আমার অভিনয় আমার জন্মভূমি আমার কথা

অর্ক দাশ l ছবি: লেখকের সৌজন্যে
অর্ক দাশ l ছবি: লেখকের সৌজন্যে

আমি জন্মেছিলাম চট্টগ্রামের ছোট্ট এক নার্সিং হোমে। ছায়াঘেরা সেই ছোট নার্সিং হোমের চিকিৎসক অমিয়া চৌধুরীর হাত ধরে দুনিয়া দেখেছি আমি। আমার মা দীপা দাশগুপ্ত তখন সামার ফিল্ড টিউটোরিয়ালের শিক্ষক। আর বাবা লেখক অজয় দাশগুপ্ত পেশায় ব্যাংকার হলেও দিন–রাত লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত।
জন্মেই দেখেছি আমার আম্মা মানে আমার ঠাকুমা অন্য ধরনের এক মানুষ। আমার প্রথম স্কুল যাওয়া তাঁর হাত ধরে। রেড রোজ কিন্ডারগার্টেনে আমার ভয় পাওয়ার দিনগুলোতে আম্মা আমাকে ফেলে বাসায় যেতেন না। আমি জানালা দিয়ে দেখতাম তারপর ক্লাসে ঢুকতাম। এরপর আমি ভর্তি হই সামার ফিল্ডে। সেখানেই আমার প্রথম আভিনয়ের হাতেখড়ি। স্কুলের নাটক জুতা আবিষ্কার–এ অভিনয়ের স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে।
সিডনি আসার আগের দিন অবধি আমার লেখাপড়া ছিল বিখ্যাত সেন্ট মেরি’স স্কুলে। সেখানেও আমার ভাগ্য ছিল সুপ্রসন্ন। আমার মায়ের মা দিদা রমা চৌধুরী ছিলেন সেখানকার শিক্ষক। ফলে কোনো দিনও আমার ভয় বা ভীতি কাজ করত না। সবকিছু পেছনে ফেলে মা–বাবার হাত ধরে অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমার জন্মতারিখ আনুযায়ী আমাকে এক ক্লাস ওপরে মানে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করে নেওয়া হয়। এ দেশে জুনের আগে জন্মালে এক নিয়ম পরে জন্মালে আরেক। একে ‘নন–ইংলিশ স্পিকিং’ ব্যাকগ্রাউন্ড, অন্যদিকে নতুন পরিবেশ। আমি ভয়েই স্কুলে যেতে চাইতাম না। গাছের পর গাছ জড়িয়ে ধরে কেঁদেকেটে দিন কেটেছে আমার। অথচ এই স্কুলেই আমি প্রথম আমার অভিনয়জীবনের সূচনা করি। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখনই আমরা শেক্সপিয়ার নাটক করে এ দেশে সাড়া ফেলতে পেরেছিলাম। সে উৎসবে সংলাপ বিভাগে প্রথম হই আমি। যে ছেলে কয়েক বছর আগে ভাষা না জানার কারণে স্কুলে যেতে ভয় পেত, সংলাপ বলায় তার প্রথম হওয়ার পেছনে ছিল ড্রামা টিচারের ব্যাপক ভূমিকা। তিনি আমাকে সন্তানস্নেহে বড় করে তুলেছিলেন। স্কুলে নাটককে বিষয় হিসেবে নেওয়ার পর মা একটু চিন্তিত হলেও বাবা ছিলেন সমর্থক। একসময় আমি স্কুলের পাশাপাশি থিয়েটারেও ডাক পেতে লাগলাম।

আনইন্ডিয়ান ছবির প্রিমিয়ারে অর্ক দাশ l ছবি: আইএমডিবি
আনইন্ডিয়ান ছবির প্রিমিয়ারে অর্ক দাশ l ছবি: আইএমডিবি

