ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ব্রতচারীর আদর্শটা আমি ধরে রেখেছি

>আবুল হাসনাত সম্পাদিত কামরুল হাসান, ১৯৯৯
কামরুল হাসান (১৯২১–১৯৮৮)
কামরুল হাসান (১৯২১–১৯৮৮)

আসলে আমি ১৯৩৫ সাল থেকে ব্যায়াম করি। ব্যায়ামের খাতিরে নানান ক্লাবে—এতে ওতে ঘোরাফেরা করা অভ্যেস ছিল। তা আমাদের একজন ট্রেনার তখন ছিলেন; মেজর তোজাম্মেল হোসেন। উনি ১৯৩৯ সালে হঠাৎ কাগজে দেখলেন, ব্রতচারী শিক্ষা শিবির হবে দেড় মাসের জন্য। আমি খুব ভালো কাঠি নাচ করতে পারতাম। উনি বললেন, ‘কামরুল তুমি ব্রতচারী নাচটা শিখে এসো।’ ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি, বোধ হয় ১৫ ডিসেম্বর হবে, গুরু সদয় দত্ত, যিনি ব্রতচারী আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি শিবির ওপেন করলেন।

গুরু সদয় দত্ত যে ধরনের বক্তব্য দিলেন, তাতেই আমি খুব চমকে উঠলাম। আর খুব, মানে একটা মানসিক পরিবর্তন এল। দেখলাম, নাচ শিখতে তো আসিনি। এর পেছনে একটা বিরাট উদ্দেশ্য আছে।...প্রতি রোববার তিনি আমাদের ক্যাম্পে আসতেন, সারা দিন আমাদের সঙ্গে থাকতেন, আর এসব নানা কথা হতো।

গুরু সদয় দত্ত, তখন তিনি বীরভূম জেলার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। ...তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব নাচ দেখতে রাজি হলেন। তারা ওই ঘাঘরা-টাঘরা পরে নামছে। দেখে তিনি খুব চটে গেলেন, ‘আমি এই জিনিস তো চাই না।’ বীরত্বব্যঞ্জক রায়বেঁশে নাচ আর হুঙ্কার আছে নানান রকম। তখন খুব, ওদের খুব তীব্রভাবে সমালোচনা করলেন—প্রায় গালাগালি করার মতো। তখন ওই ধরণীধচুলটুল ঝাঁকিয়ে ‘ইয়া’ বলে লাফ দিয়ে পড়ল, ‘হুজুর আমি জানি, আপনি যা চাচ্ছেন।’ তিনি বললেন, ‘তাহলে করো দেখি।’ তখন সে ওই রায়বেঁশেনাচটা শুরু করল। রায় মানে নিরেট, সলিড আর বেঁশে তো বাঁশ। সলিড বাঁশ দিয়ে যারা যুদ্ধ করত বা বল্লমের হ্যান্ডেল হিসেবে ব্যবহার করত, তাদের বলা হতো রায়বেঁশের দল। তখন তো স্টেনগান আর মেশিনগান হয়নি। খুব জোর দো-নলা বন্দুক আর গাদাবন্দুক ছিল। তিনি তাদের তখন, যারা একটু এডুকেটেড, স্কাউট মাস্টার, তাদের হাত করলেন। বললেন, ‘ওরা ওদের মতো নেচে যাবে, তোমরা ওগুলো দেখে শেখো এবং তোমরা ওগুলোকে একটা হিসাবের মধ্যে নিয়ে এসো।’...আমাদের ক্যাম্পে ওই ধরণীধবাউরী, রামপদ, কালীপদ—এরা সব আসত। আর একজন আসত, মটরু নামে একটা পটুয়া। সে মুর্শিদাবাদের লোক। এরা খানিকটা বাউলদের মতো—না মুসলমান, না হিন্দু—এই রকম এদের একটা ধর্মবিশ্বাস, নিরীহ টাইপের। মটরুর ছবি আঁকা দেখে অবাক হতাম। মটরু আসলে ছিল পেইন্টার, পটুয়া।...তখন আর্ট স্কুল ছিল কলকাতায়, এখন সেটা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্ট, আমি তার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। অলরেডি ফরমালি ছবি আঁকা শুরু করেছি। আর ইউরোপিয়ান টেকনিকে আঁকছি। গুরু সদয় দত্ত আমাকে খুব ভালোবাসতেন। তিনি বললেন, ‘কোনো শিক্ষার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বাধাও নেই। শিক্ষার সুযোগ যেখানে আছে, সেখানেই তোমাদের বিচরণ করতে হবে। তবে তুমি যেটা শিখছ, সেটা তো ইউরোপিয়ান ধাঁচে। মটরু যেটা করছে, সেটা একদম বাঙালি পদ্ধতিতে। এটি হচ্ছে তোমার নিজস্ব ধারা।’ একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। প্রথম যেদিন শিবির ওপেন করলেন, তখন তাঁর বক্তৃতা শুনে বুঝলাম, এ তো অন্য জিনিস, এ তো আসলে নাচ না। এর পেছনে জিনিস রয়েছে। তিনি চলে যাচ্ছেন, এমন সময় ঘুরে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে আবার আমাদের সেই ধমকানি, ‘বাঙালির সব জোয়ান জোয়ান ছেলে, অথচ শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। বুক ফুলিয়ে চলতে পারো না। এসো আমার সামনে দাঁড়াও এক–একজন করে।’ তো শিক্ষকেরা যাচ্ছেন, ছাত্ররাও যাচ্ছে। সবাই যাচ্ছে তাঁর সামনে, তিনি দুটো করে কিল মারছেন। মেরে ছেড়ে দিচ্ছেন। এক শিক্ষক বেচারা তাঁর কিল খেয়ে তিন দিন জ্বরেই ভুগলেন। এইসব লোক একটু একসেন্ট্রিক হয় তো।

