন ৬৩টি প্রস্তরমূর্তি দ্বারা সুশোভিত ছিল। এটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে এদের মধ্যে মাত্র একটি মূর্তি বৌদ্ধ, বাকি ৬২টি হিন্দুধর্মাবলম্বীর। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, পঞ্চম শতকের একটি জৈন বিহারের ওপর পাল আমলের বৌদ্ধবিহারটি নির্মিত হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে ইউনেসকো ‘পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ধ্বংসাবশেষ’ নামে সোমপুর মহাবিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনুধাবন না করে আবিষ্কৃত বিহারের নামকরণ করা হয়েছে ‘পাহাড়পুর বিহার’ । প্রাচীন লিপিতে বিহারের নাম ‘সোমপুর মহাবিহার’ সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও শুধু স্থান নাম বিবেচনায় পাহাড়পুর বিহার নামকরণ যৌক্তিক নয়।
পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক ও সংরক্ষণবিদের অভাবে সোমপুর মহাবিহারের সংরক্ষণ ‘যথাবস্থায় মেরামত’ প্রত্নতত্ত্বের নীতিমালা অনুযায়ী সম্পন্ন হয়নি। বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্তির পর পাহাড়পুর বিহারের সংরক্ষণ কাজে অনেক অর্থ ব্যয় করা হয়েছে সত্য, কিন্তু সার্বিক অবস্থার উন্নতির চেয়ে অবনতি হয়েছে আরও। সিমেন্ট, নয়া ইট, নয়া পোড়ামাটির ফলক ইত্যাদি যোগ করে প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের আদি বৈশিষ্ট্য খর্ব করা হয়েছে অনেকাংশে। জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা প্রভৃতি সমস্যাও প্রকট আকার ধারণ করেছে। মিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ হয় ঠিকই কিন্তু কাজের কাজ হয় না মোটেও। প্রজেক্ট বিবেচনায় অনেকের কাছে পাহাড়পুর বিহার যেন শিয়ালের কাছে কুমিরের বাচ্চা।

ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট

ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ


ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট নামে বাংলাদেশের আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় ১৯৮৫ সালে। বাগেরহাট জেলা শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে প্রাচীন খলিফতাবাদ নগরের অংশবিশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৩৬-১৪৫৯ খ্রি.) জনৈক খানজাহান কর্তৃক খলিফতাবাদ এলাকা মুসলিম অধিকারে আসে। সীমিত প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননেই জলাভূমি এলাকায় প্রায় ১০টি মসজিদ, মাজার, প্রাচীন পাকা রাস্তা, সেতু, দিঘি প্রভৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে। বলা হয়, খানজাহান হাবেলি কসবায় (বাগেরহাট) তাঁর দুর্গবেষ্টিত সুরক্ষিত রাজধানী শহর খলিফতাবাদ ছাড়াও মারুলি কসবা, পৈগ্রাম কসবা ও বারো বাজারে (যশোর) আরও তিনটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। সঠিক প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার অভাবে শহরগুলোর বিস্তারিত এখনো জানা সম্ভব হয়নি।
খানজাহানের প্রধান কীর্তি ষাটগম্বুজ মসজিদ ও তাঁর সমাধি। বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদগুলোর মধ্যে বৃহত্তম এবং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম চিত্তাকর্ষক নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ। বাইরের দিক থেকে এর পরিমাপ চার কোনায় অবস্থিত দ্বিতল টাওয়ারসহ উত্তর-দক্ষিণে ৪৯ মি. এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৩৩ মি.। মসজিদটিতে রয়েছে মোট ১০টি মিহরাব। পূর্ব থেকে পশ্চিম দৈর্ঘ্য বরাবর প্রসারিত বিশাল কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ দেখতে খুব আকর্ষণীয়। ৮১টি গম্বুজসমৃদ্ধ মসজিদের বিশাল ছাদের ভার বহন করছে ষাটটি পাথরের স্তম্ভ।
কেন্দ্রীয় নেভের ওপর চৌচালা ভল্ট রীতিটি বাংলার চৌচালা কুঁড়েঘর রীতি থেকে নেওয়া হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
এই মসজিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো কেন্দ্রীয় মিহরাবের পাশে পশ্চিম দিকে নির্মিত একটি প্রবেশপথ। আমাদের দেশে এটি অপ্রচলিত হলেও উত্তর ভারতে দেখা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, মিহরাবের পাশে পশ্চিম দিকের এই প্রবেশপথটি খলিফা, গভর্নর বা ইমামরা ব্যবহার করতেন।
ষাটগম্বুজ নামটি নিয়ে একটি বিভ্রান্তি প্রচলিত আছে। আক্ষরিক অর্থে ষাটগম্বুজ অর্থ হলো ষাটটি গম্বুজসংবলিত। কিন্তু মসজিদটির ছাদে ৭৭টি এবং চার কোণে কর্নার টাওয়ারের ওপর চারটি—মোট ৮১টি গম্বুজ রয়েছে। নামকরণ নিয়ে পণ্ডিতেরা দুটি সম্ভাবনার কথা বলেন:
১. কেন্দ্রীয় নেভের ওপর স্থাপিত সাতটি চৌচালা মসজিদটিকে সাত গম্বুজ মসজিদ হিসেবে পরিচিত করে, কিন্তু সময় পরিক্রমায় এই সাত গম্বুজই ষাটগম্বুজ হিসেবে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
২. মসজিদের বিশাল গম্বুজ ছাদের ভারবহনকারী মসজিদ অভ্যন্তরের ষাটটি স্তম্ভ সম্ভবত একে ষাট খামবাজ (স্তম্ভ) হিসেবে জনপ্রিয় করে তোলে। এটি অসম্ভব নয় যে, ‘খামবাজ’ শব্দটি পরবর্তীকালে বিকৃতরূপে গম্বুজ-এ পরিণত হয়ে মসজিদটি ষাটগম্বুজ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
খানজাহান রীতির আরেকটি স্থাপত্য কীর্তি হলো এক-গম্বুজবিশিষ্ট একটি সমাধিসৌধ। সৌধটি ভেতরের দিকে ইট-নির্মিত গোলার্ধ আকৃতির গম্বুজ দ্বারা সম্পূর্ণ আবৃত। এ গম্বুজ দেয়ালের ভেতরে পাথরের ব্রাকেট থেকে বেরিয়ে আসা স্কুইঞ্চ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কোণের টাওয়ারগুলোতে রয়েছে ঘুরানো ত্রিমাত্রিক বাঁকানো কার্নিশ-বৈশিষ্ট্য, যা বাংলার স্বকীয় স্থাপত্যরীতির পরিচয় বহন করে। চৈত্র মাসের চাঁদের শুক্লপক্ষে বিশাল ঠাকুরদিঘির তীরে খান জাহান মাজার প্রাঙ্গণে বার্ষিক ওরস ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্ব ঐতিহ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ তার আসল চেহারায় এখন আর নেই।
বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট’ নামটিও প্রকৃত ঐতিহাসিক ঘটনা ফুটিয়ে তোলে না। বরং বিশ্ব ঐতিহ্যের নাম সোমপুর মহাবিহারের মতো খান জাহান, খলিফতাবাদ বা ষাটগম্বুজ মসজিদ হলে ইতিহাসের প্রতি সত্যিকার সম্মান দেখানো হবে। ইতিহাসের দায়ও রক্ষিত হবে।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান
অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়