আমি তখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি

ছবি: সাহাদাত পারভেজ
ছবি: সাহাদাত পারভেজ

মানুষের অতীত সুদূরের স্মৃতিমাত্র। ঢাকায় ওয়ারীতে অবস্থিত বাড়ির একটি কক্ষ ছিল আমার শৈশবের খেলাঘর। সেখানে পুতুলখেলা নয়, টিচার টিচার খেলা ছিল আমার প্রিয় খেলা। কখনো খেলার সাথিদের নিয়ে, কখনো বা একাকী কল্পনার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। আমার মা, প্রয়াত সোফিয়া মান্নান খান ছিলেন শিক্ষক। বোধ করি তাঁকে দেখে আমি শিক্ষক হওয়ার এক কল্পনার ভুবন একটু একটু করে গড়ে তুলেছিলাম।
অত্যন্ত সুশৃঙ্খল পারিবারিক পরিবেশে আমার বেড়ে ওঠা। নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী আমার বাবা প্রয়াত আবদুল মান্নান খান ও মা আমাদের লেখাপড়া সম্পর্কে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। আমি ছিলাম কনভেন্টের ছাত্রী। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাদার ফ্রান্সিসের কঠোর নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা লাভ করেছি। পড়ালেখায় মোটামুটি ভালোই ছিলাম। আম্মার ইচ্ছা আমরা ভালো ইংরেজি শিখব, কিন্তু মাতৃভাষা বাংলাকে ছাপিয়ে নয়। স্কুল পেরিয়ে ক্রমান্বয়ে কলেজ, তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলাম। সেখানকার শিক্ষকদের দেখে ও আব্বার ইচ্ছায় অনুপ্রাণিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার বাসনা ধীরে ধীরে ডানা মেলে চলছিল আমার ভেতরে। সেই আশা বুকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশংসনীয় ফল করেছিলাম। কিন্তু আমার স্বপ্ন পূরণ হলো না।
শুরু হলো নতুন স্বপ্ন, একটি স্কুল গড়ার। আমার বন্ধু জিনাত আফরোজা আমার এই মনোবাসনার কথা জানত। একদিন সে আমাকে ফোন করে আশার বাণী শোনাল। ওদের ধানমন্ডির বাড়ির একতলা খালি হয়েছে এবং সেখানে স্কুল করা যেতে পারে। বিষয়টি আব্বাকে জানালাম। তিনি আমাদের দুজনকেই উৎসাহ দিলেন এবং তাঁর পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন।
একটা স্কুল গড়ে তুলতে যতটা আর্থিক সচ্ছলতার প্রয়োজন, আমাদের তেমনটি একেবারেই ছিল না। আমাদের দুজনের অদম্য ইচ্ছাশক্তি যৎসামান্য পুঁজিকে সম্বল করে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। অবশেষে আমি, জিনাত আফরোজা ও আরও দুজন বন্ধুকে সঙ্গী করে ১১ জন ছাত্রী নিয়ে ১৯৮৪ সালের এপ্রিল মাসে (পয়লা বৈশাখ) জিনাত আফরোজাদের ধানমন্ডির ৭ নম্বর রোডের ১১ নম্বর বাড়িতে সানিডেইল স্কুলের যাত্রা শুরু হলো।
সানিডেইল প্রাথমিকভাবে বাংলা মিডিয়াম স্কুল হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং শিক্ষার্থীদের বেতন ধার্য করা হয়েছিল মাসিক ১৫০ টাকা। তৎকালীন ঢাকার নামকরা স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেতন ছিল মাত্র ৫০ টাকা। যে কারণেই হোক, আমাদের স্কুলটি দাঁড়াল না। ইতিমধ্যে জিনাত আফরোজার ও আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়ে গিয়েছিল। শঙ্কা দেখা দিল আমাদের মনে। অন্য সব বন্ধুও একে একে সরে দাঁড়াল। উপায়ান্তর না দেখে অনেকটা বাধ্য হয়েই আব্বার শরণাপন্ন হলাম। আমাদের সমস্যা সমাধানে তিনি এগিয়ে এলেন। এক লাখ টাকা বাজেট ধরে আব্বাকে সানিডেইল স্কুলের চেয়ারম্যান পদে রেখে জিনাত আফরোজা ও আমি নব উদ্যমে স্কুলটি পুনর্গঠন করলাম। আব্বা একাই দিলেন ৬৬ হাজার ৬৬৭ টাকা। জিনাতের আম্মা, আসমা রহমান জিনাতের ভাগের ৩৩ হাজার ৩৩৩ টাকার বিনিময়ে ছয় মাসের জন্য তাঁর বাড়িটি ব্যবহারের সুযোগ দিলেন।