কামরুল হাসান। ছবি: নাসির আলী মামুন
কামরুল হাসান। ছবি: নাসির আলী মামুন

তা, আমার তখন তো অল্পবিদ্যা ভয়ংকর, বললাম না ১৮ বছরের ছোকরা। আমি চনমন করছি, আমার সুযোগটা এলে দাঁড়াই। দাঁড়িয়েছি বুক টান করে, উনি হঠাৎ আমার ছাতিতে হাত রেখে বললেন, ‘বাহ্‌, ছাতিখানা তো বেশ। কী নাম?’ বললাম, ‘আমার নাম কামরুল হাসান।’
—তুমি মুসলমান?
—হ্যাঁ
তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, আর খুব খুশি। বললেন, ‘দেখো, এই কামরুলজির মতো আমাদের ছাতি করতে হবে। নাহলে চলবে না আমাদের।’

সেই দিন থেকে, প্রথম দিন থেকেই আমি তঁার খুব নজরে পড়ে গেলাম। ক্যাম্পে এসেই আমার খোঁজ করতেন, আমি কী করছি, কী রকমভাবে শিখছি। আমাকে আসলে গুরু সদয় দত্ত পুরোপুরি বাঙালি তৈরি করে দিয়ে গেছেন। সেই যে বাঙালি ভাবটা জাগল, সেটা আমার এখনো, এই ৬৬ বছর বয়স চলছে, আমি এখনো ওটা ধারণ করে আছি। যদিও পাসপোর্টে সিটিজেনশিপ বাংলাদেশি লিখতে হয়, আমি কিন্তু বাঙালি। এমনকি জিয়াউর রহমান আমাকে দিয়ে বাংলাদেশি বলাতে পারেননি।

ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ব্রতচারীর আদর্শটা আমি ধরে রেখেছি। ওই যে মটরু আমাকে দেখিয়ে দিয়ে গেল। সেই থেকে আমার ছবি দেখে আর যা–ই হোক, আমি একটা গরু আঁকলে লোকে বুঝতে পারে এটা কামরুল হাসানের আঁকা গরু। একটা মাছ আঁকলে লোকে বুঝতে পারে, এটা কামরুল হাসানের আঁকা মাছ। এর পেছনে কিন্তু ব্রতচারীর আদর্শটাই কাজ করে যাচ্ছে।...

ব্রতচারী বা মটরু ছাড়া অন্য প্রভাব—যামিনী রায়ও কিন্তু ইউরোপিয়ান টেকনিকে কাজ করতেন। যামিনী রায়ের করা গান্ধীজির একটা লাইফ পোর্ট্রেট আছে, একদম রিয়েলিস্টিক—ভিক্টোরিয়ান যুগের কাজ আমরা বলি। কিন্তু পরে তিনি যখন এই পটচিত্রে হাত দিলেন, তখনই যামিনী রায় যামিনী রায় হিসেবে নতুনভাবে আবির্ভূত হলেন। আমি, নিজের কথা নিজে বলা ঠিক নয়, কথা হচ্ছে, যামিনী রায় যেখানে শেষ করেছেন, আমি সেখান থেকে শুরু করেছি। কারণ একটা জিনিস, সামনে তো আরও নতুন যুগ আসছে। এই তো আমাদেরই বাচ্চাকাচ্চা আমাদের কথা মানছে না। এর জন্য তো তাদের দোষ দেওয়া যায় না। হয়তো তাদের খোরাকটা আমরা দিতে পারছি না। তারা এখন নতুন আবহাওয়া থেকে বেছে নিচ্ছে। তারা তাদের মতো করে চলতে চায়। তা আমরা চাই তারা সুখে থাক, যাতে আনন্দ পায়। অথচ যেন সৎ জীবন থাকে। এই জাল-জোচ্চুরি, মারপিট, খুন, এখন তো যেখানে-সেখানে হাইজ্যাক, ছিনতাই—এসব নতুন শব্দও এসেছে, নতুন কর্মপদ্ধতিও এসেছে।...

ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থার নকশাকেন্দ্র বা ডিজাইন সেন্টারে আমি যাওয়ার কারণ হলো, আমাকে নেওয়াই হলো, আমি যেহেতু ট্র্যাডিশনাল বা ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনগুলো করি—করতাম, সেটাকে যারা কারুশিল্পী কারিগর—বাঁশের কাজ করে বা কাঠ খোদাইয়ের কাজ করে বা কাঠের বেলুন, পিঁড়ে তৈরি করে বা মাটির কাজ করে, হাঁড়ি-পাতিল, তাদের আধুনিক যুগের উপযোগী জিনিস শেখানো এবং বাজারজাত যাতে করা যায়—কারণ কমার্শিয়াল কাজটা তো শুধু শখ মেটানো না, ওটা বেচে তাদের অন্নের সংস্থান করতে হবে। এটা হচ্ছে কমার্শিয়াল কাজ। সেই রকম আজকে যে বাংলাদেশে সাধারণ চালঝাড়া কুলা, ওটাকে আমরা নানা রকম নকশা দিয়ে, আমরাই প্রথম শুরু করি। ওটা দিয়ে ডিজাইন করা, ওটা দিয়ে ঘর সাজানো। তার সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল ওই যে মাছ ধরার বাঁশের—পটলের মতো দেখতে অপূর্ব সুন্দর শেপ। ওগুলো আমি ডিজাইন সেন্টারে রাখতাম, সেখান থেকে বিদেশের বহু লোক বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে—লাইট শেড করার জন্য। সেগুলোই আবার একটু ভেঙেচুরে নিয়ে অন্য ফরমে করছে। বুননের কাজ যাতে আরও সূক্ষ্মভাবে করা যায়, যেগুলো ওদের যে রকম জাপানে গিয়ে দেখলাম, শুধু বাঁশ কেটে, তার মধ্য দিয়ে, ছোট ছোট সরু সরু স্টিক তৈরি করা, হাতে দা দিয়ে করতে অনেক সময় লাগে। জাপানে ওরা মেশিনে করে ফেলছে। একটা বাঁশকে কাটছে মেশিনে, ৪ ভাগ করছে, ৮ ভাগ করছে, ১৬ ভাগ করছে, ৩২ ভাগ করছে—মোটা থেকে সরু। রেডিমেড করে রাখলে পরে কারিগরেরা বাজার থেকে কিনে নিয়ে গেলে,তারা ঝুড়ি বা ফল রাখার বাস্কেট তৈরি করতে, তাদের সময়টা বেঁচে গেল। এই জিনিসগুলো শেখানোই ছিল, তাদের মধ্যে ঢোকানোই ছিল আমার ডিজাইন সেন্টারের কাজ। আমি তো রিটায়ার করে গেছি। তারা এগিয়ে যাচ্ছে—থেমে নেই।