এখন লড়াই নতুন ধারার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে

শুরু থেকেই প্রথম আলো জঙ্গিবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করছে
শুরু থেকেই প্রথম আলো জঙ্গিবিরোধী সংবাদ প্রকাশ করছে

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগানফেরত মুজাহিদদের হাতে। আর প্রথম আলোর যাত্রা শুরু নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে; ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে। তখন পর্যন্ত দেশে ধর্মভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। তবে প্রথম আলোর দ্বিতীয় সংখ্যায় (১৯৯৮ সালের ৫ নভেম্বর) প্রধান প্রতিবেদন ছিল ঢাকায় ওসামা বিন লাদেনপন্থীদের তৎপরতা নিয়ে।

বাংলাদেশে জঙ্গিদের নাশকতার শুরু ১৯৯৯ সালে। এর সূত্রপাত করে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি-বি)। এরা পরবর্তী ৬ বছরে দেশে ১৩টি বড় ধরনের বোমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ১০৯ জনকে হত্যা করে। প্রতিটি ঘটনায় প্রথম আলো সত্য অনুসন্ধান ও খবর প্রকাশ করে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা ছিল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা। এ ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল তৎকালীন বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকার। কিন্তু প্রথম আলো প্রকৃত সত্য বের করার কাজ চালিয়ে গেছে অব্যাহতভাবে। এ মামলা নিয়ে জজ মিয়াকে নিয়ে কল্পকাহিনি বানানোর ঘটনা প্রথম আলোই প্রকাশ করেছে প্রথম।

কেবল ২১ আগস্ট নয়, এর আগে আরও কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে জঙ্গিরা। ২০০১ সালে সিলেটে এমনই এক ঘটনায় এক জঙ্গির জবানিতে এসেছিল এক সেনা কর্মকর্তার নাম, যিনি ২০০৯ সালে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব হয়েছিলেন। তিনি মেজর জেনারেল মো. এহতেশাম উল হক। এ বিষয়ে প্রথম আলো দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর খবর প্রকাশ করে। এরপরে তাঁকে প্রথমে বদলি, পরে অবসরে পাঠানো হয়। এর আগ পর্যন্ত সিলেটে যে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল, সেটা জানাজানি হয়নি। পরে ওই মামলার তদন্তেও নতুন মোড় নেয়।

কেবল ঘটনা ঘটার পর নয়, আগে থেকেই প্রথম আলো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে গেছে। এ জন্য প্রথম আলোকে অনেক সময় নানা রকম বিপদ মোকাবিলা করতে হয়েছে। ২০০৪ সালের আগস্টে বৃহত্তর চট্টগ্রামে জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন করার পর তো ওই অঞ্চলে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল একটা গোষ্ঠী। তারা পত্রিকা পুড়িয়েছে, পত্রিকার হকারদের মারধর পর্যন্ত করেছে। এরপরও বিভিন্ন সময়ে এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়েছে।

হুজি-বির নাশকতার মধ্যেই এ দেশে জন্ম নেয় আরেক জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় প্রায় ৫০০ বোমা ফাটিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় এলেও জেএমবি ২০০২ সাল থেকেই বিভিন্ন এলাকায় সিনেমা হল, যাত্রা অনুষ্ঠান, মাজার ও এনজিও কার্যালয়ে হামলা চালিয়েছিল। ২০০৪ সালে রাজশাহীর বাগমারা-রানীনগর এলাকায় বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে এই জঙ্গিরা কথিত চরমপন্থী দমনের নামে নিজস্ব শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখনকার বিএনপির কয়েকজন মন্ত্রী ও সাংসদ এই জঙ্গিদের সহযোগিতা করেছিলেন। এসব নিয়ে তখন প্রথম আলো প্রতিবেদন করেছে। পরে জেএমবির সৃষ্টি, বিস্তার, তৎপরতা, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, কারা নেতা, কারা অর্থ দেয়, এই নিষিদ্ধ সংগঠনের নানা মেরুকরণ ইত্যাদি নিয়ে প্রথম আলোয় অসংখ্য প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের নতুন এক পর্ব শুরু হয় ২০১৩ সাল থেকে। ব্লগার হত্যার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে আল-কায়েদাপন্থী নতুন জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম। এই সংগঠন নিয়েই প্রথম খবর প্রকাশ করে প্রথম আলো। যার আগ পর্যন্ত এই নামটির কথা জানত না মানুষ। এরপর দৃশ্যপটে আসে আরেক ভয়ংকর সংগঠন মধ্যপ্রাচ্যের আইএস মতাদর্শী এক গোষ্ঠী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যার নাম দিয়েছে নব্য জেএমবি। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে একের পর এক বিদেশি নাগরিক হত্যা, খ্রিষ্টান পাদরি, হিন্দু পুরোহিত ও শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে এই গোষ্ঠীটি। এরা ২০১৬ সালের ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। এদের নিয়েও প্রথম আলোয় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় ও বিশেষজ্ঞ মত প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে। জঙ্গিবাদবিরোধী লড়াই শেষ হয়নি; বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে জঙ্গিবাদের নতুন নতুন ধারাকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে।