শান্তির জন্য ঐক্য

ইবোলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। ছবি: জেফ্রি অ্যালেন
ইবোলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র কাজ করছে। ছবি: জেফ্রি অ্যালেন

আমি বেড়ে উঠেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়ায়। সময়টা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের

জন এফ কেরি
জন এফ কেরি

সূচনাকাল।
আমার বাবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরি করতেন। সেই সূত্রে আমি খুব কাছ থেকে তীব্র আবেগময় ইতিহাস দেখার সুযোগ পেয়েছি। বাবার সঙ্গে নরম্যান্ডি সৈকতে হেঁটে বেড়ানোর স্মৃতি কখনোই ভুলে যাওয়ার নয়। সেই সৈকতটিতে আমি হিগিনসের পরিত্যক্ত জাহাজের পোড়া অবশেষ দেখেছি। তার কিছুদিন আগেই বহু তরুণ পৃথিবীর মুক্তির লক্ষ্যে আত্মত্যাগ করেছিল। পশ্চিম বার্লিনের বান্ডেনবার্গ গেট থেকে বাইক চালিয়ে পূর্ব বার্লিনে যাওয়ার সেই আতঙ্কময় স্মৃতিও কখনো ভুলবার নয়। সেই যাত্রাপথে আমি স্বাধীন ও লৌহযবনিকার ভেতরে রুদ্ধ মানুষের মধ্যকার পার্থক্য দেখেছি।
এত বছর পর আমার মনে হয়, একটি প্রজন্মের নেতারা শুধু যুদ্ধই জয় করেননি, শান্তিও জয় করে এনেছিলেন। তাঁর এক জোট হয়েই তা করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা যে জোট গঠন করে, তা পশ্চিম ইউরোপ, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা বয়ে আনে। পুরোনো শত্রুরা নতুন মিত্রে পরিণত হয়। তারা একত্রে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। এর ফলে দুনিয়া আরও সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠে। স্নায়ুযুদ্ধ দানা বেধে উঠলেও নেতারা পরমাণু অস্ত্রের দামামা বন্ধ করতে সক্ষম হন। ফলে ধ্বংসের হাত থেকে পৃথিবী রক্ষা পায়।
সংক্ষেপে কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আমরা শুধু আরেকটি বিপর্যয়কর বিশ্বযুদ্ধই এড়াইনি, শেষমেশ আমরা স্নায়ুযুদ্ধ শেষ করে লাখো লাখো মানুষের জীবনমান উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছি।
এই হচ্ছে বিশ শতকের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। প্রশ্ন হচ্ছে, একবিংশ শতকে আমরা কী পাব?
আজ বিশ্বব্যবস্থা বিচিত্র চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। রাশিয়ার আগ্রাসন মিত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। চরমপন্থীরা ধর্ম ছিনতাই করে দুনিয়ার সব জায়গাতেই সরকার ও মানুষকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রযুক্তি আবার আরেক ঘটনা ঘটিয়েছে। সরকার আর জনগণের সম্পর্কের মধ্যে যে ভারসাম্য রয়েছে, প্রযুক্তির কল্যাণে তাতেও আমরা বাঁকবদল দেখতে পাচ্ছি। এতে যেমন গণতান্ত্রিক জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তেমনি তা আবার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির পথে অন্তরায়ও সৃষ্টি করছে।
আগের দুনিয়ায় ক্ষমতার আঁঁকর ছিল কর্তৃত্বের ক্রমাধিকারে, এখন তা স্থানান্তরিত হয়েছে নেটওয়ার্কে। রাষ্ট্রযন্ত্র এখনো খাপ খেয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও অংশীদারি গড়ে উঠেছে, তদারকের পাশাপাশি তার আধুনিকায়নও করতে হবে। এটাই যুগের দাবি।
এসব ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যে অনেকেই পরামর্শ দিচ্ছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের গভীরে তাকাতে হবে। এটা নতুন কোনো ব্যাপার নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অনেকেই এ কথা বলেছিলেন। ২৫ বছর আগে বার্লিন দেয়ালের পতনের পরও অনেকে তা বলেছেন। তখন তাঁরা ভুল ছিলেন, এখনো তাঁরা ভুল।
নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। বাদবাকি দুনিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততাও এখন অনেক বেশি। আফগানিস্তানের প্রথম শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়ায় আমাদের ভূমিকা আমাদের সবাইকে এ বিষয়টি মনে করিয়ে দেয় যে, আফগানদের যুদ্ধ জয়ে এত রক্ত ও সম্পদ দিয়ে সহায়তা করার পর বিশ্বের দায়িত্ব হচ্ছে, এখন তাদের নেতাদের শাসনপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করা।
আমরা জানি, প্রত্যক্ষ ও ব্যবহারিক কূটনীতি এবং ধৈর্য না থাকলে সিরিয়ার ঘোষিত রাসায়নিক অস্ত্র শতভাগ ধ্বংস হতো না। সিরিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধ শেষ করতেও ঠিক সে রকম প্রতিশ্রুতি লাগবে। একইভাবে, এশিয়ায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে বোঝা যাচ্ছে, প্রকৃত নেতৃত্ব থাকলে দেশগুলো একত্রে কী অর্জন করতে পারে; আর ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে একটি সার্থক চুক্তি সম্পন্ন করতে হলে নেতৃত্বের পর্যায়ে অতিরিক্ত কী কী লাগবে।
দুনিয়া বদলে যাচ্ছে, তার সঙ্গে আমরা নিজেরাও। মানচিত্রে যে রেখা আছে, সেটা আর কোনো বাধা নয়। এমনকি মানুষও কেবল শত্রু আর মিত্র—এই দুই দলে বিভক্ত নয়।
একবিংশ শতকে সব জায়গাতেই একটি পাশের দরজা আছে। সে কারণে দুনিয়ার ঐক্যের কূটনীতি প্রয়োজন। কোনো দেশই একা সন্ত্রাসবাদ পরাজিত করতে পারবে না, জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলা করতে পারবে না, চরম দারিদ্র্য দূর করতে পারবে না কিংবা মহাদেশীয় ব্যাধি প্রতিরোধ ও পারমাণবিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে না।
আমরা কেউই নিরাপদে বসবাস করতে পারব না। ধনীরা দুনিয়ার প্রতি তাদের পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে টিকে আছে। সরকার, নাগরিক সমাজ এবং অবশ্যই জনগণের সঙ্গে নতুন ঐক্য গড়ে তুলে আমাদের ঐক্য গঠনের ইতিহাস ঝালিয়ে নিতে হবে।
এ ঐক্যের একটি উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র হচ্ছে ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের নৃশংসতার বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধ। ৬০টিরও বেশি দেশের সামরিক, রাজনৈতিক, গোয়েন্দা ও মানবিক সহায়তার ভিত্তিতে এই সম্মিলিত সমর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। সফলতা একটি বা কয়েকটি দেশের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে না। আমরা সবাই একত্র হয়ে অভিন্ন হুমকির বিরুদ্ধে লড়লে তবেই সফলতা আসবে।
ইবোলা মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের সঙ্গে মিলে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া গঠনের চেষ্টা করছে। আমি নিজে ৫০টিরও বেশি বিশ্বনেতার সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, আমরা একসঙ্গে কাজ করে পশ্চিম আফ্রিকায় ইবোলার ভয়াবহতা হ্রাস এবং এর বিস্তার রোধ করতে পারি।
এই দুটি বিষয়েই আমাদের অগ্রগতি হয়েছে, কিন্তু বহু কাজ এখনো বাকি। নানা মাত্রার সম্পদ নিয়ে স্বার্থের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দেশকে এক করা সত্যিই খুব কঠিন কাজ। এর জন্য প্রগাঢ় কূটনৈতিক তত্পরতা প্রয়োজন। অতীতের সম্পর্কের জের ধরে অনেক কিছু করতে হবে, আবার নতুন বহু সহযোগীর সঙ্গেও ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু ইসলামিক স্টেট ও ইবোলা পরাজিত করতে গিয়ে আমরা অভিন্ন সমস্যার যৌথ সমাধানের ভিত্তিতে এক বিশ্বব্যবস্থার ধারণা আরও শক্তিশালী করেছি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ যে অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তিতে উঠে দাঁড়িয়েছে, সেই নীতির পুনঃপ্রয়োগেও ঐক্য দরকার। কোনো দেশে সুযোগের চেয়ে হতাশা বাড়বাড়ন্ত হতে পারে না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দুনিয়ার এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্য ও জিডিপির ৪০ শতাংশের মালিক দেশটির সঙ্গে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ বিষয়ে আপস করলেন।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা এতে দারুণ লাভবান হবে। হিসাব দাঁড়াচ্ছে, টিটিপি প্রতি বছর ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রকৃত আয় উত্পাদন করতে পারবে। আর যুক্তরাষ্ট্রও প্রতিবছর সাড়ে ৬ লাখ নতুন চাকরি সৃষ্টি করতে পারবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যে ট্রান্স-আটলান্টিক ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট পার্টনারশিপের আপস হয়েছে, তা বাণিজ্য বাড়ানোর পথে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হবে।
প্রকৃত অংশীদারি রাতারাতি সৃষ্টি হয় না, তা সে পারস্পরিক নিরাপত্তা বা সমৃদ্ধি যে কারণেই হোক না কেন। ধীরস্থির কূটনীতি ও সম্মিলিত ইচ্ছা, অভিন্ন লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে হলে এ দুটোরই প্রয়োজন আছে। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য বহুদিন ধরেই এক—শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী, সবার জন্যই।
জন এফ কেরি: যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।