আমি চাই, আমার স্কুলের শিক্ষার্থীরা শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই গ্রহণ করবে না, তারা সুশৃঙ্খল হবে। সদাচারী, হৃদয়বান ও সহনশীল একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশ ও দশের সেবায় এগিয়ে যাবে

১৯৮৫ সালের জানুয়ারি মাসে সানিডেইল একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হিসেবে পুনরুজ্জীবিত হলো। আমরা দুজনে উদয়াস্ত নিরলস পরিশ্রম করে গিয়েছি স্কুলটি সচল রাখার লক্ষ্যে। ধানমন্ডির প্রায় প্রতিটি বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি, ছাত্রছাত্রী জোগাড় করার চেষ্টা করেছি। শিক্ষার্থী মাত্র ১১ জন থেকে বেড়ে হলো ৪৩ জন। এর মধ্যে আবার ২৩ জন চলেও গেল। কিন্তু এবার আর হতাশা নয়, শুরু হলো বেঁচে থাকার লড়াই। আমাদের শ্রম ও নিষ্ঠা অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে সাহায্য করেছে।
প্লে গ্রুপ থেকে নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন ওয়ান, কিন্ডারগার্টেন টু—এভাবে সানিডেইলের শ্রেণি ও ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। আমাদের আর্থিক সংকট থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকদের বেতন, বাড়িভাড়া কখনো বকেয়া রাখিনি। এরপর থেকে সানিডেইলের চলার পথ আর বিঘ্নিত হয়নি, বরং ধীরে ধীরে উন্নতির পথে এগিয়ে গেছে। ১৯৯৭ সালে সানিডেইল স্কুলের প্রথম অর্ডিনারি লেভেল ব্যাচের মাত্র পাঁচজন শিক্ষার্থী এডুকেশন বোর্ড অব ইউকে গভর্নমেন্ট অনুমোদিত এডএক্সলের জিসিই পরীক্ষা দেয় এবং প্রশংসনীয় ফল করতে সক্ষম হয়। তারপর থেকে প্রতিবছরই সানিডেইল অর্ডিনারি লেভেলে কৃতিত্বপূর্ণ ফল অর্জনের প্রমাণ দিয়ে আসছে।
আমার বাবা সানিডেইল স্কুলে অ্যাডভান্সড লেভেল সেকশন খোলার ইচ্ছা পোষণ করতেন এবং প্রতিনিয়ত আমাকে উৎসাহ দিতেন। কিন্তু আমি ১০ বছর সেই ইচ্ছার বাস্তবায়নে কর্ণপাত করিনি। ইতিমধ্যে তিনি দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যানসারে আক্রান্ত হন। সম্ভাব্য পরিণতির কথা ভেবে ও তাঁর সদিচ্ছা পূরণের জন্য আমি জিনাত আফরোজার কাছে অ্যাডভান্সড লেভেল খোলার প্রস্তাব রাখলাম। অবশেষে ২০০৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব কেমব্রিজের অধীনে পরিচালিত কেমব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল এক্সামিনেশনসের পাঠ্যক্রম অনুসারে অ্যাডভান্সড লেভেল চালু করতে সক্ষম হলাম। বাবার জীবদ্দশায় সানিডেইল স্কুলকে অ্যাডভান্সড লেভেলে উন্নীত করতে পেরেছিলাম, এটা আমার পরম সৌভাগ্য। সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় প্রতিবছরই সানিডেইলের অর্ডিনারি ও অ্যাডভান্সড লেভেলের ফল অত্যন্ত ভালো।
শুধু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর নয়, পাশাপাশি খেলাধুলা, বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং নানাবিধ সামাজিক ও সেবাধর্মী কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততার প্রতিও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে সানিডেইল। এখানে উল্লেখ্য, এ যাবৎ প্রায় ৮০টি প্রতিষ্ঠানকে আমরা সাহায্য ও সহযোগিতা করেছি। ইংরেজি মাধ্যম স্কুল হলেও দেশীয় কৃষ্টি ও বাঙালি সংস্কৃতিচর্চা আমরা অব্যাহত রেখেছি। পাঠদানের ক্ষেত্রেও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে সমান গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
আমি চাই, আমার স্কুলের শিক্ষার্থীরা শুধু পুঁথিগত শিক্ষাই গ্রহণ করবে না, তারা সুশৃঙ্খল হবে। সদাচারী, হৃদয়বান ও সহনশীল একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশ ও দশের সেবায় এগিয়ে যাবে এবং সুনাগরিক হিসেবে নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে।
সানিডেইলের শিক্ষার্থীরা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। তাদের সাফল্য ও উন্নতি আমাকে ভীষণ আনন্দ দেয়, তৃপ্ত করে। কিছুদিন আগে আমেরিকার পারডু ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত সানিডেইলের প্রাক্তন ছাত্র নুরুল আজীম এসেছিল স্কুলে, ওর পরনে ছিল সানিডেইলের স্কুল ইউনিফর্ম। ওর সঙ্গে কথা বলে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ি। ওর হৃদয়ে আজও সানিডেইল লুকিয়ে আছে বলে প্রিয় স্কুল ইউনিফর্মটি অতি সযত্নে ধরে রেখেছে। আমাদের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অনেকেই আসে তাদের স্বজনদের সন্তান ভর্তির জন্য। সানিডেইল সম্পর্কে তাদের অন্য এক অনুভূতি প্রকাশ পায়। পাঠরত অবস্থায় স্কুলের কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা অনেক সময় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করলেও যখন তারা স্কুল ছেড়ে চলে যায়, সেই কঠোর নিয়মনীতিগুলো পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
সানিডেইল স্কুলের নিজস্ব ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা আমাদের অনেক দিনের। অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছি বিগত ২০টি বছর ধরে। স্কুলভবন নির্মাণের উপযোগী জমির সন্ধানে ঢাকা শহরের সর্বত্র হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি। সরকারি বিজ্ঞাপন অনুসারে আবেদন করেও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছি। তবে সৃষ্টিকর্তা সহায় ছিলেন বলে আমার বাবার ব্যক্তিগত উদ্যোগে অবশেষে ঢাকার বসুন্ধরায় জমি পেলাম। প্রায় পৌনে আট বিঘা (১৫২ কাঠা) জমির জন্য আট বছর ধরে ১৬টি কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করতে সক্ষম হয়েছি।
সানিডেইলের নিজস্ব জমিতে স্কুলভবন নির্মাণের প্রাথমিক প্রস্তুতির কাজ এগিয়ে চলেছে। সরকারি অনুমোদন পেলেই আশা করছি নির্মাণকাজ শুরু করতে পারব। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, আমার বয়সও বাড়ছে। আমার জীবদ্দশায় যদি সানিডেইলের নিজস্ব ভবন তৈরি করে যেতে পারি, আমার চাওয়া-পাওয়ার আর কিছুই থাকবে না। বর্তমানে সানিডেইল স্কুল ঢাকা শহরের প্রথম সারির ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। ২২ শ শিক্ষার্থী। এটা আমার জন্য এক বিরাট অর্জন।
এই স্কুলের একটু একটু করে এগিয়ে চলার পেছনে স্কুল কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে শিক্ষক, অভিভাবক ও সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সীমাহীন অবদান অনস্বীকার্য। তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া আমাদের স্কুল বর্তমান পর্যায়ে উঠে আসতে পারত না। সানিডেইল যে কর্মধারা ও নীতিতে আস্থা রেখে এগিয়ে চলেছে, আমি আশাবাদী, আগামী দিনেও তা অক্ষুণ্ন থাকবে।
যাত্রার শুরু থেকে আমাদের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন ও আছেন, তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতা আমাদের পথ চলতে শক্তি জুগিয়েছে। বিশেষভাবে স্মরণ করি আমার বাবা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান খান ও আমার মা সোফিয়া মান্নান খানকে। তাঁদেরই প্রদর্শিত পথ ধরে আমি এগিয়ে চলেছি। ভবিষ্যৎ অজ্ঞাত। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সানিডেইল শিশু, কিশোর, শিক্ষার্থীদের মধ্যে একইভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি এই স্কুলকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যাব—এই আমার দৃঢ় প্রত্যয়, আমার অঙ্গীকার।
তাজিন আহমেদ, অধ্যক্ষ, সানিডেইল