ভাষার মনীষা

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

১৯৪৮ সালে, পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন আদর্শের প্রশ্নে একরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বললেন, ‘আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি।’ একই সঙ্গে যুক্ত করলেন, ‘এটি কোনো আদর্শের কথা নয়; এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে মালা-তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙ্গি-দাড়িতে ঢাকবার জো-টি নেই।’

বাঙালি জাতির ঐক্য মূলত ভাষাগত। ভাষা ও সাহিত্য (১৯৩১) গ্রন্থে শহীদুল্লাহ্ বলেছেন, ভাষা মানুষের সমাজের একটি ‘বাঁধন-দড়ি’। ধর্ম, রাজনীতি ছাড়া এ রকম আরও কিছু ‘বাঁধন-দড়ি’ আছে; কিন্তু সবগুলোর গোড়ার কথা এই ভাষা। দুটি জাতি এক স্থানে হলে তাদের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান আরম্ভ হয়। বঙ্গদেশের মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ‘মুসলমানী’ শব্দ গ্রহণ করেছে। যেমন তোশক, বালিশ, পর্দা, দরজি, জামা, মোজা, কাঁচি, চশমা, কাগজ, কলম, সেতার, পোলাও, শরবত, বরফ, চাবুক, লাগাম ইত্যাদি। এই তালিকা এত দীর্ঘ যে তা একটি আস্ত অভিধানের সমান। সংস্কৃতের সঙ্গে আরবি-ফারসি শব্দের সম্মিলন আরও চমৎকার: ধন-দৌলত, হাট-বাজার, জিনিসপত্র, লজ্জা-শরম, কাণ্ডকারখানা, ঝড়-তুফান, মুটে-মজুর—এই তালিকাও দীর্ঘ করা যাবে

শুধু বাংলা শব্দে নয়, এ অঞ্চলে মুসলিম বিজয়ের পর বাঙালির সাংস্কৃতিক আচরণেও সম্মিলন ঘটেছে।যে কারণে হিন্দুর সংস্কৃতি আর মুসলমানের সংস্কৃতির অনেক কিছু আলাদা করা যায় না; আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বোঝা যায়, তা পরস্পর থেকে ধার করা। এর পরেও কি ‘বাঙালি’ (হিন্দু) আর ‘মুসলমান’ (যবন) সব ক্ষেত্রে এক হতে পেরেছে? দীনেশচন্দ্র সেন ১৯২০ সালে লেখা এক পত্রে শহীদুল্লাহ্‌কে লিখেছেন, ‘দুই জাতির ধর্মশাস্ত্র ও সাহিত্য যদি পরস্পরে পাঠ করেন তবেই আমাদের ঐক্য দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াইতে পারিবে।’ ওই একই পত্রে তিনি শহীদুল্লাহ্ সম্পর্কে বলেছেন, ‘যাঁহার বিদ্যার পরিধি আয়ত্ত করিবার সাধ্য আমাদের নাই’। অথচ এই শহীদুল্লাহ্ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতে এম এ পড়তে পারেননি; তাঁর জন্যে ‘তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব’ নামে আলাদা বিভাগ খোলা হয়। এ বিভাগের একমাত্র ছাত্র হিসেবে তিনি এম এ পাস করেন ১৯১২ সালে।

বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনিই প্রথম উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে যান—প্যারিসে সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং জার্মানিতে ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। আবুল ফজল ‘ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ প্রসঙ্গে’ লেখায় বলেছেন, ‘পাশ্চাত্যবিদ্যা মনে যে সংশয় ও জিজ্ঞাসার সঞ্চার করে—যার ফলে অনেকে পূর্ব বিশ্বাস ও সংস্কার সম্বন্ধে হয়ে উঠেন অসহিষ্ণু ও সন্ধিহান, মনে হয় শহীদুল্লাহ্ সাহেবের জীবনে তেমন বিপর্যয় কখনও দেখা দেয়নি।’ ইসলামি আবহাওয়া ও পরিবেশেই তিনি মানুষ, আর এর প্রভাবেই গড়ে উঠেছে তাঁর জীবন ও চরিত্র। যদিও পেশা আর জ্ঞানস্পৃহা তাঁকে সারা জীবন ধর্মনিরপেক্ষ বিষয়বস্তুর দিকে আকৃষ্ট করেছে। পীর পরিবারের উত্তরাধিকার ছিলেন শহীদুল্লাহ্। অথচ ওই পথে তিনি হাঁটলেন না। কাজী ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ (১৯৩২) উপন্যাসের দিকে তাকান। চাইলে আবদুল্লাহ তাঁর পিতার পীরালি-ব্যবসাকে সহজেই গ্রহণ করতে পারত। অথচ মুসলমান সমাজের সংস্কার এড়িয়ে সে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সেই পরিবর্তনের কালে জন্মেছিলেন এবং পরিবর্তন সূচনায় অগ্রবর্তী ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বাংলার পূর্ব অঞ্চলের জন্য একটা ঐতিহাসিক ঘটনা বটে। বাঙালির জ্ঞানচর্চার জন্য কলকাতা একমাত্র কেন্দ্র ছিল। এখন ঢাকা আরেকটি কেন্দ্র হয়ে উঠবে—এই দ্বিধা থেকে বাঙালি হিন্দু সহজে বেরিয়ে আসতে পারেনি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন (১৯২১) বাংলার একমাত্র লেকচারার হিসেবে। মুসলমান হওয়ার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের চাকরিতে তিনি অগ্রাধিকার পেয়েছিলেন—ব্যাপারটা মোটেও এ রকম নয়। নইলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ওই বিভাগের প্রধান হলেন কীভাবে?

পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বাংলা ভাষা, হরফ ও সংস্কৃতির ওপর যে আক্রমণ নেমে আসে, শহীদুল্লাহ্ প্রথম থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর জিয়াউদ্দীন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে সুপারিশ করেন। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে শহীদুল্লাহ্ লেখেন, দেশে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা হলে সে সম্মান বাংলার প্রাপ্য, দুটি রাষ্ট্রভাষা হলে বাংলার সঙ্গে উর্দুর কথা বিবেচনা করা যায়। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে শহীদুল্লাহ্ লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের কোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে, ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে।’ ‘আমাদের ভাষাসমস্যা’ প্রবন্ধে আশা করেছেন, ‘সে দিন অতি নিকট, যে দিন বাংলা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ভাষার স্থান অধিকার করিবে। বিদেশীয় ভাষার সাহায্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মতন সৃষ্টিছাড়া প্রথা কখনও টিকিতে পারে না।’

বাংলা ভাষার জন্যে আরবি বা রোমান হরফের প্রবর্তনকে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অত্যন্ত পশ্চাদ্‌গামী পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। বাংলা বানান প্রসঙ্গে তিনি কয়েকবার অংশ নিয়েছেন; বাংলা লিপিপদ্ধতি নিয়েও ভেবেছেন। ‘শোজা বাংলা’ নামে এক লেখায় দেখিয়েছেন, তাঁর প্রস্তাবিত পদ্ধতি গ্রহণ করলে মাত্র ৪৪টি টাইপ দিয়েই কাজ চলতে পারে; যেখানে ইংরেজিতে ছাপার জন্যে ৫২টি, উর্দুতে ২৫২টি আর সাধারণ বাংলায় ৪৩৪টি টাইপের দরকার হয়।

মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ উর্দু অভিধান প্রকল্পে সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের ভাষার আদর্শ অভিধান প্রকল্পের সম্পাদক হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমিতে যোগ দেন। মুহম্মদ আবদুল হাই লিখেছেন, ‘এ দুটি অভিধানের অন্তর্ভুক্ত শব্দাবলির ব্যুৎপত্তি নির্ণয়ে তাঁর সহজাত intuition বা প্রজ্ঞা তথা sixth senseএর পরিচয় পাই।’ বহু ভাষায় দখল থাকার কারণে এই দক্ষতা তাঁর মধ্যে তৈরি হয়েছিল। ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতাত্ত্বিকেরা অনেক সময় প্রাপ্য তথ্যের অভাবে প্রজ্ঞাবোধের সাহায্যে ‘ইনফারেন্স ড্র’ করে থাকেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষাতত্ত্ব-চর্চায় শহীদুল্লাহ্‌র মতো যথার্থ ভবিষ্যদ্বাণী অন্য কোনো ভাষাতাত্ত্বিক করতে পারেননি। প্রসঙ্গক্রমে বাংলা ভাষার কালনির্ণয়, বাংলা ভাষার উৎপত্তি, সিংহলি ভাষার উৎপত্তি, চর্যাপদের কাল নির্ণয়–সম্পর্কিত সমস্যাগুলোর উল্লেখ করা যায়।

শহীদুল্লাহ্ শিশুপত্রিকা আঙুর সম্পাদনা করেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলা পঞ্জিকা একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত রূপ পায়। ভাষাচর্চা, ব্যাকরণ-রচনা বা অন্য সব কাজের বর্ণনার মধ্য দিয়ে শহীদুল্লাহ্ সম্পর্কে পুরোপুরি বলা হয় না। আধুনিক বাঙালি মুসলমানের মানস-গঠনে তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ অবদান রয়েছে। আরও সরাসরি বলা যায়, তিনি পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু এই মানুষটি সরাসরি আত্মজীবনী রচনা না করে একটি কালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে আমাদের বঞ্চিত করেছেন।