অদ্ভুত বিশ্বব্যবস্থায় ২০২০ যাত্রা!

যে অদ্ভুত বিশ্বব্যবস্থার কাছে আমাদের জীবন এখন সমর্পিত হয়েছে, কবি শামসুর রাহমান বেঁচে থাকলে তাঁকে নতুন কিছু লিখতে হতো। ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ কবিতা ও কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশের পর ২৫ বছরেরও বেশি পেরিয়ে এসে হয়তো লিখতে হতো ‘উল্টো পথে চলেছে ধরিত্রী’। যাঁরা আইনের শাসন, ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও উন্নত জীবন সন্ধান করে ফিরছেন, তাঁদের জন্য এতটা বড় দুঃসময় আর কখনো আসেনি। কথাটি যেমন ৫৬ হাজার বর্গমাইলের জন্য সত্য, তেমনই সত্য পুরো বিশ্বের জন্য। 

দু–দুটি মহাযুদ্ধের পর শান্তির সন্ধানে বিশ্বে যেসব আচার-রীতি, নিয়মকানুন গড়ে তোলা হয়েছিল এবং হচ্ছিল, সেগুলো সব একের পর এক তছনছ করে ফেলা হচ্ছে। পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের বৈশ্বিক বিকাশে যে রাষ্ট্রটি অগ্রভাগে ছিল, সেই রাষ্ট্রেই নেতৃত্ব বদলের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে এই পশ্চাৎমুখী যাত্রা। প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থাকে ভেঙে ফেলার কাজে এগিয়ে আছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। প্রথমেই তিনি বেরিয়ে গেছেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সম্মত বৈশ্বিক চুক্তি থেকে। শুধু বেরিয়ে গিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁর প্রত্যাহার কার্যকর হওয়ার আগপর্যন্ত অন্যদের জন্য বাধা তৈরি করে চলেছেন। তারপর গত কয়েক বছরে তিনি এ রকম আরও অনেকগুলো বাধ্যবাধকতা মেনে চলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এমনকি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকেরা যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকলে গ্রেপ্তারের হুমকিও দিয়েছেন। ইরানের পরমাণবিকীকরণে রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে একজোট হয়ে করা চুক্তির খেলাপ করে বিষয়টি নিয়ে শুধু ইরান নয়, সবার সঙ্গেই তিনি বিরোধে জড়িয়েছেন। একতরফাভাবে মধ্যপ্রাচ্য–সংকট সমাধানের চার পক্ষীয় সমঝোতা ভেঙে ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছেন এবং জেরুজালেম নগরী থেকে ফিলিস্তিনিদের বঞ্চিত করার পথে পা বাড়িয়েছেন। তিনি ‘বিশ্বের কারখানা’ বলে খ্যাত চীনের সঙ্গে বাণিজ্যব্যবস্থায় অপ্রত্যাশিত অস্থিরতার জন্ম দিয়েছেন। প্রতিবেশী মেক্সিকো ও কানাডাকেও বাণিজ্য চুক্তিতে রদবদল ঘটাতে বাধ্য করেছেন। বিশ্বজুড়েই বাজার উদারীকরণের ধারাকে উল্টে দিয়ে এখন সংরক্ষণবাদের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। 

বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এককভাবে যতটা অস্থিরতা তৈরি করেছেন, তা নজিরবিহীন। কিন্তু তিনি সেখানেই থেমে থাকেননি। বিশ্বজুড়ে তাঁর মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী, কট্টর ডানপন্থী এবং কথিত পপুলিস্ট বা জনতুষ্টিবাদী রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎসাহ জুগিয়েছেন। ইউরোপের সঙ্গে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ বাস্তবায়নে তিনি যে প্রভাব খাটিয়েছেন, তা বিস্ময়কর। তাঁর ভাষায়, ব্রিটেনের ট্রাম্প বরিস জনসন অপ্রত্যাশিতভাবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। কর্তৃত্ববাদী নেতাদের প্রতি তাঁর আস্থা ও মোহ বারবার স্পষ্ট হয়েছে। সেটি যেমন হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি অস্বীকারের জন্য অধিক-সমালোচিত ব্রাজিলের বলসোনারোর ক্ষেত্রে, তেমনি তুর্কি জাতীয়তাবাদী এরদোয়ান কিংবা ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির ক্ষেত্রে। উত্তর কোরিয়ার কিম জং–উন, চীনের সি চিন পিং, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন এবং সৌদি যুবরাজের নিষ্ঠুর কর্তৃত্ববাদিতাও তাঁর খুব পছন্দ। অভিশংসনের জন্য প্রতিনিধি পর্ষদ তাঁর বিরুদ্ধে অভিশংসন করলেও সিনেটে তা পাস না হলে চলতি বছরের নির্বাচনে তাঁর পুনর্নির্বাচনের সম্ভাবনা প্রবল বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তাতে ভবিষ্যৎ যে আরও কত জটিল সংকটে নিপতিত হবে, তা অনুমান করাও কঠিন। 

বিশ্বজুড়ে এসব কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা যখন ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার খর্বের নানা রকম নিবর্তনমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার না হয়ে বরং অনেক ক্ষেত্রেই তার সাফাই দিচ্ছে। সৌদি সাংবাদিক খাসোগি হত্যায় যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভার সিদ্ধান্ত অবজ্ঞা করে তিনি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সাফাই গেয়েছেন। মিথ্যার বেসাতি রাজনীতিতে নিয়ামক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সত্যকে মিথ্যা (ফেক নিউজ অভিহিত করে) আর মিথ্যাকে অবলীলায় সত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার চল শুরু হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা হচ্ছে প্রযুক্তির উন্নয়নের পিঠে সওয়ার হয়ে। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে বস্তুনিষ্ঠতার পরীক্ষা দিয়ে আস্থা অর্জনকারী মূলধারার সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাশ কাটিয়ে এসব নেতা প্রযুক্তির উপহার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভর করে কোটি কোটি মানুষের কাছে তাঁদের ইচ্ছামতো তথ্য এবং তথ্য বিকৃতির প্রসার ঘটাচ্ছেন। 

ওয়াশিংটন পোস্ট–এর হিসাবে ২০১৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে ১০৫৫ দিনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ১৫৪১৩ বার অসত্য কথা বলেছেন। ব্রিটেনের নির্বাচনে বিজয়ী কনজারভেটিভ পার্টি ফেসবুক ও টুইটারের মতো মাধ্যমে যত বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে, তার ৮৮ শতাংশ মিথ্যা বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটির গবেষকেরা। সম্প্রতি ফেসবুক রাজনীতিকদের মিথ্যা প্রচার বন্ধের দাবি নাকচ করে বলেছে, রাজনীতিকেরা কী বলছেন তা সবার জানার অধিকার রয়েছে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর একান্ত আলোচনার তথ্য প্রকাশে তিনি অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। আগামী নির্বাচনে তাই এসব মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে। 

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, অর্থনীতিতে এখন সংকটের লক্ষণগুলো ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। আর সংকট যত তীব্র হচ্ছে এসব জনতুষ্টিবাদী রাষ্ট্রনেতারা ততই অর্থনীতি থেকে জনগণের দৃষ্টি সরাতে উগ্রপন্থী, বর্ণবাদী এবং সাম্প্রদায়িক নীতির পথে ধাবিত হচ্ছেন, জাতীয়তাবাদকে নতুনরূপে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করছেন। সব জায়গাতেই আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন অভিবাসীরা। অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে অভিবাসনকেই দায়ী করা হচ্ছে। ভারতের সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের উদ্যোগ কিংবা ব্রিটেনের তথাকথিত নতুন স্বাধীনতা অর্জনের ব্রেক্সিট এই প্রবণতারই নজির। অথচ এসব দেশের অর্থনীতির পরিসংখ্যানগুলো করুণ বাস্তবতা তুলে ধরছে। ভারতে কথিত ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের বেলুন দম ফুরিয়ে ৬ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্রিটেনের অর্থনীতিতেও শিল্প খাতে উৎপাদন গত ছয় মাসে ঋণাত্মক হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বৈষম্য বেড়েই চলেছে। অক্সফাম জানিয়েছিল, মাত্র ১ শতাংশ শীর্ষ ধনীর হাতে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ কেন্দ্রীভূত হয়েছে বছর তিনেক আগেই এবং এখন ওই ধনকুবেরদের সম্পদ আরও বেড়েছে। জাতিসংঘের বাণিজ্য ও সহযোগিতা সংস্থা, আঙ্কটাড ১০ ডিসেম্বর প্রকাশিত ২০১৯–এর পরিসংখ্যান নির্দেশিকায় বলেছে চলতি বছরে বাণিজ্য কমবে প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। তারা আরও বলেছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হবে মাত্র ২ দশমিক ৭ শতাংশ, যা আগের বছরের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ কম। 

তবে এত সব হতাশা এবং অস্থিরতার মধ্যেও আশা জাগানোর মতো ঘটনা ঘটেছে অন্তত দুটি ক্ষেত্রে এবং উভয়টিতেই নেতৃত্বে ছিলেন তরুণেরা। একটি হচ্ছে গণতন্ত্রের আন্দোলন, অপরটি জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বৈশ্বিক জাগরণ। গণতন্ত্রের আন্দোলনে আলজেরিয়ায় সরকার পতন হয়েছে, নির্বাচন হয়েছে। সুদানে স্বৈরশাসক ওমর আল বশিরের দুঃশাসনের অবসান ঘটেছে এবং তিনি এখন বিচারের মুখোমুখি। সপ্তাহের পর সপ্তাহ তরুণেরা সেনানিবাস ঘিরে রাজপথ দখলে রেখে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং দেশটি নির্বাচনের পথে এগোচ্ছে। আফ্রিকার আরও কয়েকটি দেশে এ রকম আন্দোলন দেখা গেছে। এশিয়ায় হংকংয়ে বেইজিংয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন শাসকের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন প্রতিবাদ গড়েছে ছাত্ররা। এখন সেখানকার নাগরিকেরাও ছাত্রদের সঙ্গে গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। ইরাকে গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার বদল হয়েছে। ইরানে বড় ধরনের আন্দোলন হলেও তা নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হয়েছে। তবে ক্ষোভের অবসান হয়নি। লেবানন, চিলি, কলম্বিয়া, বলিভিয়ায় রাজপথের বিক্ষোভ রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন, অস্থিরতার জন্ম দিয়েছে। ভারতে সাম্প্রদায়িক নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে দেশটির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণজাগরণ প্রত্যক্ষ করা গেছে। বাংলাদেশেও তরুণেরা আশা জিইয়ে রেখেছেন। গণতন্ত্র রক্ষায় ব্যর্থ রাজনীতির হতাশায় তাঁরা এখনো আশার সলতে জ্বালিয়ে রেখেছেন। অধিকারের প্রশ্নে একমাত্র তাঁরাই রাজপথে নেমে আসার সাহস দেখিয়েছেন। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশ্নে নিষ্ক্রিয়তা বা যথেষ্ট ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে ক্ষুব্ধ কিশোর-তরুণদের অভূতপূর্ব জাগরণ শুরু হয়েছে। সুইডিশ ষোড়শী গ্রেটা থুর্নবাগের নেতৃত্ব এক নতুন নজির স্থাপন করেছে। ওই কিশোরী জাতিসংঘে দৃঢ়কণ্ঠে বিশ্বনেতাদের প্রশ্ন করেছে যে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে হেলাফেলা করার দুঃসাহস তোমরা কোথায় পেয়েছ? বিজ্ঞান যে সমাধান দেখাচ্ছে, সেই পথে এগোতে ওই নেতাদের বাধ্য করার জন্য তারা সংগ্রাম অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে। 

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে নতুন বছরকে ইংরেজি সংখ্যায় লিখে বেশ নাটকীয়ভাবে বলা হয় টোয়েন্টি টোয়েন্টি। কিন্তু বাংলায় যদি কুড়ি কুড়ি না বলে বিশ বিশ বলা হয়, উচ্চারণগত স্থূলতার কারণে তা বিষ বিষ শোনায়। আশা ও প্রার্থনা করি, বছরটা যেন কোনোভাবেই বিষময় না হয়। 

কামাল আহমেদ, সাংবাদিক।