ফ্রান্সে যেভাবে সংস্কার হবে

অধিকতর শক্তিশালী ফ্রান্স তার সামনের যেকোনো বাধা মোকাবিলা করবে। ছবি: এএফপি
অধিকতর শক্তিশালী ফ্রান্স তার সামনের যেকোনো বাধা মোকাবিলা করবে। ছবি: এএফপি
মানুয়েল ভাল
মানুয়েল ভাল

বিশ্ব দ্রুত বদলাচ্ছে আর তা কারও জন্য বসে থাকবে না। সাফল্যের একমাত্র পথ হচ্ছে এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলানো। এ কারণেই সংস্কারের পথ বেছে নিয়েছে ফ্রান্স।
অবশ্যই সংস্কার মানে পরিবর্তন। কিন্তু সংস্কারের মানে এই নয়, পরিবর্তনগুলো চাপিয়ে দিতে হবে বা ফ্রান্সের মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো বর্জন করতে হবে। বরং আজ ও ভবিষ্যতের নাগরিকদের জন্যই ইতিহাস, গৌরব, ঐতিহ্য, জীবনযাত্রার ধরন এবং একটি পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিবেশে আমাদের মূল্যবোধগুলো দৃঢ়ভাবে সংহত করা জরুরি। এটা আরও শক্তিধর ও আরও সমৃদ্ধ ফ্রান্স গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
স্পষ্টত, চলমান সংস্কার-প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ বিষয়ই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সুখবর হলো, অনেক বিষয় ফ্রান্সের জন্য ইতিবাচক অবস্থায় রয়েছে। যেমন: দেশটির বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি, শক্তিশালী এবং উদ্যমী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাত, একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং সুবিশাল মানবসম্পদ। আসলে এসব উপাদান বা বিষয়ই বলে দেয়, ফ্রান্স কীভাবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছে।
কিন্তু বিশ্বায়নের কারণে পৃথিবীর অর্থনীতির পরিবর্তনের পাশাপাশি ফ্রান্সকে নিজ দেশে এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়ার উপযোগী হয়ে উঠতে হবে। মুক্ত অর্থনীতিতে একটি শক্তিশালী ব্যবসায়িক খাত অবশ্যই থাকা চাই, কারণ এটি দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান ধরে রাখা এবং উন্নত করার সামর্থ্য গড়ে দেয়।
এ কারণেই ফ্রান্সকে আরও সম্পদশালী হয়ে ওঠার সামর্থ্য অর্জনের জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিতে হবে। ফ্রান্সের ব্যবসায়িক খাতকে হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়ার জন্য সহায়তা হিসেবে আমরা তাদের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান তৈরির ক্ষমতা দিতে পারি। এটা হচ্ছে অবিকল সেই ‘দায়িত্বশীলতা চুক্তি’, যা নতুন বছরে কার্যকর হবে এবং প্রতিযোগিতা ও কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থানে উৎসাহিতকরণের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর-সুবিধা দেওয়া হবে।
দেশের বাইরে ফরাসি ব্যবসা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমাদের অবশ্যই অভ্যন্তরীণ বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে হবে। একটি দেশের বাণিজ্যিক আকর্ষণের জন্য দুটোই গুরুত্বপূর্ণ। বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো বিবেচনায় নিয়েই এ কথা বলা যায়।
অধিকতর শক্তিশালী ফ্রান্স তার সামনের যেকোনো বাধা মোকাবিলা করবে। একই সময়ে সৃজনশীলতা ও সম্পদ তৈরিতে দেশটি নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করবে। ‘প্রবৃদ্ধি ও সক্রিয়তা আইন’ নিয়ে আগামী বছর ভোটাভুটি হবে। এর মাধ্যমে ব্যবসা খাত নিয়ন্ত্রণমুক্ত হবে এবং প্রতিযোগিতা চাঙা হবে। তা ছাড়া নিয়ন্ত্রিত পেশাগুলোকে উন্মুক্ত করে দেওয়ার মাধ্যমে বৈষম্য দূর করা সহজ হবে, যা নিয়ে ফরাসি জনগণের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।
আমার সরকার যেসব বিষয়ে প্রাধান্য দিচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মুক্ত অর্থনীতিতে আরও সম্পদ তৈরি করা। কিন্তু কেবল অধিকতর সম্পদ অর্জিত হলেই ফ্রান্সের রুগ্ণদশা সারবে না। সবচেয়ে সফল দেশ হচ্ছে সেটিই, যেখানে চাকরিদাতা ও চাকরিজীবীরা অভিন্ন পরিণতির বন্ধনে আবদ্ধ থাকে। এভাবে সামাজিক সংলাপের উন্নয়ন এবং আস্থা তৈরি করাই ফ্রান্সে এখন জরুরি।
ব্যবসায়িক খাতে সমঝোতা ও আলোচনার জন্য আমাদের ‘সহজীকরণ পরিকল্পনাগুলোর’ মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে আস্থা অর্জনের লক্ষ্যটি। এটি কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সংস্কারে দিকনির্দেশনা দিতে সহায়তা করছে। এতে দক্ষতা বাড়াতে আগ্রহী কর্মীদের পাশাপাশি যারা প্রশিক্ষণের অভাবে উপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না, তারাও সুফল পাবে। এসব উদ্যোগ একটি বৃহত্তর পরিবর্তনেরই অংশ। বৈচিত্র্যময় কৌশলের মাধ্যমে আমরা নাগরিকদের জীবনকে আরও সহজ করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনা এবং অতিরিক্ত কাজ থেকে কর্তৃপক্ষকে বিরত রাখার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেগুলো তাদের মূল কৌশলগত কাজে বাধা তৈরি করে। ফরাসি নাগরিকেরা শিগগিরই নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে এসব পরিবর্তনের প্রভাব অনুভব করতে শুরু করবে।
এসব উদ্যোগের অসাধারণ সম্ভাবনা থাকলেও ইতিবাচকভাবে অনুভব না করলে এগুলো নিষ্ফল হবে। সবকিছুর পরে ফ্রান্সকে দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী সমমাত্রিক প্রেরণার দেশ হিসেবে গণ্য করা হয়।
শিক্ষার কথাই বিবেচনা করুন। আমাদের ‘অগ্রাধিকার শিক্ষা’ কর্মসূচি আধুনিকায়নের লক্ষ্যে শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে পারি। এতে স্কুলপর্যায়ে বৈষম্য দূর হবে। আর সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে বাড়তি সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এই কর্মসূচির আওতায় সব বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণে কম্পিউটার দিতে হবে, যেন ছাত্রছাত্রীরা আজকের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সুবিধাগুলো কাজে লাগাতে পারে। শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কোনো ডিজিটাল বিভক্তি থাকবে না। আসল কথা হচ্ছে, এসব পরিবর্তনের প্রভাব কয়েক বছরে চোখে পড়বে না। তাই বলে এই কর্মসূচির গুরুত্বকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
একটি শক্তিশালী ও ন্যায়সংগত অর্থনীতি নির্মাণের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটির লক্ষ্য কেবল আজকের নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন হলেই চলবে না; বরং ভবিষ্যতের জন্যও ফ্রান্সকে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। আর একটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে সফল উদ্যোগগুলোর ফলাফলও চোখে পড়তে সময় লাগে।
যে সমাজে তাৎক্ষণিক উদ্যোগকে অতিমূল্যায়ন করা হয়, সেখানে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করা কঠিন হতে পারে। তবে আমার সরকার অগ্রসর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন থেকে বিরত হবে না। ফলে নিশ্চিত হবে ভবিষ্যতের ফ্রান্স, যেমনটা ফরাসি নাগরিকেরা প্রত্যাশা করে এবং পাওয়ার অধিকার রাখে।
সংস্কারের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা সরকারের ওপর নির্ভর করছে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও বেশি সত্যি। কারণ, দেশটির নাগরিকেরা রাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি প্রত্যাশা করে। তবে সরকারই যে সবকিছু করে দেবে, তা নয়। তারা নির্দিষ্ট কিছু কৌশল নির্ধারণ করে স্থানীয় কর্মীদের সফল হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেবে। এক কথায়, জনগণের সেবার জন্য সরকারকে অবশ্যই কৌশল-নির্ধারণী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে।
ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি নিতে গেলে ব্যতিক্রমী একটি প্রকল্পের মুখোমুখি হতে হয়: শক্তির রূপান্তর। আমরা সবাই জানি যে আমরা প্রবৃদ্ধির একটি নতুন মডেল অনুসরণ করতে যাচ্ছি, যা অধিকতর সংযত ও টেকসই। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর কম নির্ভরশীল এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের ওপর তুলনামূলক বেশি নির্ভরশীল। প্রবৃদ্ধি অর্জনের এই নতুন পথ অবলম্বনের মাধ্যমে নতুন কিছু অভ্যাস, নতুন আচরণ ও জীবনযাত্রার নতুন ধরন গড়ে উঠবে। শক্তি রূপান্তর আইনের মাধ্যমে আমার সরকার ভবিষ্যতে ‘সবুজ’ প্রবৃদ্ধির জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি করে এসব লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে থাকতে চায়।
ফরাসি সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের লক্ষ্যগুলো স্পষ্ট: অধিকতর শক্তিশালী ফ্রান্স গড়ে তোলা, যা দ্রুত পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উন্নতি অর্জন করবে; আরও সুন্দর ফ্রান্স, যাকে বাদ দিয়ে একক বা সামষ্টিক—কোনো কিছুকে সাফল্য বলে বিবেচিত হবে না এবং আরও অবিচল ফ্রান্স, যা আমাদের শিশুদের জন্য একটি স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধিশীল দেশ হিসেবে টিকে থাকবে। ফ্রান্স ও তার জনগণের স্বার্থে আমরা এসব সংস্কার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
মানুয়েল ভাল: ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী