আধ্যাত্মিক জননী মারিয়া

হেনরী স্বপন
হেনরী স্বপন

ওম্যানস বাইবেল বা নারীর বাইবেল...ঊনবিংশ শতকের শেষ দিকে প্রকাশিত একটি সাড়া জাগানো গ্রন্থ। এটি রচনা করেন নারীমুক্তির অন্যতম প্রবক্তা এলিজাবেথ কেডি স্ট্যানটন এবং তাঁর সমমনা আরও ২৩ জন নারী। এঁরা আবার সবাই মনেপ্রাণে মারিয়াভক্ত। সন্তান প্রসবের পরও কুমারী উপাধিতে পূজিত মেরি, মরিয়ম কিংবা মারিয়াই একমাত্র নারী, যিনি খ্রিষ্টধর্মের বাইবেল অনুসারে চিরকালের ‘চিরকুমারী বা ডিভাইন ভার্জিন’ সম্মানে ভূষিত এবং পৃথিবীর তাবৎ খ্রিষ্টভক্তের একমাত্র বিশ্বজনীন জননীরূপে পূজিত। এ জন্যই তো আমরা যুগে যুগে সমাপ্তকরণে এই মাতার বন্দনা করি : ‘প্রণাম মারিয়া, প্রসাদ পূর্ণা, প্রভু তোমার সহায়, তুমি নারীকুলে ধন্যা, তোমার গর্ভফল যিশুও ধন্যা। হে পূর্ণময়ী মারিয়া ঈশ্বর জননী...বলে জপ করি। শাশ্বত জীবনের জন্য তাঁর কাছে আমাদের আত্মার প্রশান্তি ও সমৃদ্ধ জীবনের জন্য সমস্ত প্রার্থনা ও আধ্যাত্মিক নিবেদন করি। কারণ, পৃথিবীতে যিশুর আবির্ভাবের সময় কুমারী মারিয়া যেমন তাঁর ঐশীপুত্রের জননীরূপে জীর্ণ কুটিরে শিশুটির পাশে ছিলেন। ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মৃত্যুর সময়েও তিনি পুত্রের যন্ত্রণার সহভাগী হয়েছিলেন। পশ্চাশত্তমীর দিনে যখন এই মণ্ডলীর জন্ম হচ্ছিল। সেদিনও যিশুর শিষ্যদের অন্তরে পবিত্র আত্মার আলোক অবতারণের সময়ও তিনি সবার মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।
দারুণ হতাশা, দুঃখ, যন্ত্রণার মধ্যেও মারিয়া ঈশ্বরের আহ্বানে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। যেদিন স্বর্গদূত তাঁর কাছে এসে বললেন: ‘প্রণাম তোমায়! ঈশ্বর আশিস ধন্য তুমি! প্রভু তোমার সঙ্গে আছেন’ এই কথা শুনে মারিয়া গভীরভাবে বিচলিত হলেন। তিনি ভাবতে লাগলেন, এমন সম্ভাষণের অর্থ কী? স্বর্গদূত তাঁকে বললেন: ‘ভয় পেয়ো না, মারিয়া! তুমি ঈশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তাঁর নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন।’... মারিয়া তখন দূতকে বললেন: ‘তা কীভাবে হবে? আমি যে কুমারী!’ উত্তরে দূতটি বললেন: ‘পবিত্র আত্মা এসে তোমার ওপর অধিষ্ঠান করবেন, পরাৎপরের শক্তিতে আচ্ছাদিত হবে তুমি। তাই এই যাঁর জন্ম হবে, সেই পবিত্রজন ঈশ্বরের পুত্র বলেই পরিচিত হবেন!’... (লুক ১: ২৮-৩৫)। আর তাই তো, দেবদূতের মাধ্যমে ঈশ্বরের অভিপ্রায়ে মারিয়া এই জগতের পবিত্রতার জননী হয়ে প্রভুর এবং মানবজাতির কল্যাণে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নিবেদন করেছিলেন। এভাবেই ঈশ্বর তাঁর প্রতিবেদন গ্রহণ করে তাঁকে নির্বাচিত সেবিকারূপে স্বর্গলোকে সশরীরে উন্নীত করেছিলেন। ফলে আধ্যাত্মিক জননী হয়ে যতটা মাতৃভক্তি পেয়েছেন, ততটাই খ্রিষ্টমণ্ডলীর বহু সাধু-সন্ত ও খ্রিষ্টভক্ত মারিয়ার প্রতি তাঁদের চিরকুমারী ভক্তিভাবককে আজও পর্যন্ত জাগ্রত রেখেছেন। এ জন্যই আমরা তাঁকে চিরভক্তি ভরে বন্দনা করি। হৃদয়ের সমস্ত আবেগ-অতিবেগ দিয়ে তাঁকেই সম্বোধন করি কুমারী মারিয়া...বলে।
এ ক্ষেত্রে শ্লোক­-পুরাণে বর্ণিত মার্তৃকা বর্ণের মাতা কুন্তি, মাদ্রি, মৎস্যগন্ধা ও আরও অনেকের ভাগ্যে কিন্তু তেমন সম্মানের কিংবা সান্ত্বনার উজ্জ্বল কোনো ধর্মীয় স্বীকৃতি-উপাধিও জোটেনি। তবে প্রাক্-খ্রিষ্টীয় প্যাগান ও খ্রিষ্টীয় মধ্যযুগ ও আধুনিক—এই কালানুক্রমে ধর্ম সম্পর্কে মানুষের সহজাত আনুগত্যকে ব্যবহার করা হয়েছে যিশুর পুনরুত্থান অংশীদারির আনুগত্য গঠনে। তাই দেশে দেশে জাতিভেদে কন্যাকে কুমারী করে রাখার জন্য ধর্মশাস্ত্রের অবদানে যেমন হিন্দুদের ‘কুমারী পূজা’ এবং রোমে খ্রিষ্টানদের ‘ভেস্টাল ভার্জিন’ উপাসনা—এসবই নারীকে পবিত্র করে রাখার সময়ানুগ একটা কালচিত্র নয় কি? যা কেবল চার্চ-ভিত্তিক ধর্মগুরুদের রাজতান্ত্রিক স্বীকৃতিকালেই ঘটেছে। কারণ, মৃত্যুর পর মারিয়া স্বর্গে উন্নীত হলেও ইহজগতের সব অন্যায় ও দুঃখ-কষ্টের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আদর্শ জননী হিসেবেই আমরা যেন কেবল তাঁকেই স্মরণ করে বাঁচি এবং সর্বদাই আমাদের ভক্তিবোধে...জননী কুমারী মারিয়ার থেকে প্রাপ্ত অনন্ত জীবনের আনন্দ লাভ করি।
হেনরী স্বপন: কবি