পুণ্য বর্ষ: দয়ার জয়ন্তী

আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও
আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও

‘তোমাদের স্বর্গীয় পিতা যেমন দয়ালু, তোমরাও তেমনি দয়ালু হও।’ (লুক ৬: ৩৬) বড়দিন ঐশী দয়ার মহাদিন! প্রভু যিশুর জন্মদিন—আমাদের জন্য দয়ার বড়দিন! তাই বড়দিনে ঐশ দয়ায় আমরা আনন্দিত। স্বর্গস্থ পিতার দয়ার মুখচ্ছবি হচ্ছেন আমাদের প্রভু যিশুখ্রিষ্ট। কালের পূর্ণতায় নাজারেথে যিশুর জন্ম এবং মানবদেহ ধারণ ঐশ দয়ারই পূর্ণ প্রকাশ। বেথলেহেমের গোশালায় জন্ম নেওয়া যিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা উপলব্ধি করি আমাদের প্রতি স্বর্গস্থ পিতার দয়া। মানুষের জীবনে পাপরাশি যখন ব্যাপক, বিস্তৃত ও মারাত্মক আকার ধারণ করে তখন আমরা উপলব্ধি করি—ঈশ্বর আমাদের মাঝে আসেন তাঁর পূর্ণ দয়া নিয়ে। তাঁর দয়ায় সব পাপের ক্ষমা আমরা অনুভব করি। ঈশ্বরের ভালোবাসা, দয়া ও ক্ষমা আমাদের মধ্যে নিয়ে আসে আনন্দ। আর এই আনন্দই বড়দিনের প্রকৃত আনন্দ। পোপ ফ্রান্সিস কর্তৃক ঘোষিত ‘পুণ্য বর্ষ: দয়ার জয়ন্তী’ শুরু হচ্ছে আগমনকাল এবং বড়দিনের উৎসব দিয়ে। এই পুণ্য বর্ষে স্বর্গস্থ পিতার দয়ার মুখচ্ছবি আবার নতুন করে প্রকাশিত হবে। প্রথমত, প্রকাশিত হবে প্রভুর যিশুর জন্মোৎসবকালে, দ্বিতীয়ত, ঐশ রাজ্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যিশুর সব দয়া কাজের মধ্য দিয়ে, এবং তৃতীয়ত যিশুর যাতনাভোগ, মৃত্যু এবং তাঁর পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে ঐশ দয়া প্রকাশিত হবে। আমরা সবাই ধর্মবিশ্বাসী মানুষ। সৃষ্টিকর্তাকে আমরা বিশ্বাস করি। যিনি সৃষ্টিকর্তা—তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি পরম করুণাময়, তিনি দয়াময় প্রভু। সৃষ্টিকর্তা জগৎকে সৃষ্টি করেছেন; সব মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর আপন প্রতিমূর্তিতে। তাঁর সৃষ্টিই তাঁর দয়ার প্রথম অভিপ্রকাশ। মানুষ দুর্বলতার কারণে পাপে পতিত হয়। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা তাঁর ভালোবাসার কারণে মানুষকে দয়া করেন, তাকে ক্ষমা করেন এবং তাকে পরিত্রাণ করেন। যে ব্যক্তি পরম করুণাময় প্রভুর দয়া উপলব্ধি করে, সে কিন্তু তাঁর কাছ থেকে দয়া শেখে। আর যে ব্যক্তি দয়া শেখে, সে কিন্তু অন্যকে দয়া শেখাতে পারে, দয়া দেখাতে পারে এবং দয়ার সাক্ষ্য দিতে পারে। সাক্ষ্য ছাড়া শিক্ষার পূর্ণতা যেমন আসে না, তেমনি দয়া প্রদর্শন ছাড়া দয়া লাভের সার্থকতাও পূর্ণভাবে প্রকাশ পায় না। মানুষ যেন প্রকৃত মানুষ হতে পারে তার জন্য ঈশ্বর মহামানব যিশুকে এই জগতে পাঠালেন। প্রকৃত মানুষ হতে হলে, এ বছরে আমরা যে বিষয়গুলো পঠনে-অধ্যয়নে, ধ্যানে-জ্ঞানে ও আচার-আচরণে বিশেষ গুরুত্ব দিতে পারি তা হবে এরূপ— প্রথমত, আমরা সবাই উপলব্ধি করব যে সর্বশক্তিমান করুণাময় প্রভু আমাদের সবাইকে ব্যক্তিগতভাবে খোঁজ করেন, তিনি আমাকে ভালোবাসেন এবং তাঁর দয়ায় তিনি আমার সব পাপ ক্ষমা করেন। তাঁর এই দয়াশীল ক্ষমা পেয়ে আমরা যেন আনন্দিত হই। দ্বিতীয়ত, যারা প্রান্তিক জনগণ, অর্থাৎ শিক্ষাগত, সামাজিক, মানসিক ও নৈতিকভাবে যারা সমাজে প্রান্তিক জীবনযাপন করছে, যাদের আর্তনাদ কেউ শুনছে না, যাদের কণ্ঠ রোধ করা হচ্ছে, যাদের অধিকার অস্বীকার করা হচ্ছে, মানুষের অবহেলায় যারা ডুবে মরছে—তাদের প্রতি দয়াশীল হওয়া। তৃতীয়ত, দয়া দেখানো অথবা দয়া প্রদর্শনের কাজসমূহ আপন আপন জীবনসাধনায় প্রকাশ করা, যেমন: ক্ষুধার্তকে খাদ্যদান, তৃষ্ণার্তকে জলদান, বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, নিরাশ্রয়কে আশ্রয়দান, কারারুদ্ধকে আশ্বাসদান, অসুস্থকে সেবাদান, মৃতদের সৎকার সাধন, পাপীকে সুপথে আনয়ন, অজ্ঞকে শিক্ষাদান, সংশয়াপন্নকে সুপরামর্শদান, দুঃখীকে সান্ত্বনাদান, ধীর চিত্তে কষ্ট সহ্য করা, অপরাধের ক্ষমা করা, অন্যের কল্যাণ প্রার্থনা করা প্রভৃতি। এই দয়ার বড়দিন উপলক্ষে ঈশ্বরের দয়া প্রচুর পরিমাণে আপনাদের ওপর ঝরে পড়ুক এবং নববর্ষটি পুণ্য বর্ষ হয়ে আপনাদের জীবনে আসুক—এই আমার প্রার্থনা, শুভেচ্ছা ও আশীর্বাদ। বড়দিন উপলক্ষে এবং পুণ্য বর্ষের প্রতিটি দিনে, ঈশ্বরের দয়ার আনন্দ আপনাদের প্রত্যেকের অন্তরে বিরাজ করুক।
আর্চবিশপ প্যাট্রিক ডি’রোজারিও সিএসসি: ধর্মপাল, ঢাকা মহা ধর্মপ্রদেশ