আধডজন মাস্কেটিয়ার্সের গল্প!

ভালো কাজ দিয়ে দেশটাকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে মাহাবুব, আজমাইন, মুজতাবা, দিহান, সুমাইয়া আর নাবিলা
ভালো কাজ দিয়ে দেশটাকে পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে মাহাবুব, আজমাইন, মুজতাবা, দিহান, সুমাইয়া আর নাবিলা

সেই দুঃসাহসী তিন ফরাসি বীরের কথা মনে আছে? দ্য আরতাঁনা ও তার তিন তিরন্দাজ বন্ধু—অ্যাথোস, পার্থোস ও আরামিস, যারা ঘুরে বেড়াত ফ্রান্সজুড়ে আর সামাজিক নানা সমস্যা দূর করতে মেতে থাকত ভিন্ন ধরনের দুঃসাহসিক অভিযান নিয়ে। সেই মাস্কেটিয়ার্সদের বাংলাদেশি সংস্করণই বলা চলে নাবিলা, আজমাইন, মুজতাবা, দিহান, সুমাইয়া আর মাহাবুবকে। কী না করে ওরা! বয়স সবে চৌদ্দ-পনেরো তাদের। আর এরই মধ্যে মাস্কেটিয়ার্সদের মতন কাজ করে ওরা। ওদের দৌড়াদৌড়ি দেখে স্কুলের শিক্ষকেরাই ওদের মাস্কেটিয়ার্স নাম দিয়েছেন। নিজের চারপাশকে বুদ্ধির জোরে, কর্ম দিয়ে বদলে দেওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে ওরা।

ওরা সবাই ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবক। এই ফাউন্ডেশন কখনো সারা দেশের শিক্ষার্থীদের সমাজসেবামূলক কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়। আবার কখনো তরুণদের সমাজসেবামূলক কাজের চর্চা সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। এই ফাউন্ডেশনের সবাই ভবিষ্যতের নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায়। এখানকার আধডজন তরুণ তুর্কির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, নিজেরা যেভাবে সমাজের নানা সমস্যা নিয়ে ভাবে, সেই ভাবনা অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায় ওরা। নিজেদের স্কুলে ওয়ান ডিগ্রির মাধ্যমে সামাজিক ক্লাব তৈরি করেছে সম্প্রতি। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের এবং আশপাশের সমস্যা ও এর সমাধান খুঁজে বের করে কাজে লেগে পড়েছে। তারা ফ্লাটে ফ্লাটে গিয়ে কর্মজীবী শিশুদের পড়াশোনা শেখায়, তাদের সঙ্গে খেলা করে, ঢাকার বাইরের স্কুলগুলোতে গিয়েতাদের সঙ্গে নানা ধরনের অনুষ্ঠান করে।

রোজার ঈদের পর ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্রসরোবরে পথশিশুদের নিয়ে ভিন্ন এক আয়োজনে মেতেছিল ওরা
রোজার ঈদের পর ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্রসরোবরে পথশিশুদের নিয়ে ভিন্ন এক আয়োজনে মেতেছিল ওরা

আর কয়েক দিনের মধ্যে ওদের ওপর ও-লেভেল পরীক্ষার ভীষণ ব্যস্ততা জেঁকে ধরবে। ওই সময় কি কাজ বন্ধ থাকবে? তাই তো, স্কুলের জুনিয়রদের নিয়ে নতুন সামাজিক ক্লাবের গঠনের চেষ্টা করছে সবাই।

কাজ করতে গিয়ে মজার কোনো ঘটনা সম্পর্কে জানায়, গত রোজার ঈদের পরে ধানমন্ডি লেকের রবীন্দ্রসরোবরে পথশিশুদের নিয়ে ভিন্ন এক আয়োজনে মেতেছিল ওরা। ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে এই আয়োজনে ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল গোটা পঞ্চাশেক পথশিশু। তাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে খোশগল্প করছিল, তাদের গালে এঁকে দিয়েছে আলপনা, আবার ফুটবলও খেলেছে সবাই মিলে সেদিন। এমন নানা ধরনের কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে তারা বছরজুড়েই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ছুটি’ গল্পে ফটিক সর্ম্পকে লিখেছিলেন, ‘তেরো-চৌদ্দ বৎসরের ছেলের মতো পৃথিবীতে এমন বালাই আর নাই।...তাহার মুখে আধো-আধো কথাও ন্যাকামি, পাকা কথাও জ্যাঠামি এবং কথামাত্রই প্রগল্ভতা।’ বিশ্বকবির সেই ফটিকের মতোই উচ্ছ্বল এই আধডজন কিশোর। সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ায় সবাই, মুভি দেখতে চলে যায় সিনেমা হলে। কিন্তু পড়ার বেলায় ফটিকের উল্টোটা সবাই। পড়ালেখার দৌড়ে সবাই ক্লাসের সামনের সারির শিক্ষার্থী। সবাই পড়ে নবম শ্রেণীতে। আগে সবাই একই স্কুলে পড়ত, কিন্তু এখন স্কুল বদলে আজমাইন ইকতিদার আর মাহাবুবুল হক পড়ে ক্যামব্রিজ মিলেনিয়াম ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকাতে। নাবিলা ইসলাম, দিহান নাঈমা আর মুজতাবা জাহিদ পড়ে অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে, সুমাইয়া বিনতে ইসমাইল পড়ে কাকলি উচ্চবিদ্যালয়ে।

কাজে ব্যস্ত তারা
কাজে ব্যস্ত তারা

শুধুই কি পড়াশোনা আর সামাজিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত সবাই? আজমাইন বলে, ‘পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে গেলে আমরা মুভি দেখতে যাই। দলবেঁধে মুভি দেখতে গেলে খুব মজা হয় আমাদের।’ ওর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে দিহান বলে, ‘আমরা মুভি দেখতে গেলে সিনেমা হলে অন্যরা আমাদের দেখে। আমরা মুভি দেখি আর গল্প করি। আশপাশের সবাই বিরক্ত হলেও কিছু বলে না!’ বড় হয়ে জ্যোতিঃপদার্থবিদ হতে চায় আজমাইন। দিহান আর মাহাবুব মোটামুটি ক্যারিয়ার হিসেবে চিকিৎসাবিজ্ঞান বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও নাবিলা একটু দ্বিধান্বিত। সে বলে, ‘মা-বাবার ইচ্ছে অনুসরণ করতে গেলে আমাকে ডাক্তার-প্রকৌশলী—দুটোই হতে হবে। কিন্তু আমি রাজনীতিবিদ হতে চাই।’ আর মুজতাবার আগ্রহী বেশি তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে। তবে পড়ালেখা শেষ করে বিমান প্রকৌশলী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চায়।

বাচ্চাদের সঙ্গে হেসে-খেলে কেটে যায় তাদের অনেক বিকেল
বাচ্চাদের সঙ্গে হেসে-খেলে কেটে যায় তাদের অনেক বিকেল

নাবিলা আর দিহানের বাকি বন্ধুদের ওপর অনেক অভিমান। নাবিলাকে ‘নাবলু’ আর দিহানকে ‘নাঈ’ বলে বাকিরা সব সময় খেপায়। মাঝেমধ্যে তো হাতাহাতি পর্যন্ত হয়ে যায়। কিন্তু বিকেলে আবার সবাই রাগ-অভিমান ভুলে একসঙ্গে আড্ডা দেয়। নাবিলা বলে, ‘বিভিন্ন প্রকল্পে আমরা কতশত কাজ করি। কিন্তু আমার বাকি বন্ধুরা কোনো কাজেই আসে না। ওরা ছেলে হয়ে যা করে, আমাদেরও তা-ই করতে হয়।’ এ কথা শুনে দিহানের ওপর-নিচে মাথা ঝাঁকানোই বলে দেয় বন্ধুরা ‘ওদের খাটিয়ে মারে’। দিহান হাসি দিয়ে আক্ষেপের সুরে বলে, ‘আমাদের বন্ধুরা পাত্তা না দিলেও আমরা কাজ করি। কাজ করতে করতে কত কিছু শিখি আমরা। বন্ধুদের কাছে আমাদের মূল্য নেই, কিন্তু আমরা আসলে অনেক দামি। দেশই আমাদের একসময় দাম দেবে।’ এই কিশোরের দলের সবাই বাংলাদেশকে নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী। ওদের ভাষ্যে, ‘আমরাই তো আগামীর বাংলাদেশ। আমাদেরই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। অন্যকে দোষ দিয়ে কী লাভ? আমরা কী করছি, সেই প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?’

পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ও ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসবেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করে ওরা। আজমাইন পদার্থবিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত নির্বাচিত হয়েছিল। আর বাকিরা ‘অংশগ্রহণই বড় কথা’ বলে গল্পের গতি অন্য দিকে নিয়ে যায়। আয়রনম্যান থ্রি মুভির গল্প দিয়েই শেষ করতে হয় ওদের সঙ্গে আড্ডা। গত জুনে পরীক্ষা শেষে সবাই ছুটে গিয়েছিল রবার্ট ডাউনি জুনিয়র অভিনীত আয়রনম্যান থ্রি চলচ্চিত্র দেখতে। থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের হাতে ছিল তির, আর আয়রনম্যানের কাছে ছিল অসীম শক্তি—চলচ্চিত্রের এসব হিরো তাদের সমাজের কালো দাগ দূর করতে ব্যবহার করত সুপারপাওয়ার আর বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু এই বাংলাদেশি ‘ফটিক’দের তো সুপার পাওয়ার নেই। তাহলে ওরা কীভাবে সমাজ বদলাবে? দৃঢ় চিত্তে জবাব দেয় মুজতাবা, ‘বন্ধুত্ব আর মেধা-বুদ্ধি দিয়েই আমরা হয়ে উঠব ভবিষ্যতের মাস্কেটিয়ার্স। আর তোমরা যারা মানুষের জন্য কাজ করতে চাও, তারা যোগ দিতে পারো ওয়ান ডিগ্রি ইনিশিয়েটিভ ফাউন্ডেশনে। জীবনটা আনন্দের হয়ে উঠবে।’

u জাহিদ হোসাইন খান