মজার ব্যাপার হলো আমি ভাবলাম আমার বাংলা নাম আমার অভিনয়জীবনের অন্তরায় হতে পারে। একবার আমি নাম পরিবর্তনের কথাও বলেছিলাম। মাইকেল জন বা জেমস–জাতীয় নাম হলে এ দেশে ভালোভাবে পরিচিত হতে পারব এমন ধারণা যখন অস্থির করে ফেলছিল, তখন বাবা বোঝালেন, ম্যারাডোনা থেকে শোয়ার্জেনেগার বা শাহরুখ বা অমিতাভ—কেউই নাম নিয়ে সংকটে পড়েননি। খ্যাতি বা বিস্তার নামের ওপর নির্ভর করে না বরং নামই তাকে অনুসরণ করে। তবু ছোট করে অর্ক দাশ নাম নিয়ে হাজির হলাম থিয়েটারে। ২০১০ সালে বিখ্যাত অনসম্বল থিয়েটারে রাতের পর রাত চলল এনিমেল আউট অব পেপার। সঙ্গে ছিলেন হলিউড তারকা তারা মোরিস। সেটি আমার জীবনের মাইলফলকও বটে। গ্রিফিন থিয়েটারে অভিনয় করে আমি শিখেছি পেশাগত যোগ্যতা কী এবং কাকে বলে।
অভিনয়ের জগতে ছোট ছবি বা শর্ট ফিল্ম জগদীশ জি আমার সূচনা পর্বের প্রথম ছবি। এটি প্রশংসিত হওয়ার পর আমি ক্যাসোনোভায় সহসম্পাদনায়ও হাত লাগাই। ইতিমধ্যে আমার আত্মপ্রকাশ ঘটে টিভি সিরিয়ালে। এখানকার বিখ্যাত চ্যানেল চ্যানেল নাইনের ‘দ্য কোড’ সিরিজে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আমার অভিনয় প্রশংসিত হওয়ার পর আমার ডাক পড়ে ছায়াছবিতে। আমি অনুপম শর্মার পরিচালনায় আনইন্ডিয়ান–এ মনোনীত হওয়ার পর খ্যাতিমান ক্রিকেটার ব্রেট লির বন্ধু হয়ে যাই। এ ছবিতে আমরা বন্ধু চরিত্রে অভিনয় করেছি। সঙ্গে ছিলেন সুপ্রিয়া পাঠক, আশীষ খুরানা, ত্বনিষঠা চ্যাটার্জির মতো হেভিওয়েট অভিনেতারা। ছবিটিতে আমি সুযোগ পেয়ে একটি বাংলা সংলাপও জুড়ে দিই। এর মাধ্যমে আমি যখন ছায়াছবিতে ঠুকছি, তখনই পাই দ্য লায়ন–এ অভিনয় করার লোভনীয় প্রস্তাব। স্লাম ডগ মিলিওনিয়ারখ্যাত দেব প্যাটেল, বিশ্বসেরা নিকোল কিডম্যান অভিনীত আর হলিউডে নির্মিত এ ছবিতে আমার ভূমিকা ছোট হলেও মজার।

মাইকেল জন বা জেমস–জাতীয় নাম হলে এ দেশে ভালোভাবে পরিচিত হতে পারব এমন ধারণা যখন অস্থির করে ফেলছিল, তখন বাবা বোঝালেন, ম্যারাডোনা থেকে শোয়ার্জেনেগার বা শাহরুখ বা অমিতাভ—কেউই নাম নিয়ে সংকটে পড়েননি

ব্যক্তিজীবনে আমি বাংলাদেশের সঙ্গে আবেগে মিলেমিশে একাকার। আমার খাবারদাবার বা পোশাকে এখনো বাঙালিয়ানা। আমি বৈশাখী মেলায় যাই পাঞ্জাবি পরে। আমার প্রিয় বিস্কুট বেলা। আমার প্রিয় খাবার ডাল–ভাত আর বেগুনভাজি। নাটক–সিনেমার কারণে মাঝেমধ্যে হলিউডবাসী হলেও আমার মন পড়ে রয় বাড়ি ফিরে এসব খাবারের জন্য। আমি মনে করি, অভিনয় কোনো সহজ ব্যাপার নয়। এখন যে যুগ, তাতে পড়াশোনা না জানলে অভিনয় করা মুশকিল। সেদিনও কথা হচ্ছিল অভিনেতা নিকোলাসের সঙ্গে। নাইডায় পড়াশোনা শেষ করা এই অভিনেতা আমার প্রিয়। আমি নিজেও এখানকার নাইডাতে ক্লাস করছি। ভবিষ্যতে নাটকে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার ইচ্ছা আছে আমার। স্কুলজীবন থেকে পড়তে পড়তে এবং করতে করতে অভিনয় যে কখন অস্থিমজ্জায় ঢুকে গেছে, বুঝতেও পারিনি। নিঃসন্দেহে আমার মা–বাবা আমাকে প্রেরণা ও সমর্থন না দিলে আমি তা করতে পারতাম না।
আমার ইচ্ছা আছে বাংলাদেশে কাজ করার। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে তুলে ধরার জন্য এরই মধ্যে অনেকের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। সময় ও সুযোগ পেলেই আমি এ নিয়ে কাজ করব। বিশেষ ধন্যবাদ প্রথম আলোকে। যারা আমাকে দিয়েছে নতুন এক প্রেরণা। গত ৩১ অক্টোবর প্রথম আলোর ছুটির দিনে লেখাটি প্রকাশের পর আমি যে সাড়া পেয়েছি, তাতে আমি অভিভূত। সত্যি বলতে কি, জন্মভূমিতে নন্দিত হওয়ার স্বাদই আলাদা। আমি কৃতজ্ঞ। আমার ধারণা, এই আলো আমার ভবিষ্যৎকে আরও আলোকিত করবে।

লেখক পরিচিতি
অর্ক দাশ অভিনয়শিল্পী। জন্ম বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী এই তরুণ সেখানে মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র—তিন মাধ্যমেই অভিনেতা হিসেবে সুনাম অর্জন করেছেন। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে চলচ্চিত্র আনইন্ডিয়ান। মুক্তির অপেক্ষায় হলিউডে নির্মিত দ্য লায়ন। সেখানে তিনি নিকোল কিডম্যান ও দেব প্যাটেলের সহ–অভিনেতা হিসেবে কাজ করেছেন।


সেসব কীর্তিগাথা শোনাচ্ছেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করা কয়েকজন প্রবাসী: