লোকশিল্পী নয় অনন্য মনীষা

আব্বাসউদ্দীন আহমদ (২৭ অক্টোবর ১৯০১—৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল
আব্বাসউদ্দীন আহমদ (২৭ অক্টোবর ১৯০১—৩০ ডিসেম্বর ১৯৫৯) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

বাঙালির সংগীতের ভুবনে শিল্পী আব্বাসউদ্দীন আহমদ (১৯০১—১৯৫৯) এক যুগমনীষা। তাঁর শৈল্পিক অভিযাত্রা ও গুণের প্রকাশ বাঙালির আবহমান ধারাকে জাতীয় ও বিশ্বপর্যায়ে তুলে ধরেছে। এ কারণে বিশিষ্টজনেরা তাঁকে নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন। আব্বাসউদ্দীন নিজেকে ‘গানের পাগল’ বলে অভিহিত করলেও অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে বলেছেন ‘একজন অসাধারণ লোকসংগীতশিল্পী’। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের দৃষ্টিতে তিনি ‘ভাওয়াইয়ার জাদুকর’। সর্বসাধারণের কাছে ‘ভাওয়াইয়ার রাজপুত্র’। লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে তাঁর খ্যাতি সব পরিচয়কে ছাপিয়ে গেছে। গায়নশৈলী ও শিল্পবিচরণের সূত্রে এসব মূল্যায়ন যথার্থ কি না, সে বিষয়ে আলোচনার আগে তাঁর চিন্তা-চেতনার জগৎটি বোঝা দরকার। আব্বাসউদ্দীন শিল্পী হিসেবে দুই বাংলার মানুষের কাছে বেশ পরিচিত, কিন্তু তাঁর শৈল্পিক অবদানের বিভিন্ন দিক অনেকেরই অজানা।
একজন মহান শিল্পী কেবল তাঁর ভালো গায়কিতেই সীমিত নন; বরং তাঁর সামাজিক অবদান, রাজনৈতিক আদর্শ, মানুষের মুক্তি ও সংস্কৃতির নতুন ব্যাখ্যানে ভূমিকা, সমসাময়িক শিল্প অভিযাত্রায় তাঁর অভিব্যক্তি ইত্যাদি উন্মোচন করে দেখতে হয়। সেদিক থেকে আব্বাসউদ্দীনের কী ভূমিকা ছিল, তা বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মন্তব্য থেকেও। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বাংলার গ্রামে গ্রামে আব্বাসউদ্দীন সাহেব জনপ্রিয় ছিলেন। জনসাধারণ তাঁর গান শুনবার জন্য পাগল হয়ে যেত। তাঁর গান ছিল বাংলার জনগণের প্রাণের গান। বাংলার মাটির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির সম্বন্ধ।’ এই বক্তব্যের মধ্যে ‘জনপ্রিয়’, ‘জনসাধারণ’, ‘বাংলার মাটি’ কিংবা ‘নাড়ির সম্বন্ধ’ এই শব্দগুলো একজন শিল্পীর পাশাপাশি রাজনীতি-সচেতন, জাগরণ-উদ্দীপনাকেই বিশেষভাবে চিহ্নিত করে। তিনি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। সেকালের পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজকে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কোটর থেকে তুলে আনতে সভা-গায়কের ভূমিকায় নিজেকে তিনি নিবেদন করেছিলেন। সরাসরি গণমুখী গান না গেয়েও এক অর্থে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ভূমিকায় অংশ নিয়েছিলেন।
হেমাঙ্গ বিশ্বাস, নির্মলেন্দু চৌধুরী, সলিল চৌধুরী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, নিবারণ পণ্ডিত, রমেশ শীলের মতো গণসংগীতশিল্পীরা সরাসরি রাজনৈতিক আদর্শ ও মানবতাবোধকে সাংগীতিক উপায়ে বাস্তবায়ন করেছেন। বিশ্বসংগীতের পল রোবসন, পিট সিগার, ভিকতোর হারা, হ্যারি বেলফন্টে প্রমুখ সংগীতের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষকে শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামে হাল ধরেছিলেন। আব্বাসউদ্দীন সে পথে সরাসরি যাননি। তিনি উন্মিলিত করেছিলেন সমাজের মন।

>সেকালের পিছিয়ে পড়া মুসলমান সমাজকে অশিক্ষা ও কুসংস্কারের কোটর থেকে তুলে আনতে সভা-গায়কের ভূমিকায় নিজেকে তিনি নিবেদন করেছিলেন

মুসলমান সমাজকে তিনি গানের জোয়ারে ভাসিয়ে দেন। লোকসংগীতের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে তাঁর অবলম্বন ছিল মারফতি, মুরশিদি, ইসলামি, দেশাত্ববোধক, কাওয়ালি—এ ধরনের গান। এ সময়ে মুসলমান সমাজে ইসলামি গানকে যেভাবেই গুরুত্ব বিবেচনা করা হোক না কেন, ১৯৩০ ও ১৯৪০-এর দশকের বাস্তবতা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে এ দেশে অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের সাংস্কৃতিক উত্থান ও নবজাগরণে তাঁর ভূমিকা অসামান্য। কাজী নজরুল ইসলামকে ইসলামি গান রচনায় উদ্দীপিত করেছিলেন আব্বাসউদ্দীন। তিনি বলেছিলেন, ‘কিভাবে কাফের-কুফর ইত্যাদি বলে বাংলার মুসলমান সমাজের কাছে আপনাকে অপাঙ্ক্তেয় করে রাখবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে একদল ধর্মান্ধ। আপনি যদি ইসলামী গান লেখেন তা হলে মুসলমানের ঘরে ঘরে আবার উঠবে আপনার জয়গান।’ ঘটেছিলও ঠিক তা-ই। কাজী নজরুলের রচনা এবং আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠ হয়ে উঠেছিল এক অনন্য যুগলবন্দী। গ্রামোফোনে তাঁদের গান বাঙালি মুসলমানকে মাতিয়ে দিয়েছিল। টেনে এনেছিল নতুন যুগের সংস্কৃতির স্রোতোধারায়।
গবেষক ও সংগ্রাহকের ভূমিকাতেও আব্বাসউদ্দীনের যথাযথ মূল্যায়ন এখনো হয়নি। বিশ শতকের সংগীতচর্চায় সারা বিশ্বেই লোক ও আঞ্চলিক গান প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে উচ্চতর গবেষণার আকর্ষণীয় উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে গড়ে উঠেছে কালচারাল ইন্ডাস্ট্রির ধারণা। গ্রামোফোনের কল্যাণে পপুলার আর্টের অবিশ্বাস্য উত্থান ধ্রুপদি শিল্পকলার চিরায়ত ব্যাখ্যার পরিসরকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে। উনিশ শতকে আঞ্চলিক গান নিম্নবর্গীয় জনপদে প্রবাহিত হতে থাকলেও অভিজাত নাগরিক জীবনে তার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়নি। আব্বাসউদ্দীন আহমদ সে যুগের সেই বাধা ভেঙেচুরে উড়িয়ে দিয়ে লোকসংগীতকে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তুলে আনতে পেরেছিলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি জসীমউদ্দীন, কানাইলাল শীল, শৈলেন রায়, জিতেন মৈত্র, শিশির ভাদুড়িসহ আরও অনেক লেখক, কবি, সংগ্রাহক, গবেষকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। নিছক একজন শিল্পীর পক্ষে এ ধরনের সমন্বয়মূলক কাজ অসম্ভব।

গানের আসরে আব্বাসউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত
গানের আসরে আব্বাসউদ্দীন আহমদ। ছবি: সংগৃহীত

লোকশিল্পীরা সাধারণত তাঁদের নিজস্ব অঞ্চলের সুরের গানই শুধু গেয়ে থাকেন। এর বাইরে অন্য অঞ্চলের বিচিত্র গান বা সুর একই মানে গাইতে পারা তাঁদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এটিই লোকশিল্পীদের বৈশিষ্ট্য। তাঁর পক্ষে অভিজাত সমাজের কাছে লোকগান জনপ্রিয় করে তোলাও কঠিন। আব্বাসউদ্দীন এখানেই ব্যতিক্রমী। তিনি ‘গ্রামীণ মানুষের ব্রাত্যসংগীতকে পরিবেশনের ভেতর দিয়ে নাগরিকজনের কাছে প্রতিষ্ঠিত ও তাঁদের গর্ব-গৌরবের বস্তু করে তুলেছেন।’ তাঁর গায়কির মধ্যেও সেই দক্ষতা ও চিত্রায়ণের অভিঘাত লক্ষ করা যায়।
সুরের থেকেও নিসর্গের রূপ প্রকাশের কণ্ঠানুশীলন একজন আধুনিক ও প্রশিক্ষিত শিল্পী ছাড়া সম্ভব নয়। এ কারণে তিনি একাধারে রাজনীতিবিদের কাছে প্রতিবাদের এবং জনমানুষের কাছে প্রেম ও দায়বোধের প্রতীক হয়ে উঠতে পেরেছেন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তাঁর চিত্রময় ভাষায় বলেছেন, ‘কোনো আঙ্গিকের চর্চা করতে গিয়ে বস্তুজ্ঞান শেখা যায় না। নদীর বাঁকের ছবি আঁকার সময় আমার তুলি আমার দৃষ্টির চাইতে আব্বাসউদ্দীনের গানের অনুকরণ করেছে বোধ হয় বেশি। ঐ যে ভরা নদীর বাঁকে, কাশের বনের ফাঁকে ফাঁকে, দেখা যায় যে ঘরখানি, সেথায় বধূ থাকে লো। নদীর বাঁকে বসে কাশের বনের ওপারে যদিও ফাঁকা এক বিরাট মাঠ, তবুও তার মাঝে আমার চোখে বঁধুর ঘর ভেসে উঠত। আর তাই নিয়ে ছবি আঁকার যে আনন্দ তা বলে শেষ করা যায় না। এ গান আগেও শুনেছি, এ বাঁক আগেও দেখেছি। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের গলায় শুনবার আগে আমি তার ছবি আঁকতে পারিনি।’
আব্বাসউদ্দীন এ কারণে লোকগানের ধারক হয়েও আধুনিক শিল্পবোধে তাড়িত নাগরিক শিল্পী। তাঁর গান শুধু সুরে ও কথাতেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর সার্বিক কর্মকাণ্ড সামাজিক ও রাজনৈতিক, এমনকি আধুনিক শিল্পের সঙ্গে সুষম সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। শুধু লোকশিল্পী বললে সেই আব্বাসউদ্দীনের ব্যক্তিত্ব ও অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। বেটোফেন বা বারটোল্ট ব্রেখট, হান্স আইসলার বা পিট সিগার লোকসুর ও গান নিয়ে পাশ্চাত্যের সংগীত পরিমণ্ডলের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আব্বাসউদ্দীনকেও সেই সূত্রায়ণে বুঝে নিতে হয়। তাহলেই বাঙালিত্বের পটভূমিতে তাঁর কীর্তি প্রকৃত মহিমা পেতে পারে। আজও বিদেশি বন্ধুরা বাংলা গানের সন্ধানে এ দেশে প্রতিনিয়ত অন্বেষণে আসেন, কিন্তু বাঙালি উন্মোচিত হয় না। আমরা ঠিকমতো তুলে ধরতে পরিছ না বলে আব্বাসউদ্দীন আহমদের কীর্তিগাথাও গভীর ও বিশেষ অর্থ নিয়ে উঠে আসতে পারছে না।
সাইম রানা: শিক্ষক, সংগীত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।