অর্থনৈতিক নির্বুদ্ধিতার রাজনীতি

গড়পড়তা মার্কিন নাগরিকদের আয় কমে গেছে। ছবি: আরইউটুডে
গড়পড়তা মার্কিন নাগরিকদের আয় কমে গেছে। ছবি: আরইউটুডে

বিশ্ব অর্থনীতি এখনো সে পথেই আছে। ২০০৮ সালে বৈশ্বিক আর্থিক

জোসেফ ই স্টিগলিৎ​স
জোসেফ ই স্টিগলিৎ​স

মন্দার পর অর্থনীতির যে চিড়ে-চ্যাপ্টা পথ তৈরি হয়, মন্দা কাটিয়ে ওঠার পথে অর্থনীতি সেই যে এ পথ ধরল, এখনো তা ছাড়েনি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ সত্ত্বেও এ দুই দেশের অর্থনীতিতে এক গভীর ও দীর্ঘ নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সংকট না হলে তাঁরা যেখানে থাকত আর এখন যেখানে আছে, এ দুইয়ের মধ্যে যোজন-যোজন ব্যবধান। ইউরোপে তা সময়ের পরিক্রমায় বেড়েই চলেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বরং ভালো করেছে। কিন্তু সেখানকার খবরও খুব একটা ভালো নয়। এসবের মধ্যে সবচেয়ে সফল অর্থনীতি আর্থিক সংকটের মুখেও বড় হয়েছে। তাদের ভিত্তি হচ্ছে রপ্তানি। যদিও এই রপ্তানির বাজারও নানাভাবে হোঁচট খেয়েছে। আবার ২০১৪ সালে এসে তাদের কর্মকাণ্ডও মারাত্মকভাবে খারাপ হয়ে যায়।
১৯৯২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিল ক্লিনটন তাঁর সফল প্রচারণা শুরু করেন এক সাধারণ স্লোগানের ওপর, ‘বোকা, এটা অর্থনীতি’। আজকের প্রেক্ষাপটেও এ স্লোগানটাকে খুব খারাপ বলে মনে হয় না। গড়পড়তা মার্কিন নাগরিকদের আয় কমে গেছে। কিন্তু ক্লিনটনের তত্পরতা থেকে আমরা অনুপ্রেরণা নিতে পারি। যে রোগ আজকের বিশ্ব অর্থনীতিকে আক্রান্ত করেছে, দুটি স্লোগানের মধ্য দিয়ে তা প্রতিফলিত হয়, ‘বোকা, এটা রাজনীতি’ আর ‘চাহিদা, চাহিদা, চাহিদা’। এই ২০১৪ সালে যে প্রায় বিশ্ব পর্যায়ের স্থবিরতা আমরা দেখলাম, তা নিছক মনুষ্যসৃষ্ট। এটা আসলে কয়েকটি বড় অর্থনীতির রাজনীতি ও নীতির ফলাফল, যে রাজনীতি ও নীতি আসলে চাহিদার গলা চেপে ধরেছে। চাহিদা না থাকলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। ব্যাপারটা এরকমই সরল।
এ ব্যাপারটি ইউরোজোনেই সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার। তারা আনুষ্ঠানিকভাবেই এক কট্টরপন্থা অবলম্বন করেছে। তারা সরকারি ব্যয় কমিয়ে দেওয়ায় মানুষের ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাস পেয়েছে। ইউরোজোনের কাঠামো এর জন্য আংশিকভাবে দায়ী। এর ফলে সংকট থেকে সৃষ্ট অভিঘাত কাটিয়ে ওঠার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। ব্যাংকিং ইউনিয়ন না থাকায় এটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে টাকা সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত দেশগুলোয় যেতে পারেনি। তাতে এসব দেশের অর্থব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে, তাদের ঋণ ও বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হয়।
ওদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে যে তিনটি ‘তীর’-এর কথা বলেছেন, তার একটি ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভোক্তা কর বাড়ানোর পর মোট দেশজ উৎপাদনের যে পতন ঘটেছে, তা আসলে কেইনসীয় অর্থনীতির সত্যতাই প্রমাণ করে। ব্যাপারটা এমন যে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে তা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র খুব স্বল্প পরিমাণে কট্টর পন্থা অবলম্বন করে সবচেয়ে ভালো ফল লাভ করে। কিন্তু তার পরও যুক্তরাষ্ট্রে সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা সংকটের আগের তুলনায় সাড়ে ছয় লাখ কমে গেছে। যদিও স্বাভাবিকভাবে আমরা আরও ২০ লাখ বেশি আশা করতাম। ফলে যুক্তরাষ্ট্রও ভুগছে। তাদের প্রবৃদ্ধি এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে মজুরি প্রায় একই জায়গায় রয়ে গেছে।
উদীয়মান ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির গতিহ্রাস চীনের মন্থর গতির প্রতিফলন হিসেবে দেখা যেতে পারে। চীন এখন (ক্রয়ক্ষমতার সমতায়) বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি। বিশ্বের প্রবৃদ্ধিতেও তারা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। চীনের এই অসামান্য অগ্রগতিই তার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এটা দ্রুততার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে।
চীনা অর্থনীতি যে পরিমাণ থেকে গুণের দিকে মোড় নিয়েছে, তা অবশ্যই স্বাগত জানানোর মতো। এটা প্রায় প্রয়োজনীয়ই হয়ে উঠেছে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছেন, তাতে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হলেও আর পিছু ফেরার কোনো উপায় নেই। অন্যদিকে আরও কিছু বিষয় তাঁর সরকারের আস্থা বিনষ্ট করছে। সেগুলো হচ্ছে ব্যাপক পরিসরে পরিবেশগত সমস্যা, অসমতার উচ্চ হার, বেসরকারি খাতের দুর্নীতি—এসব বিষয়ও একইভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
সংক্ষেপে, অবশিষ্ট দুনিয়ার এটা আশা করা ঠিক হবে না যে চীন ২০১৫ সালেও বিশ্ব চাহিদার পতন ঠেকিয়ে দেবে। কিছু হলে দেখা যাবে, আরও বড় শূন্যতা পূরণ করতে হচ্ছে।
রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থাকায় দেখা যাবে, তাদের প্রবৃদ্ধিও কমে যাবে। ইউরোপ তো এমনিতেই দুর্বল, এর ফলে সে আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। (নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে এটা কোনো যুক্তি নয়। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে হবে। আর পশ্চিমা প্রধান নির্বাহীরা যাঁরা তাঁদের বিনিয়োগ নিরাপদ রাখতে চাচ্ছেন, তারা নীতিহীনতার এক গর্হিত নজির স্থাপন করেছেন)
ছয় বছর ধরে পশ্চিম মনে করছে, মুদ্রানীতি তাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে। সংকটের কারণে বিপুল অঙ্কের বাজেট ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ঋণও বেড়েছে বিপুল হারে। নিয়ম শিথিলের প্রয়োজনীয়তাও সৃষ্টি হয়েছে। এ চিন্তা আরেকটু এগিয়ে নিলে দেখা যাবে, রাজস্ব নীতি ফেলে দেওয়ারই প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে।
সমস্যা হচ্ছে, পণ্যের কোনো চাহিদা না থাকলে সুদের নিম্ন হারের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে উৎসাহী হবে না। সুদের নিম্ন হারের কারণে মানুষ ব্যক্তি পর্যায়ে ধার করেও ক্রয়ে উৎসাহী হবে না, যদি তাঁরা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয় (যেটা তাঁদের হওয়া উচিত)। মুদ্রানীতি সম্পদের মূল্যের বুদবুদ তৈরি করতে পারে। ইউরোপের সরকারি বন্ডের দামও এর ফলে বেড়ে যাতে পারে। এতে সার্বভৌম ঋণের সংকটে আগে-ভাগেই লাগাম দেওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু একটা ব্যাপারে পরিষ্কার হওয়া জরুরি, ছাড়া ছাড়া মুদ্রানীতি দুনিয়ার সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করবে, এমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এটা আবারও আমাদের রাজনীতি ও কর্মপন্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে। পৃথিবী সবচেয়ে বেশি করে যা চায়, সেটাই চাহিদা। আর্থিক কর্তৃপক্ষের সবচেয়ে উদার সহায়তা ও সমর্থন সত্ত্বেও বেসরকারি খাত তা সরবরাহ করবে না। তা করতে পারে রাজস্ব নীতি। সরকারি বিনিয়োগের প্রচুর সুযোগ আছে, যেখান থেকে উচ্চ মুনাফা করা সম্ভব, পুঁজির প্রকৃত খরচের চেয়েও তা বেশি। সেটা করা হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর লাভ-ক্ষতির খাতা আরও উন্নত হবে।
২০১৫ সালের সবচেয়ে বড় সমস্যা আসলে আর্থিক নয়। আমরা জানি, কীভাবে আমাদের বর্তমান রোগ থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। আমাদের মূল সমস্যা নির্বোধ রাজনীতি।
জোসেফ ই স্টিগলিৎস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।