একঝাঁক 'রক্তযোদ্ধা'র গল্প

রক্তদাতাদের সংগঠন সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের অ্যাডমিন ও সদস্যরা।  জুয়েল শীল
রক্তদাতাদের সংগঠন সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের অ্যাডমিন ও সদস্যরা। জুয়েল শীল

এক দশক আগেও রোগীর রক্তের প্রয়োজন হলেই শঙ্কা জেঁকে বসত স্বজনদের মনে, কোথায় মিলবে রক্ত। উপায়ান্তর না দেখে অনেকেই ধরনা দিতেন পেশাদার রক্তাদাতাদের কাছে। টাকা দিয়ে কেনা রক্ত রোগীর শরীরে দিয়ে সাময়িক প্রয়োজন মিটলেও ভর করত আরেক দুশ্চিন্তা। রোগ সারাতে আরেক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না তো? আশার কথা, রক্ত নিয়ে দুশ্চিন্তার সময় এখন অতীত। রক্তদাতা একদল তরুণ সারাক্ষণ অপেক্ষায় থাকেন একটি আহ্বানের, ‘একজন মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন।’ খবর পেলেই ছুট। রোগীর ঠিকানা নিয়ে পৌঁছে যান হাসপাতালে। রক্ত দিয়ে ফেরেন হাসিমুখে। 

চট্টগ্রাম শহরের একদল তরুণের এটি এখন রুটিন কাজ। স্বেচ্ছায় রক্তদাতারা মানুষের পাশে থাকতে গড়ে তুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। রক্তদানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরা ছুটে বেড়ান মানুষের জীবন বাঁচাতে। এমনও হয়েছে রোগীর নামধাম জানেন না, রক্ত দিয়ে চলে এসেছেন। এ রকম অনলাইনভিত্তিক একটি সংগঠন—সিটিজি ব্লাড ব্যাংক।

সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন সূর্য দাস শোনান তাঁদের এক হওয়ার পটভূমি। প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে এখন চাকরি করছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। সূর্য বললেন, ‘আগে থেকে কারও সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় রক্ত দিতে গিয়ে পরিচয়। এরপর ফেসবুকে কথাবার্তা। একটা সময় চিন্তা করলাম, নিজেদের একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার। এরপর সবার সঙ্গে আলোচনা। অবশেষে ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু।’ 

চট্টগ্রামের রক্তদাতা সংগঠনগুলোর মধ্যে সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম বেশি বিস্তৃত। ফেসবুকে এই সংগঠনের অনুসারী (ফলোয়ার) সাড়ে তিন লাখের বেশি। তাঁরা প্রতিদিন গড়ে রক্ত দেন কমপক্ষে ২৫ ব্যাগ।

এত চাহিদা? সামাল দেন কীভাবে? মুখে হাসি টেনে সূর্য বলেন, ‘আমাদের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা এখন অনেক বেশি। সামাল দেওয়া কঠিন বটে, তবে পারছি তো। কারণ, আমাদের বড় শক্তি ফলোয়াররা। ফেসবুকে রক্তের আহ্বান পোস্ট করলেই ফলোয়াররা যোগাযোগ শুরু করেন। এরপর আমাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রক্তদাতা পৌঁছে যান রোগীর কাছে। অবশ্য রোগীর বিস্তারিত জেনে তারপর আমরা উদ্যোগ নিই।’ 

চট্টগ্রামের সবখানে রক্ত দিতে যান? সূর্য বললেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজারে রক্ত দিতে যান আমাদের সদস্যরা। শুধু চট্টগ্রাম নয় দেশের প্রতিটি জেলায় আমরা রক্ত দিয়ে আসছি। আমাদের ফলোয়ার সব জেলায় রয়েছেন। এই কাজে কোনো ছুটির দিন নেই। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টাই রক্তের চাহিদা থাকে। যখন-তখন ফোন আসে। পালা করে আমাদের কেউ না কেউ সারা দিন অনলাইনে সক্রিয় থাকেন। চাহিদা পাওয়ামাত্রই তা পূরণের জন্য তৎপর হয়ে পড়েন।’ 

সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডমিন ১২ জন হলেও বর্তমানে ১৯ জন রয়েছেন। অ্যাডমিনরা ২০ বারের ওপরে রক্ত দিয়েছেন।  তাঁরা হলেন ইমরান ইমু, সূর্য দাস, মো. মোর্শেদুল আলম, আলতাফ মোহাম্মদ জাহেদ, ফরহাদ মো. কাউছার, রাজু দেব, ইমাম হোসাইন, মো. শোয়েবুল হক চৌধুরী, মাসুদুর রহমান, সোহেল রানা, কে এইচ মো. ইউসুফ, আরমান শরীফ, আশ্রাফ ভূঁইয়া, মো. বাপ্পী, খালেদ হাসান, আখতার হামিদ, নাসির উদ্দিন, মো. ইউসুফ ও রাজীব দাশ।  

এ ছাড়া ১১৩ জন সহ–কার্যকরী ও  ৫৬ জন কার্যকরী সদস্য এবং ৫ জন মডারেটর রয়েছেন। সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হতে আগ্রহী ব্যক্তিদের প্রথমেই সহ–কার্যকরী সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। কর্মদক্ষতায় নির্বাচিত হন কার্যকরী সদস্য। তাঁদের রয়েছে ‘সুপার ডোনার’ নামে রক্তদাতাদের একটি তালিকা। যেখানে ৫০ জন সদস্য রয়েছেন। তাঁরা দেশের যেকোনো প্রান্তে গিয়ে রক্ত দিতে প্রস্তুত।

রক্তদান করা ছাড়াও শীতবস্ত্র বিতরণ, ব্লাড গ্রুপিং, রক্তদানে উৎসাহিত করা ও থ্যালাসেমিয়া মুক্তির লক্ষ্যে সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন, অসহায় রোগীদের সাহায্য করা ও বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ। এ পর্যন্ত সচেতনতামূলক ৩০০টির বেশি ক্যাম্পেইন করা হয়েছে। চট্টগ্রামের সব উপজেলার পাশাপাশি সিলেট, টেকনাফ, বান্দরবান, লামা, ফরিদপুর, নওগাঁ, ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এসব ক্যাম্পেইন করা হয়েছে। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিবছর ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে রক্তদানে বিশেষ ভূমিকা রাখা ব্যক্তিদের সম্মাননা দেওয়া হয়।

যেখানে ঘুচে যায় দূরত্ব

ঘটনাটি ২০১৭ সালের প্রথম দিকের। প্রসূতি এক নারীর জন্য রক্তের প্রয়োজনে ফোন আসে ঝিনাইদহ থেকে। রক্তের গ্রুপ এবি নেগেটিভ। অ্যাডমিন ইমাম হোসাইনের গ্রুপ সঙ্গে মিলে যায়। একটি মাদ্রাসায় কর্মরত ইমাম হোসাইন এই ধরনের আহ্বানের জন্য প্রস্তুতও ছিলেন। খবর পাওয়ার পরপর রওনা হয়ে যান ঝিনাইদহের পথে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যান। রক্ত দিয়ে কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর আবার পথ ধরেন চট্টগ্রামের। 

ইমাম হোসাইন বলেন, ‘পথে যেতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। তারপরও রক্ত পাওয়ার রোগীর স্বজনদের হাসিমুখ দেখে সব কষ্টে ভুলে যাই। এতে আমার আনন্দ।’

আবার সিলেট সদরে গিয়ে রক্ত দিয়ে এসেছেন ইমাম হোসাইন। ২০ বছরের এক তরুণের হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ায় জটিলতা দেখা যায়। কিন্তু এবি নেগেটিভ হওয়ায় রক্ত মিলছিল না। শেষে সিটিজি ব্লাড গ্রুপের খোঁজ পান। 

ওই তরুণের স্বজন রেদুয়ানুল করিম মুঠোফোনে বলেন, ‘এই ঋণ শোধ হওয়ার নয়। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও রক্ত জোগাড় করতে পারেননি। আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের ইমাম ভাই।’

কাজের এপিঠ-ওপিঠ

রক্তদানে মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। সংগঠনটির লক্ষ্যও ছিল তা। তরুণদের অনেকেই এখন ১৮ বছর পূর্তি উদ্‌যাপন করেন রক্তদান করে। অনেক দম্পতি রক্তদানের মাধ্যমে বিবাহবার্ষিকী পালন করেন।  সমাজে এই ধরনের চর্চা তাঁদের কাজের প্রেরণা বাড়ায়। তাঁদের চাওয়া ছিলই এমন রক্তদাতা প্রস্তুত করা। অ্যাডমিনরা জানান, রক্তের ব্যবস্থা করেন বিনা মূল্যে। গরিব হলে অনেক সময় রক্তের ব্যাগও কিনে দেন। প্রতি মাসে অ্যাডমিনরা জনপ্রতি মাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ করেন এই কাজে। এই টাকা তাঁরা খুশি মনে ব্যয় করেন। রক্ত দেওয়ার পর রোগীর স্বজনদের মুখে যে হাসি দেখেন, তাতে মন ভরে যায়।

আছে তিক্ত অভিজ্ঞতাও। ২০১৬ সালের ২৯ আগস্ট বিকেল ৫টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের নিচে সংগঠনের ৩০ জন সদস্য নিয়ে বৈঠক চলছিল। এর মধ্যে পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে তাঁদের পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যায়। তাঁদের কাজ সম্পর্কে নগরের অনেকেই জানতেন বলে পুলিশের ভুল ভাঙে। আট ঘণ্টা পর রাত একটায় সবাই ছাড়া পান। 

এ ছাড়াও তাঁদের দুজন অ্যাডমিনকে রক্ত লাগবে বলে ডেকে নিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের নার্সিং ক্যাফের সামনে মারধর করা হয়। তাঁদের থেকে মুঠোফোন ও ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। যদিও থানা ও মেডিকেলের তখনকার ছাত্র সংসদের সহায়তায় মুঠোফোন পেলেও টাকা পাওয়া যায়নি। 

 তবে এসব নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁদের কথা, ‘এসব বাধা পেরিয়েই এগোতে হবে আমাদের। থামার জন্য তো শুরু করিনি।’

রক্ত পেতে...

এই সংগঠনের মাধ্যমে রক্ত পেতে হলে প্রথমে সংগঠনের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিতে হবে। এই পোস্ট পাওয়ার পর সংগঠনের অ্যাডমিন কিছু তথ্য চেয়ে রক্তের সন্ধানকারীর কাছে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠান। সন্ধানকারীর কাছ থেকে সেই তথ্য পাওয়ার পর রক্তের গ্রুপ উল্লেখ করে ফেসবুক সদস্যদের চাহিদা জানিয়ে দেওয়া হয়। অনলাইনে অভ্যস্ত নন এমন ব্যক্তিদের সেবা দেওয়া হয় মুঠোফোনের মাধ্যমে (০১৮৫৮৪৭০০৩৭, ০১৬৩৬১৭৫৫১৭, ০১৮১৪৩৫৮৭৮৭ ও ০১৭৩৮৪৩৭৭৭৭)। সিটিজি ব্লাড ব্যাংকের ওয়েব ঠিকানা: www. facebook. com/groups/ctg. blood. bank

www. ctgbloodbank. org.